Sunday, 10 November 2024

কবির ছায়া - আশিস মিশ্র // ই-কোরাস ২০২



কবির ছায়া... 

আশিস মিশ্র 

তমলুক, মেচেদা, কোলাঘাট থেকে মেদিনীপুর, খড়গপুর। ওদিকে ঝাড়গ্রাম, ঘাটাল, চন্দ্রকোণা, গড়বেতা, সবং, মোহাড়, কাঁথি, এগরা, রামনগর, দীঘা, বেলদা, দাঁতন --একসময় ছিল আমাদের অনেক কবি - সম্পাদক বন্ধুর আড্ডা দেওয়ার জায়গা। সেই সঙ্গে কবিসম্মেলনগুলিতে যাতায়াত। সেই সব আড্ডা ও কবিসম্মেলনগুলি সংখ্যায় বেড়েছে না কমেছে, সে-সম্পর্কে আমার অনেক কিছু অজানা। তবে আড্ডাগুলি কমেছে, কবিসভা বেড়েছে, আর বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ। সর্বত্র এখনকার কবিসম্মেলনে ছুটোছুটি করতেও পারি না। তেমনি গত ৩৯ বছরে লেখালেখির জগতে অনেক তরুণ লেখক ও সম্পাদক এসে গেছেন। সব মিলিয়ে অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার সাহিত্য চর্চার সীমানা বেড়েছে বই কমেনি। এর মধ্যে আমরা অনেক খ্যাতিমান কবি - সম্পাদক - সাহিত্যিককে হারিয়েছি! বর্তমানে সাহিত্য জগতে এক একটি শিবিরও তৈরি হয়ে গেছে। 

মেচেদাতেই কয়েকটি শিবির। সব শিবিরে সবাইকে যেতে দেখি না। পাঁশকুড়ার পর হাউরে কালীপদ চৌধুরী সম্পাদিত ' মরশুমি ' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে সাহিত্য সভা হতো, তা এখন কালীবাবুর গ্রন্থাগারের সভাগৃহে মাঝে মাঝে হচ্ছে। কয়েক বছর সেখানে যাইনি। তাঁরও বয়স বেড়েছে। ভাস্কর ডাকে। আগের সেই সব সভায় অনেক পরিচিত মুখ একেবারেই বিস্মৃতির অতলে চলে গেছেন! ক'জনই বা এখন সমীরণ মজুমদারকে মনে রেখেছি! অনিলদা( ঘড়াই)- কে বাঁচিয়ে রেখেছেন সর্বাণী ঘড়াই, সুনীলদা, রাখহরিদা, ভবেশদারা। অনুপম পালধি তাঁর মতো করে প্রকাশ করে চলেছেন 'কবি ও সাংবাদিক'।

মোহাড়ে, পশ্চিমবাড়ে ক্ষিতীশদা, লক্ষ্মী, অলক, খুকুরা। ওদিকে সবং- এ নারায়ণ সামাট,  রবীন্দ্রনাথ ভৌমিক, সুব্রত, নিমাই, বকুল, শান্তনুরা --মাঝে মাঝে তাঁদের সঙ্গে সভায় দেখা হয়। বালিচক থেকে কাশীদা চলে গেছেন গড়বেতা। বালিচকে কয়েকটি কবিসম্মেলনে যোগও দিয়েছি। প্রফুল্লদা, নিত্য, আভাদি, দীপক নিজেদের মতো এই চর্চাকে ধরে রেখেছেন। 

বেলদায় কত প্রিয় কবি। দেবাশিস কিছুটা ম্লান। মৃণাল চলে গেল! কালীপদ ঘোষ, কার্তিক, কৌশিক, চম্পক, যুগজিৎ বাবু সহ আরও অনেকেই সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে নারায়ণগড়, কাঁথি, রামনগর, দীঘা থেকে এগরা, বালিসাই - এর কবি বন্ধুরা তাঁদের মতো করে চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে মুগবেড়িয়া, হেঁড়িয়া, খেজুরির কবি - সম্পাদকদের মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান করতে দেখছি। সুধীরদা, শিবানীদি, অরুণ,তরুণ প্রমুখ নারায়ণগড়ে শিল্প - সাহিত্য চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। কাঁথিতে দেবাশিস প্রধান, এস মহিউদ্দিন, দেবাশিস মাঝি, অঞ্জন, মঞ্জির, বিপ্লব, মেহেবুব, মলয়, গৌতম পাত্র, বিকাশ চন্দ সহ আরও শতাধিক কবি কাঁথির সাহিত্য চর্চাকে ধরে রেখেছেন এখনও। 

অনেক স্বপ্ন নিয়ে গড়ে উঠেছিল মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন একাডেমি। তাও টিকলো না। মেদিনীপুর শহরেও কয়েকটি শিবির ভাগ হয়ে গেল। সকলেই বন্ধু সকলের, তবুও যেন একাকি কবির ছায়া একা একা কথা বলে। এই সংকট তৈরি হয়েছে খড়গপুর, ঘাটালের সাহিত্য চর্চায়ও। ওদিকে সাঁকরাইলে প্রদীপদা নিজের মতো চালিয়ে যাচ্ছেন।  'নয়ন'- কে আঁকড়ে বিদ্যুৎ পাল ৪০ বছর কাটিয়ে দিলেন! 

দাঁতনে বীরু, সন্তু, সূর্যদা, সুনীল...যে যার মতো কাজ করছেন। সেখানেও এক কবির ছায়ার সঙ্গে আর এক কবির ছায়ার কি দূরত্ব বেড়েছে? 

ঝাড়গ্রাম, জঙ্গলমহল, ঘাটাল, চন্দ্রকোণায় কবিবন্ধুরাও এখন ভীষণ অ্যাকটিভ। সারিধরমদা, মধুপদা, লক্ষ্মনদা, কেশব, দুঃখানন্দ, বঙ্কিম, শ্রীজিৎ, সুকান্তদা, মঙ্গলদা, শ্রীতনু, কৃষ্ণ, কৌশিক, উপালী, লক্ষ্মীন্দর, শিখাদি, সন্ধ্যাদি, মানবেন্দ্র, সৈকত, প্রমীশ, অমিত, ফটিকদা, সুরেন, অনিমেষ প্রমুখ --বই, পত্রিকা প্রকাশ, কবিসম্মেলনে কোনো ভাটা পড়তে দেননি। ওদিকে --সন্তু, গুরুপদদা, গনেশ, মৌপর্ণা। একটু এগোলেই তারাশঙ্করদা, তুলসীদাস মাইতি। এর মধ্যে অনেক মহিলা কবি ও সম্পাদক রয়েছেন। যেমন মধুমিতা বেতাল, দীপালি, সোমা, অর্থিতা, মানসী ও আরও অনেকে। একটি গদ্যে অখণ্ড মেদিনীপুরের মহিলা কবি ও সম্পাদকদের নিয়ে আমি লিখেছি। লক্ষ্মণ কর্মকার আমাকে তা লিখতে বলেছিলেন 'সৃজন' এর বিশেষ সংখ্যার জন্য। 

কেবল কোলাঘাটের তাপস বৈদ্য, প্রশান্ত শেখর ভৌমিক, অনিলদা, আবদুল মান্নান,মনোরঞ্জনদা, ডাক্তার রমেশচন্দ্র বেরা, সুজাতা বেরা, বিধান ঘোড়ই, বৈদ্যনাথ ধাড়া প্রমুখ মেচেদা- কোলাঘাটকে কেন্দ্র করে সাহিত্য চর্চার বৃত্তটি বাড়িয়ে চলেছেন। আরও অনেক বন্ধু আছেন এই চর্চার মধ্যে। যেমন তমলুকের কবি বন্ধুরা। শুধু তমলুক, ময়নাকে নিয়ে একটি বিশাল গদ্য লেখা যায়। অখণ্ড মেদিনীপুরের কয়েক’শ নাম এসে যায় সেখানে। 

যাই হোক -- মেদিনীপুরের সাহিত্য চর্চায় মহিলাদের ভূমিকা এখন আগের থেকে কয়েক'শ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি কবি - সম্পাদক যূথিকা দাস অধিকারীর ডাকে খড়্গপুর কলেজ অডিটোরিয়ামে গেছিলাম। তাঁর এবং সুনীল ভূঞ্যা সম্পাদিত 'খোলা জানালা' প্রকাশ ও কবিসম্মেলনে এই প্রথম আমার যাওয়া। শ্বেতা সরকার সহ সৃজন সারথী সাহিত্য পরিবারের আতিথেয়তা মুগ্ধ করেছে। প্রায় ৬০ জন কবি সম্পাদক জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উপস্থিত ছিলেন। দুই খ্যাতিমান কবি অম্বর কান্তি কুমার ও দেবব্রত ভট্টাচার্যকে কবি সম্মাননা জানানো হয়। প্রিয় অনেক কবি ছিলেন। রাখহরি পাল, বিদ্যুৎ পাল, কাশীনাথ সাহা, জাহির চৌধুরী, সিদ্ধার্থ সাঁতরা, সন্ত জানা, কাশীনাথ সাহা, তাপস মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ মাইতি, অতনুনন্দন মাইতি,  মিঠু মণ্ডল, জয়শ্রী সরকার, নরেশ জানা, তপন তরফদার, ইতি মণ্ডল ,শাজাহান কবির, মনোজ মোহন চক্রবর্তী প্রমুখ। কবিতা পাঠ, আলোচনা, সংগীত, বইপ্রকাশ ইত্যাদির মধ্যে কয়েক ঘন্টা কেটে গেল আমাদের। তবে যে কথাটি বলার, তা হলো যূথিকাদি প্রায় এক দশক ধরে একটি পত্রিকাকে যেভাবে সম্পাদনা করছেন নানা সমস্যা নিয়ে, তা কম কী! এখন সুনীল ভূঞ্যা সহ সৌমেন্দ্রনাথ মাহাত, মহুয়া ব্যানার্জী, মৃদুলা বিশ্বাস, জয়ন্তী রায় সরকার প্রমুখের প্রেরণায় সৃজন পরিবার আরও নিরন্তর চর্চার মধ্যে  এগিয়ে চলুক, এই আশা করাই যায়।


সংক্ষেপে এই প্রতিবেদন। এতে অনেক গুণী মানুষ, বন্ধুর নাম; অখণ্ড মেদিনীপুরের সমস্ত মহকুমা, ব্লক, পঞ্চায়েত, পুরসভার কবি, সম্পাদক, সাহিত্যিকের নাম, পরিচয় এখানে লেখা সম্ভব হয়নি। কয়েক বছর আগে অখণ্ড মেদিনীপুরের সাহিত্য চর্চা নিয়ে 'আপনজন' এর বিশেষ সংখ্যা হয়েছিল। প্রায় ৫০/৬০ জন লেখকের গদ্য সেখানে ছাপা হয়েছে। এই সংখ্যাটির নতুন সংস্করণ করার কথা ভাবছি আমরা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সংখ্যা যে কোনো সাহিত্যের গবেষণার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। শুধু অখণ্ড মেদিনীপুর কেন, পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলা ভিত্তিক সাহিত্যের ইতিহাস লেখা জরুরি। এক একটি জেলা র সাহিত্য চর্চার আদি, মধ্য, আধুনিক, উত্তর আধুনিক যুগ ধরে উপযুক্ত লেখকদের দিয়ে গদ্য লিখিয়ে এক একটি লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে। সেই সংখ্যাগুলি একত্রে করলে মহাভারতের কয়েক গুণ বেশি ভল্যুম হয়ে যাবে। জেলা ভিত্তিক কেউ কেউ সেই কাজ করেছেন হয়তো। পুরোটা আমারও অজানা। শুধু অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার সাহিত্য চর্চার ইতিহাস নিয়ে কয়েক খন্ডে বই প্রকাশ করা যায়। এবং তা অনেক সময় ও ব্যয়বহুল কাজ। বিনে পয়সায় বই প্রকাশ করে দেওয়ার মতো প্রকাশক পেলে সেই কাজে আমি অংশ নিতে পারি। আপনাদের মতো বন্ধুদের ( বিশেষ করে যাঁরা জেলার সাহিত্য চর্চা নিয়ে ভালো গদ্য লিখতে পারেন)  পাশে পেলে এই কাজ করা সহজ হবে। আসুন না, সকলে মিলে নিজেদের এলাকার সাহিত্য চর্চার ইতিহাস লিখে যাই। শুধু আমার ওপর ভালোবেসে, মান-অভিমান - রাগ করে কমেন্ট লিখে ছেড়ে দিলে কিস্যু হবে না। কবিতা লিখতে এসেছেন, পত্রিকার সম্পাদক হচ্ছেন,অথচ এলাকার সাহিত্য চর্চার কিছুই জানবেন না, এমন ফাঁকি দিয়ে কিছুই হওয়া যায় না। কবির ছায়া মানে একটা বড় শান্তির আশ্রয় হতে পারে, ছাতাও হতে পারে, অবয়ব হীন হতে পারে, বেদনাও হতে পারে, অতএব...


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...