জীর্ণ মন্দিরের জার্ণাল : শ্রীশ্রী রঘুনাথ জীউ মন্দির।
গ্রাম-সুরতপুর, দাসপুর থানা জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর
চিন্ময় দাশ
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ তখন। সম্পূর্ণ মেদিনীপুর জেলা বর্ধমান রাজার আধীন। উত্তর প্রদেশ থেকে এক তেওয়ারী ব্রাহ্মণ, নিজের ভাগ্যসন্ধানে বেরিয়ে বাংলায় চলে এসেছিলেন। বর্ধমানরাজার সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। বাংলায় মোগল শাসন তখন দুর্বল। নবাব আলিবর্দী খাঁ ঘৃণ্য চক্রান্তে, মারাঠা সেনাপতি ভাষ্কর পণ্ডিতকে গুপ্ত হত্যা করেছেন। তার প্রতিশোধ নিতে, স্বয়ং রঘুজী ভোঁসলে বিশাল বাহিনী নিয়ে, বাংলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ভয়ানক বর্গী বাহিনীর আক্রমণে, নিম্নবাংলা তখন ভয়ানক বিপর্যস্ত।
সেই তেওয়ারী ব্রাহ্মণের নাম খড়্গসেন। লোকশ্রুতি আছে, খড়্গসেন ছিলেন বিপুল শক্তিধর বিশালদেহী পুরুষ। দু’ ধামা মুড়ি আর দুটো আস্ত কাঁঠাল দিয়ে নাকি সকালের জলখাবার হোত সেই শক্তিধরের।
রাজার হয়ে বর্গী আক্রমণ মোকাবিলার এক যুদ্ধে, সেই খড়্গসেন একাই, এক হাজার বর্গী নিধন করেছিলেন। বর্ধমান রাজা বীরত্বের পুরষ্কার দিয়েছিলেন তাঁকে। ইষ্টদেবতা শালগ্রাম শিলা সাথে এনেছিলেন খড়্গসেন। ইষ্টদেবতার জন্য, রাজা বিপুল নিষ্কর সম্পত্তি দিয়েছিলেন বীর সেনানীকে। আর দিয়েছিলেন ’হাজারী’ খেতাব। সেই থেকে ‘তেওয়ারী’ পদবী ছেড়ে, খড়্গসেন হাজারী নামে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি।
তখন ১৭৫৫ সাল। রাজার দেওয়া সনন্দ নিয়ে মেদিনীপুরের চেতুয়া পরগণায় চলে আসেন খড়্গসেন। সুরতপুর নামের গ্রামে ভদ্রাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
নিজের ইষ্টদেবতা রঘুনাথ-এর জন্য বড়মাপের একটি মন্দিরও গড়েছিলেন তিনি। সেই সাথে বড় মাপের একটি রাসমঞ্চও। শালগ্রামের সাথে রামচন্দ্র, সীতাদেবী, ভরত, শত্রুঘ্ন, লক্ষ্মণ এবং হনুমান—ছয় দেবদেবীর মূর্তি গড়িয়েছিলেন খড়্গসেন। সবই অষ্টধাতুর তৈরি, ভারি ওজনের বড়মাপের মূর্তি। ঘটা করে বিশেষ আড়ম্বরের সাথে পূজার্চনা হোত হাজারীবংশে।
কিন্তু কবি বলে গিয়েছেন—“চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।“ হাজারীবাড়িতেও যায়নি। সিংহভাগ সম্পত্তি চলে গিয়েছিল জমিদারী উচ্ছেদের আইনে। বাকি যা কিছু ছিল, সবই চলে যায় পরবর্তীকালে বাংলার রাজনৈতিক ডামাডোলের দিনগুলিতে।
সেই অভিঘাতে, হাজারিবংশ একেবারে নিস্ব হয়ে যায়। এমনই সঙ্কট তখন, নিত্যপূজাটুকু চালানোও দুরুহ হয়ে উঠেছে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে, একটি আশ্রমের হাতে তুলে দিতে হয়েছে অষ্টধাতুর ছটি বিগ্রহ। কেবল শালগ্রামটিকে রেখে দিয়েছিলেন বুকে আঁকড়ে।
এবার কালের করাল গ্রাস শুরু হয়েছিল দেবতার মন্দিরটিতে। দিনে দিনে মন্দির জীর্ণ হতে শুরু করলে, সংস্কার করা তাঁদের সাধ্যে কুলিয়ে ওঠেনি। অগত্যা একদিন জীর্ণ দেবালয় থেকে, বিগ্রহ তুলে আনতে হয়েছে একটি কাঁচামাটির একটি মন্দির গড়ে। সময় তখন বাংলা ১৩৭৯ সন।
সময়কালটি উল্লেখ করা আছে মাটির মন্দিরেও। কাঁচা দেওয়ালে হাতের আঁক কেটে লেখা, নিজেদের অক্ষমতার স্বীকারোক্তি। বড় করুণ সেই মন্দির-লিপি!
বর্তমানে হাজারীবংশের বিশ্বনাথ, দেবাশীষ এবং বিপ্লব—তিনজনের পরিবারে পূজিত হচ্ছেন দেবতা। জন্মাষ্টমী আর মকর সংক্রান্তিটি সাধ্যমত আড়ম্বরের সাথে পালিত হয় আজও। ব্রাহ্মণ হওয়ার সুবাদে, হাজারীবংশ নিজেরাই মন্দিরে পৌরহিত্য করেন।
৪০ ফুট উঁচু দক্ষিণমুখী মন্দিরটি গড়া হয়েছিল পঞ্চ-রত্ন রীতিতে। সামনে ছিল খিলানের তিনটি দ্বারযুক্ত একটি আলিন্দ। ইমারতি-রীতির স্তম্ভগুলি ছিল চেয়ে চেয়ে দেখবার মতো। অলিন্দের সিলিং ছিল টানা খিলানের। গর্ভগৃহটি একদ্বারী। তার সিলিং হয়েছিল পিরামেডের আকারে, ক্রমশ উর্ধ্বগামী সূচীমুখ লহরা-রীতিতে।
মন্দিরের মাথায় ‘বিষ্ণুপুরী-ঢাল’ যুক্ত চালা-ছাউনি দেওয়া। তার উপর বেদী স্থাপন করে পাঁচটি রত্ন। প্রতিটিতে উলম্বভাবে কলিঙ্গশৈলীর রথ-বিভাজন এবং ভূমির সমান্তরালে পীঢ়-ভাগ করা।
সমীক্ষায় দেখা যায়, এখন কেবল কেন্দ্রীয় রত্নটিই টিকে আছে কোনও রকমে। বাকি সব অব্লুপ্ত। সমগ্র মন্দিরসৌধ ঘন ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ঢাকা। বিষাক্ত সরীসৃপকুলের অবাধ রাজ্যপাট।
জানা গিয়েছে টেরাকোটা ফলক তেমন ছিল না। তবে, পঙ্খের সুন্দর কারুকাজ ছিল মন্দিরটিতে। হায়, আজ সবই অতীত কথা। চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেবালয়টি।
আজ এই খণ্ডহরের দিকে চোখ পড়লে, বেদনায় বুক ভরে যায়। নীরবে অশ্রুপাত করা ছাড়া, একে রক্ষা করবার সাধ্য আজ আর হাজারীবংশের হাতে নেই।
সাক্ষাৎকার:- শ্রী বিশ্বনাথ হাজারী এবং শ্রী বিপ্লব হাজারী—সুরতপুর।
পথনির্দেশ:- পাঁশকুড়া স্টেশন কিংবা মুম্বাই রোডের মেচগ্রাম থেকে, ঘাটালগামী রাস্তার বকুলতলা। সেখান থেকে বামে, নাড়াজোল মুখী রাস্তায় সুরানয়নপুর। এবং মেদিনীপুর থেকে বাসে নাড়াজোল হয়ে সুরানয়নপুর। সেখান থেকে কিমি তিনেক উত্তরে সুরতপুর।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:- মন্দিরের কয়েকটি ছবি তুলে দিয়েছেন শ্রী সবুজ হাজারী।
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment