Sunday, 1 September 2024

শ্রদ্ধাঞ্জলি : কমল চক্রবর্তী // ই-কোরাস ১৯৩

 


১.

জামশেদপুরে বর্ষা : কমল চক্রবর্তী

তৃষ্ণা বসাক 


কতকাল পরে ফের সবাই বসেছে মুখোমুখি

প্লেটে প্লেটে গরম খিচুড়ি চালানি মাছের পেট

এমন নিজস্ব দিন, আহা দীর্ঘ হোক

এমন দিনেই শুধু বন্ধুর জুতোর কাঁটা দাঁতে করে তুলে ফেলা যায়

কাঁধে হাত বলা যায় সীতানাথ, তোমার বিয়ের দিন ট্রেন স্ট্রাইক হলে

মুখেতে লাগাম এঁটে নিয়ে যাবো ছাদনাতলায়।


আমাদের সবই কম, ভালোবাসা, বেড়াতে যাবার দিন

বয়স বাড়ার আগে শরীরের আঠা

সাইকেলে চাইবাসা ট্যুর, বিনা টিকিটে দূর কটক কোনার্ক

বৌদ্ধযুগের ভাঙ্গা মূর্তির মতো

শুধু প্রয়োজনে, শুধু প্রয়োজনে ছুঁয়ে দেখা বয়সের সীমা

সুশোভন আজ বৃষ্টি হোক

স্ন্যাগ পাহাড়ে আজ একটাও ট্রলি আসবে না

হুটারের শব্দ হলে,  নতজানু চেয়ে নেবো একটা রাত্রির

            বৃষ্টি হোক শহর ভাসিয়ে

আমরা সবাই আজ বৃষ্টি মাথায় করে মদ খাবো

পুরনো সাইকেল নিয়ে বহুদূর চাইবাসা বেড়াতে বেরোব।


না বর্ষা নয়,   শরতে, সম্ভবত  2021 সালের একাদশীর দিন ঝাড়খণ্ড ভ্রমণের এক ফাঁকে গালুডি থেকে হাজির হয়েছিলাম ভালপাহাড়ে।


এই যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি কিছুই ছিল না। তরুণ বয়স থেকে শুনে শুনে ভালপাহাড় তো এক মিথ, এত কাছে এসে দেখে আসতে চেয়েছিলাম।

আশঙ্কা ছিল আমাকে চিনতে পারবেন কিনা। কথাসাহিত্য উৎসবে দেখা,  খুব উষ্ণ আন্তরিকতায় জানিয়েছিলেন আমার লেখার প্রতি ওঁর আগ্রহের কথা। সেটুকু সম্বল করে পড়ন্ত বেলায় যখন গেলাম তখন উনি খেয়ে উঠছেন সবে।

বৃক্ষটির নিচে এক আদ্যন্ত জীবনরসিক মানুষ। অনেক কথা হল। সেসব পরে কোথাও লেখা হবে হয়তো।


ফিরে যখন আসছি, সন্ধে নামছে। হাটে ছোট ছোট টেমি জ্বেলে বেচা কেনা হচ্ছে।  আমাদের দলের সঙ্গে থাকা দুটি সতেরো বছরের কিশোর কিশোরী কিছুতেই বুঝতে পারছে না এমন একজন লোক কেন এবং কীভাবে এখানে থাকেন!

লালচে অন্ধকারের মধ্যে চাঁদ উঠল। পূর্ণিমার  চারদিন আগের চাঁদ। 

মায়া মায়া হে। বড় মায়া।


আগের বছর কৌরব পত্রিকার জন্য একটি গল্প চেয়েছিলেন। এই প্রথম আমার কৌরবে লেখা। তার একটি অংশ এখানে থাকল। এই সময়কে ধরে থাক।


আমি একজনকে খুন করতে চেয়েছিলাম

 

আমি একজনকে মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম সে তার আগেই মারা গেছে। খুন হয়েছে , না আত্মহত্যা নাকি স্বাভাবিক মৃত্যুই  হয়তো, রোগে ভুগে তা  আমি জানি না। তবে অসুখে মৃত্যু হলেও তাকে স্বাভাবিক বলা যায় না। খাবারে রোজ অল্প অল্প করে বিষ মিশিয়েও সেটা একটা অসুখের চেহারা দেওয়া যায় । আবার অল্প অল্প করে বিষ দিয়ে বড় বিষের হাত থেকে বাঁচানো যায়। যেমন করেছিলেন চাণক্য, উনি নাকি রোজ চন্দ্রগুপ্তের খাবারে একটু একটু করে বিষ মেশাতেন, যাতে কেউ তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে না পারে।আর রাজা একদিন কী যে ভুল করে বসলেন, সোহাগ করে নিজের পাত থেকে খাবার তুলে নিজের গর্ভিনী স্ত্রীর মুখে দিলেন। নিমেষের মধ্যে স্ত্রীর মৃত্যু ঘটল বিষক্রিয়ায়, পেট চিরে সন্তানকে বার করে আনা হল, গর্ভের সন্তানকে। এক বিন্দু বিষের দাগ লেগে থাকল কপালে। তাই তার নাম রাখা হল বিন্দুসার।

আমার মনে হয়  আমরা যখনি জন্মাই, আমাদের সবার কপালে ওই বিষের টিপ লেগে থাকে।এই জীবন আসলে হত্যার শিবির। সবাই সবাইকে নানা ভাবে খুন করার চেষ্টা করছে। সবার টা ধরা পড়ে না। আমি কিন্তু সত্যিই এই লোকটাকে খুন করতে এসে হাজির হয়েছি।   তার শরীরের চারপাশে কড়া বেষ্টনী। বেঁচে থাকতে এত নিরাপত্তা বলয় তার ছিল না। বলা হচ্ছে শুধু ফুল আনবেন  আর সে ফুল সংগ্রহ করবে  শোক বাংলা ৭০৭  নামে এক সাহায্য কর্মী।

আমি একটা বন্দুক রাখলাম, খেলনা বন্দুক। তার পাশে একটা কাগজে লিখলাম ঠা ঠা ঠা। তারপর একটা কান্নার ইমোজি দিয়ে  লিখলাম মিস ইউ। লিখে বেজায় হাসি পেল। মিস ইউ মানে কি আমি যা বলতে চাচ্ছি তাই?  এর মানে তো… তাই কেটে লিখলাম ফাক ফাক ফাক! আই মিসড দা চান্স টু কিল ইউ।

 লিখে চলে আসছি। চারদিকে সুশৃঙ্খল লাইন। একটা লাইন মৃতদেহ অবদি যাচ্ছে, আর একটা লাইন মৃতদেহ থেকে বেরিয়ে আসছে। যত ফুল জড়ো হচ্ছে, শোক বাংলা ৭০৭ সেগুলো  সরিয়ে নিচ্ছে। বেরোবার মুখে দেখলাম সেই ফুলগুলো নিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে বিক্রি করছে ডাবল দামে। বিক্রি হচ্ছেও। যারা ফুল আনতে ভুলে গেছে, তারা কিনছে, কিনতেই হচ্ছে। ফাঁকা হাতে কোন মৃতদেহের কাছে যাবার শক্তি নেই তাদের।

আমি আস্তে আস্তে  বেরিয়ে এলাম। হঠাৎ মোড়ের মাথায়  দেখলাম জায়েন্ট স্ক্রিনে মরদেহ  আর তার সামনের লম্বা লাইন দেখানো হচ্ছে। লাইভ। ক্যামেরা হঠাৎ আমার সেই কাগজের টুকরোর ওপর জুম করল। যেখানে আমি লিখে এসেছি-ফাক ফাক ফাক! আই মিসড দা চান্স টু কিল ইউ।

 

অমনি কী একটা হুড়োমুড়ি লেগে গেল। আমি বুঝতে পারলাম এবার আমাকে খোঁজা হবে। সেটা খুব সহজ হবে না।  কারণ আমি একটা হুডিতে মুখে ঢেকে ছিলাম, আর বেরিয়ে আসার সময়, হুডিটা উলটে পরে নিয়েছি। ওদিকটা নীল ছিল, এদিকটা সবুজ রঙ। আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না। আমি তাই পাশের পাবে ঢুকে একটা ড্রিংক নিলাম। অপরাজিতা ফুলের শরবত। ঘন নীল রঙের। আমার মনে হল। এটাই এই মুহূর্তে খাওয়া যায়। কারণ মৃত্যুর রঙ নীল। আমি না মারতে পারলেও লোকটা মারা গেছে তো। আমি পরেও গেছিলাম নীল রঙের হুডি। কিন্তু এখন সেটা উলটে পরতে বাধ্য হয়েছি। প্রাণে বাঁচতে হবে তো। আমার এখনো কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। কিছু লোককে মারা বাকি। কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ। যাকেই মারতে চাই,  দেখি সে আগে মরে গেছে। এ যেন গীতার মতো ব্যাপার। কৃষ্ণ কহিলেন ‘ওদের আমি আগেই মেরে রেখেছি।‘

শরবতে চুমুক দিতে দিতে সামনের আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি। আরে আমার হুডির রঙ আবার নীল হয়ে গেছে কখন। তাহলে কি আমি উলটে পরিনি আদৌ? তখনি মনে পড়ে এই হুডি কিছুক্ষণ পর পর  রঙ বদলায়। কী সাংঘাতিক। আমি তো একটা ভয়ানক লুপে পড়ে গেলাম। কখন যে নীল হবে আর তখনি যদি ওরা  আমাকে দেখে- এই প্রোবাবলিটি ফ্যাক্টর কম হলেও  হতেও পারে।

এর মধ্যেই স্টেশনের নাম বদলে যাচ্ছে, রাস্তার নাম। পুলিশ গুলোও কিছু বুঝতে পারছে না। ওদের ওয়াকি টকিতে নির্দেশ আসছে হ্যালো হ্যালো পিটার মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট। কিন্তু মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট কোথায়? এ তো অক্ষয় কুমার দত্ত রোড । নির্দেশ আসছে  নাকতলা। কিন্তু সে নামে কোন স্টেশন নেই। নীল রঙের হুডি পরা ছবি এসেছে। কিন্তু যে লোকটা পালাচ্ছে তার হুডির রঙ সবুজ, না তো গোলাপি, এই যা কালো, ওহ এই তো নীল। কিন্তু নীল কখন হবে, এত উত্তেজনায় শরীর খারাপ হয়ে যায়। পুলিশ রাস্তার ধারে বসে মাথায় কোল্ড ড্রিংক ঢালে একের পর এক। পয়সা দেয় না। কেনই বা দেবে? ততক্ষণে পালিয়ে যাওয়া লোকটার হুডি লাল, সে নিশ্চিন্তে পুলিশের পাশে বসে লেমনেড খায়!

লেমনেড বাজারে পাওয়া যায় না, তাতে কি, কোন কোল্ড ড্রিংক, যাদের প্রচারে হেলিকপটার থেকে নেমে আসে নায়ক, এক ক্রেট ড্রিংক নিয়ে আবার হেলিকপ্টারে উঠে যায়-  তাই খায় তাহলে। এই গল্প তেমনি হবে, যেমন পাঠক চাইবে। আমার মেয়ে যেমন করত ছোটবেলায়, ক্রমাগত ইনপুট দিতে দিতে গল্পটা তার মনের মতো করে নিত।

একটা লোক ছিল।

না না বলো একটা গরিব লোক ছিল।

ঠিক আছে, একটা গরিব লোক ছিল।

বলো তার খুব দুঃখ ছিল।

ঠিক আছে, তার খুব দুঃখ ছিল।

এইভাবে চলতে চলতে গল্পটা আমার মেয়ের রচনা  হয়ে উঠত।

একইভাবে আমার গল্পের নায়ক পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী লেমনেড নয়, ট্রাক থেকে তুলে আনা নায়কের পছন্দের কোল্ড ড্রিংক খায়। আর খেতে খেতে খেতে খেতে তার হুডির রঙ লাল থেকে আবার নীল হয়ে যায়। পুলিশ খেয়াল করে না। কিন্তু সে তো বোঝে। তাই সে বোতল রেখে ছুটতে শুরু করে। আর ওর ছুট দেখে পুলিশও ছোটে। ছুটতে ছুটতে চারপাশের ভিড় কমে আসে। উঁচু বাড়িঘর, আকাশ চাটা বাড়ি কমে আসে। নীল নীল পাহাড় আর ঝর্ণা আর তাদের ঘিরে হাত তালি দেওয়া গাছ। ওরা ছুটতে থাকে। যেন একটা চলন্ত রাস্তার দুইপ্রান্তে দুইজন বাঁধা, এমনভাবে তাদের দুজনের মধ্যের দূরত্ব একদম অবিকল এক থাকে। ধ্রুবক।

দূরত্ব ধ্রুবক রেখেই ওরা একসময় একটি ঝর্ণার ধারে বসে পড়ে। চারদিকে পাতা খসার শব্দ। ঝর্ণার জলের শব্দ আর পাখির দীর্ঘ শিস। সেই শিসটাই যেন পথের মতো। ওরা হাঁপাতে হাঁপাতে শোনে সেই শিস। আর ভাবে এই পথে যাবার অধিকার তারা হারিয়েছে। এই শিস ধরে হেঁটে কোনদিন তারা সুরের কাছে পৌছতে পারবে না। একজন খুন করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি, এই ব্যর্থতাবোধ নিয়ে কোন সুরের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। সে ঝর্ণার জলে নেমে মিছিমিছি রক্ত ধোয় আর দেখে তার হুডির রঙ সাদা হয়ে যাচ্ছে। আর পালটায় না  রঙ।

দুটি পাথরে গা এলিয়ে ওরা কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। এখনো বেশ দুপুর। সেই বিখ্যাত মৃত শরীরের সামনের লম্বা লাইনের মতো দীর্ঘ দুপুর, শেষ হতেই চাইছে না। এদিকে খরতাপে ফুলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে ।  সেই শুখনো ফুলগুলোই বারবার  হাত বদল হতে হতে মৃতদেহর বুকে রাখা হচ্ছে। মিনিট সাতেক পর পর সেই ফুল  একটা বড় পলিপ্যাকে ভরে ব্যস্ত সমস্ত ভাবে চলে যাচ্ছে কেউ। তার বুকে লেখা আছে শোক বাংলা  ৭০৭ । সবাই তাকে দেখেই বুঝছে সে একজন বড় সড় শোক কর্মী। তাঁর কাজ মৃতদেহ থুড়ি মরদেহর বুকের ওপর থেকে ফুলের ভার কমিয়ে দেওয়া। যত দ্রুততার সঙ্গে যত বিন্ম্রতার সঙ্গে সে ফুল সরাচ্ছে তা দেখে মুগ্ধ শোকার্থীরা। তারা ভাবছে এই শোক মাখা ফুল গুলি কোথায় রাখা হবে, সচেতন শোক  বাংলা নিশ্চয় তা নদীতে ফেলে দূষণ বাড়াবে না কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলে অসম্মান করবে না।তারা ভাবছে কিন্তু দেখতে তো পাচ্ছে না। এই পলিপ্যাকে ভরা ফুলের রাশ চলে যাচ্ছে এই শোক ভবনের পেছনে। সেখানে একটি ছেলে বসে আছে নতুন তোড়া বানাবার জন্যে। এই তোড়া চলে যাচ্ছে সামনে বসা ফুল বিক্রেতার কাছে। শোক বাংলা ৭০৭ আবার চলে যাচ্ছে মরদেহর কাছে। ঝর্ণার জল থেকে ছিটকে আসা ধোঁয়া ধোঁয়া জলকণা দেখতে দেখতে সে বলল ‘আচ্ছা ফুলদের কেমন লাগে কে জিজ্ঞেস করেছে?’

-তুমি কেন খুন করতে গিয়েছিলে?

-আমার মনে হয়েছিল ওই লোকটার কোন অধিকার নেই বেঁচে থাকার। ও অনেকগুলো লোককে, সত্যি বলতে কি একটা গোটা প্রজন্মকে খুন করেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের কোল খালি করে বিদেশে চলে গেছে, যেতে বাধ্য হয়েছে।  যারা জীবনে এক গ্লাস জল গড়িয়েও খায়নি, তারা সেখানে  গিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করেছে, রেস্তরাঁয় ডিশ ধুয়েছে, বরফের চাঙড় ভেঙ্গেছে। যেসব কাজ করার জন্য সাদা চামড়ার লোকদের পাওয়া যাবে না, সেসব কাজ তারা করেছে কারণ তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এখানে কোন চাকরি নেই। শিল্প আমরা হতে দিই নি। এখন শুধু চপ আর বোমা এই  দুই কুটির শিল্প। শিক্ষকরা রাস্তায় বসে আছে, আজকাল ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং তো দূরের কথা ইংরেজি বা সাইকোলজি  এমন সব বিষয়ে অনার্স পড়ার জন্যেও ছেলেমেয়েরা দিল্লি হায়দ্রাবাদ ব্যাঙ্গালোর চলে যাচ্ছে।

-যাচ্ছে তো যাচ্ছে। ভালরা তো চিরকালই বাইরে চলে গেছে। এখন ভালো কিছুর জন্যে সবাই যাচ্ছে। এতে অসুবিধে কোথায়? এই যে তোমার পেছনে দৌড়তে দৌড়তে আমি এই জঙ্গলে চলে এলাম, এই কি একটা চাকরি? বাইরে চলে গেলে রাজার হালে থাকতে পারতাম।

-বাইরে কোন রাজা থাকে না।সেখানে মন্ত্রীরা সাইকেল চড়ে ঘুরে বেড়ায় আর লাইন দিয়ে মাছ আর শাক কেনে। আর সেখানে অফিস করে এসেও নিজের বাসন মাজা, ঘর মছা, রান্না করা, এমনকি বাথরুম পরিষ্কার করা – সব নিজের হাতে করতে হয়। গাড়ি চালাতে হয়। আর তার জন্যে দরজার বরফ নিজেকেই বেলচা দিয়ে সরাতে হয়।

 দুয়ারে বরফ!

এই প্রথম লোকটা অবাক হয়ে গেল । এইরকম  দেশে যাবার জন্যে ছেলেমেয়েগুলো পাগল!  সে কিছুক্ষণ ঝর্ণার জলের উড়ন্ত ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপর সে বলল  দোস্তো, এই একটা ভালো কাজ তুমি করতে যাচ্ছিলে। আর  তার জন্যে তোমাকে আমি তাড়া করেছি। হয়তো গুলি করে মেরেই ফেলতাম। কিন্তু আমার কাছে কোন নির্দেশ আসেনি। নির্দেশের জন্য আমি অপেক্ষা করতে করতে আর খুন করা হল না। তাছাড়া বললে বিশ্বাস করবে না এই প্রথম আমি জঙ্গল দেখলাম ঝ র্ণা দেখলাম পাহাড় দেখলাম, এই প্রথম আমি কাজের জায়গা ছাড়া এলাম অন্য কোথাও। নাহলে আমার সবসময় এই ডিউটি পড়ে। বিখ্যাত মানুষ মারা গেলেই লাশ কভার করো, দেখো কেউ এল কিনা মঙ্গল গ্রহ থেকে মাছি বা মশা।

 

-লাশ না মরদেহ। কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।

লোকটা তার ব্যাগ থেকে প্যাকেট বার করল।

এই যে বিরিয়ানি। খাও। মরার ডিউটিতে, সেতু ভাঙলে, বন্যা বা খরায় সবসময় বিরিয়ানি দেয়।

বিরিয়ানি!

কিন্তু আমি যে সেই  শরীরটা থেকে বেরোতেই পারছি না। সারা শরীর ফুলেঢাকা। ওই ফুল কেউ তুলে নিয়ে যায় নি। ওই ফুল কেউ রিসাইকেল করে ব্যবসা করার সাহস করেনি। কারণ মরদেহ ঢাকতে একটা ন্যূনতম ফুল লাগে। আমি সেটা যদি জানতাম, তাহলে সেই ন্যূনতম ফুল হবার আগেই চলে আসতাম আর সেই ফুলে রেখে আসতাম সময় বোমা। তারপর ধীরে সুস্থে বেরিয়ে এসে, টয়লেটে পেচ্ছাপ করতে করতে বোতাম টা টিপে দিতাম। মরদেহটি টুকরো টুকরো হয়ে যেত আর চারদিকে উড়ে যেত সব। ধোকার টাটি সাজিয়ে মরদেহ নিয়ে শোকের ব্যবসা ঘুচে যেত। লে,  বডিই উড়ে গেছে কোথায় ফুল দিবি? এটা ভেবে আমার যেমন পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছিল তেমনি দুঃখ। আমি পারিনি, একটা ডেডবডিকেও খুন করতে পারিনি, শুধু একটা অংকের হিসেব গোলমাল করে ফেলায়। আমি যদি খানিক আগে পৌছতাম। কাঁদতে কাঁদতে আমি ঝর্ণার জলে নেমে পড়ছিলাম। আমার জামা কাপড় হুডি ছেড়ে জলে নামলাম। আমার নগ্ন চৈতন্যে জল লাগতেই আমার মাথায় এল, আরে, আমার পক্ষে কোনদিন জানা সম্ভব হত না। কারণ ঐ ফুলের মাপ শোক বাংলার তরফে  দেওয়া। ওখানে আমি কেউ না। কিচ্ছু না। আমি যখন স্নান করছিলাম পুলিশ টা বিরিয়ানি খেয়ে হাত ধুতে এল। আর এসেই সে দেখল হুডিটা, রঙ বদলানো হুডিটা। ওর ভারি লোভ হল। ও সেটা পরে ছুটতে লাগল। ছোটার দরকার ছিল না। আমি ওটা আর পরব না ঠিক করে  ফেলেছি। ওটা অপয়া। ওটা পরে কাউকে খুন করাই যায় না।


২.

কমলদা ও রুনুর অশ্রু 

আশিস মিশ্র 


২০১০। এপ্রিল মাস। রাত ১০টার পর ঢাকার মালিবাগের একটি জায়গা থেকে কলকাতা ফেরার বাসটি ছাড়বে। ব্যাগপত্র নিয়ে বাসস্টপে আমরা কয়েক জন অপেক্ষমান ভারতীয়। একটু পরে কমলদা এসেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

 ' কী রে, মেয়েটা অমন কাঁদছে। তোর জন্য!' আমি বললাম, ' হতে পারে '। 

রুনুর চোখে অশ্রু। কেন? এই তো দু'দিনের আলাপ টাঙ্গাইলের কবিসম্মেলনে । সে আরও কয়েক দিন আমাকে তার দেশে রাখতে চেয়েছিল। তাই সেই চৈত্র সংক্রান্তির সন্ধেবেলায় লোকারণ্যের মধ্যে ধানমন্ডি থেকে এসেছিল আমাকে আটকাতে। নিরুপায় আমাকে ফিরে আসতে দেখে কারিতাস গেস্ট হাউসের গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিল অশ্রুভেজা চোখে। কমলদা দেখেছিলেন তাকে। 

আর কোনো দিন কলমদা দেখা হলে সেদিনের ঘটনাটি টেনে জিজ্ঞেস করবেন না, ' কী রে তোর খোঁজখবর নেয়? '  না, নেয়নি!  


দুই গাল পাকা দাড়ি। পরণে ধুতি। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি। কখনো জ্যাকেট। কখনো নেই। কাঁধে ব্যাগ। লক্ষ মানুষের মধ্যে থেকেও ' কৌরব - সম্পাদক ' -কে 

খুঁজে পেতে কারুরই অসুবিধে হতো না। যৌবনের কমল, মধ্য বয়সের কমল, ৭০ দশকের কমলকে দেখিনি। ২০০৩- এর পর বা তারও কয়েক বছর আগের কমল চক্রবর্তীকে দেখেছি মাঝে মাঝে। হলদিয়ায় যেদিন থেকে সারাভারত বাংলা কবিতা উৎসব, পরে বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসব, তারও পরে বিশ্ব বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি উৎসবে কয়েক বার কমলদা হলদিয়া এসেছিলেন। বরাবরই তাঁকে কম কথা বলতে দেখেছি। কিছু তুমুল আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। কখনও তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় একটি লেখাও দিইনি সাহস করে । তবে ' আপনজন ' পুজো বার্ষিকীর সময় হলে তাঁকে লেখা চাওয়া হতো। তমালিকাদির সই করা চিঠি যেত। কখনো কখনো শ্যামলদার হাত থেকে কমলদার লেখা নিয়ে আসতাম। ডিটিপি হওয়ার পর তাঁর গল্পের প্রুফ দেখতে একটু সমস্যা হতো। কেননা কমল চক্রবর্তীর পান্ডুলিপি ও তাঁর লেখার ফর্মটি অন্য কবি ও গদ্যকারের থেকে একেবারেই আলাদা। তাঁর লেখায় যতিচিহ্নের ব্যবহার অনেক। একটি, দুটি বা তিনটি কখনো  ততোধিক শব্দ লেখার পর যতিচিহ্ন। অতএব ঠিকঠাক প্রুফ না দেখলে লেখার ছন্দ বা অর্থ বদলে যেতে পারে, এই ভয় থাকতো। 


২০০৫ সালে হলদিয়ার কবিতা উৎসবের সংকলনটি খুলে বসলাম আজ। সেখানে সংকলিত কবিতাটি পড়া যাক --

ফু--উ --উ--উ! 

কমল চক্রবর্তী 


আলো নিভিয়ে দাও। ওপারের দৃশ্যাবলী ঝাপসা, ঘসা লাগে। / ভাতে পড়ছে শ্যামা -ছোঁচা, ডালে রাত্রি-ভূক। /আলোর সুযোগে কেউটে, বিষাক্ত নীলচিতি, আলমারী, মিটসেফে ঢুকে, ডিম, উষ্ণতা। /

অন্ধকার হোক। / দরজা এপাশ ওপাশ কিছু নেই। / চেয়ার না টুঁটি, বোঝাই যাচ্ছে না। / কখনও সমাধি থেকে ছোট ছোট কুয়াশা- স্কুল, শিশুর -উড়ন্ত হাত পা

শূন্যে বাতাবী, কখনও বিছানা ঢালা গা এলিয়ে দীর্ঘ অজগর। 

এই কবিতার শেষ লাইনটি হলো--


আলো বুঝলে, কোটী কোটী মৃতদেহ না বুঝলে রাতের ক্রিকেট। 


তাঁর কবিতার এই কনটেন্ট ও ফর্মের সঙ্গে পাঠক হিসেবে আমার সেখানে ঢুকতে কোনো অসুবিধে হয়নি। মনে হয় কি এসব এলোমেলো, অসংলগ্ন কাব্যভাষা? না। আসলে কবি কমল চক্রবর্তীর যাপন, সময়, ঘটনার অজস্র ছবি তাঁর চোখের গভীরে যেভাবে ধরা দিয়েছে --সেই সব শব্দপ্রতিমাগুলি এক একটি ইজম। এই যে প্রতিনিয়ত একটা যুদ্ধ --ভেতরে ও বাইরে--সেখানে কতরকম কমল প্রতি মুহূর্তে ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে! তার মধ্যে তাঁর নির্জন, ভালোপাহাড়, বৃক্ষের মায়া --জল গড়িয়ে পড়ছে আজ সমস্ত অনু থেকে, পাতা থেকে! জল নাকি কবির রক্ত? 

বৃক্ষ নাকি কবির শরীর? 

বলতে বলতে ২০২২ সালে ' নতুন কবিসম্মেলন ' শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত কমল চক্রবর্তীর স্মৃতিগদ্য ' নীল কমল লাল কমলের বৈঠকখানা! ' পড়তে বসলাম --

' তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম কবিতার সংগ্রহ। পঞ্চশর। ঠিক মনে পড়ে না। সে গ্রন্থে কে, কে! তখনও আমরা, হাঁটিনি। শুধু কারা যেন ' সত্তর ' দেগেছে। মানে, আমাদের প্রসার প্রচার ভূমি। বুঝেছি, পঞ্চাশ, ষাট শিয়রে। পরবর্তী। নব্বুই প্রস্তুতি পর্ব। অতএব আমাদের রম্যভূমি, মাত্র দশ বছর। এই সংকীর্ণ সময়ে যদ্দূর হাঁটা। খুবই কঠিন। বিশেষ করে, বিহার, লৌহনগরী। সারাদিন। চিমনির ধোঁয়া, হুটারের ডাক, আর স্ল্যাগ- পাহাড়ের চূড়ায় বসে, ' টাটা বাবা '। এহেন নীরব, ধূসর। সেখানে, পদ্য। অমিতাভ দাশগুপ্ত, 

'গল্পকবিতা ', সত্তর নিয়ে প্রথম প্রবন্ধ।' 


আরও একটি প্যারায় চোখ আটকে যায় --

'কবে কোন আদ্যিকালে, শ্যামলকান্তি, সুতাহাটায় ডেকেছিল, কবিতা পাঠে। বিশাল দু তিন দিনের, কবিতা উৎসব। সেই প্রথম সম্ভবত! ভিড়ভিড়। আমি আর, একজন, দিশির ঠেক, বার করে, খেয়ে, সিনেমা দেখে, তবে কবিতা পাড়ায়। সেবারই শ্যামলকে কাছ থেকে। বস্তুত শ্যামল, ' কৃষ্ণ '! টানা টানা চোখ, চওড়া কাঁধ, ষোলো সতেরো, বড় জোর আঠারো। আজ ভাবলে, অবাক, ঐ টুকু ছেলে, কত চিঠি! আর কবিতা!.... ' 

কবিদের রক্তমাংস পর্বে লিখেছেন --

' কখন স্মৃতি -বৃক্ষের ছায়ায়, ধ্যান থেকে নিদ্রায়। চারধারে অরণ্য, পাহাড়- প্রতিম আঁধার ও স্বপ্ন প্রতিম আকাশ। এবং রাবণের সিঁড়ি। নেমে, আমার টেবিলে। ঘোর। এত বন্ধু! এত বড়ো দশক। সত্তর নয়, যেন শতাব্দী। একটা দশক জুড়ে, হত্যা মৃত্যু, বাংলাদেশ, কি নেই। জেলখানা, পুলিশ নির্যাতন। এবং সঙ্গে, সাহিত্য। টোটাল জীবন। দ্রোণাচার্য প্রতিম- বর্ণমালা। ' 


আজ বড়ো বিষাদের দিন! এই অস্থির ও ঔদ্ধত্তপূর্ণ সময়ে, এই মাসে কয়েক জন প্রিয় বাঙালি লেখককে হারালাম! হলদিয়ার কবিতা উৎসবে বিভিন্ন বছরে  যোগ দেওয়া আরও অনেক প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিককে হারিয়েছি গত কয়েক বছরে! চারপাশে গভীর শূন্যতা গ্রাস করছে। কিছুই ভালো লাগছে না। আজ ' বৃক্ষনাথ - কমল ' - এর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহির্বঙ্গের আরও কয়েকজন কবিকে মনে পড়ছে, যেমন বারীন ঘোষাল, পিনাকীনাথ ভাদুড়ি, সুকুমার চৌধুরী... 

তাঁদের  সকলকে ঘিরে কমল চক্রবর্তী একাই একটি পৃথিবীর দীর্ঘতম কবিতা! রুনু কি জানে, আর কখনো কোনো দিন কমলের ছায়া পড়বে না বাংলাদেশে! আজ যদি কমলদার জন্য রুনুর চোখে অশ্রু দেখা দেয় ! 


৩.

বৃক্ষনাথ

শুভঙ্কর দাস 


শিকড়ের দিকে যাত্রা। 

মাটি দিয়ে তৈরি নৌকা,ধুলো দিয়ে মাস্তুল... 


আমি প্রতিটি জন্মে গাছ হবো

হলুদ-পাতায় অতুল! 


তোমরা কবিতা লেখো,আমি গাছ লিখি,

ছায়া আমার মাত্রা, ফুল আমার ছন্দ 

আমি জানি সালোকসংশ্লেষণ পারাপার


আমার বুকের বর্ণপরিচয় 

আমার ভালোপাহাড়।


সবাই চলে গেছে 

কবিতাসভায়,কলকাতায়,সবার হাতে সময়ের উপহার!

আমিও উপহার নেবো,গাছের জন্য... 

তোমাদের কাছে,হে মেঘবর্ণ অরণ্য-আকাশ...


আমি গাছ হয়ে বাঁচতে চাই 


আমাকে দিও শুধু বৃক্ষের বিশ্বাস।

...............................



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪



No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...