আমার ভিতরে একটি শালিক বাস করে
তাহমিনা শিল্পী
দূরে কোথায় কে যেন কাঁদছে!হয়ত আর কেউ নয়,কেবল আমিই শুনছি সেই কান্নার শব্দ।সারা সকাল-দুপুর কাজ করে ক্লান্ত হয়ে,মধ্যাহ্নভোজন সেরে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুমিয়ে পড়বে আরও অনেকেই। তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই।তাই বলে কান্নার শব্দ শুনতে পাবে না?
এতেও বা আশ্চর্য হবার কী আছে? সব কান্না তো সবাই শুনতে পায় না।ওই তো, ওই, আবার শুনলাম। একবার নয়,কয়েকবার শুনলাম।কড়িডোর ধরে হাঁটছি আর ভাবছি।ভাবতে ভাবতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।
কী দেখছি? আদৌ কিছু কি দেখছি? নাকি দেখছি না?
কিছু কি খুঁজছি? নাকি খুঁজছি না?
কারো অপেক্ষায় আছি? কারো কি আসার কথা?
আপাতত এসব নিয়ে ভাবছি না।
আমার কেবল দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।
আমি মিথিলা! বাবার ভালোবাসার বারবি ডল। মায়ের আদরের দুলালী। আর ভাইয়ের স্নেহসিক্ত দস্যি রাণী। সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট,সমাজের তথাকথিত নিয়মের শিকলে বাঁধা এক নারী। আমি, আমার আমিকে প্রকাশ করতে পারি না। কোন কিছুকেই নিজের বলে ভাবতে পারি না। আমাকে আমি বহন করতে পারি না।এমনকি নিজেকে মানুষতো নয়-ই, একজন নারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না।অমুল্য এই জীবনকে আলোয় আনতে পারি না।
আমি শুধু নিজেকে একটু একটু করে আরো অন্ধকারে ধাবিত করতে পারি।ভালোবেসে তোমাদের ভালো-মন্দের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারি।তোমাদেরকে সম্মানিত করতে নিজের আত্মসম্মান বিলিয়ে দিতে পারি।আর পারি বেলাশেষে অলস দুপুরে,বিষন্ন বিকেলে,কিংবা নির্ঘুম মধ্যরাতে নিজের সাথে কথা বলতে।মনের ইচ্ছে গুলোর জাবর কাটতে।
এই আমি মানে আমরা,নারীরা।দিন শেষে সখিনা, নোরা, দীপালী কিম্বা মিথিলা সবাই আমরা এক। আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা নারী।আমরা পারি না মানে, আমাদেরকে পারতে দেয়া হয় না। তুমিই আমাদেরকে দাবিয়ে রাখো। তুমি মানে পুরুষ! তুমি সমাজপতি।তাই সব নিজের বলে ভাবতে পারো।নারীকে তোমার দখলে রাখতে পারো।
জীবনই আমাকে চিনিয়ে দেয় অন্দরমহল।প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেয়,আমার আমিত্ব থাকতে নেই! আমাকে শিখিয়ে দেয় আমি নারী,মানু্ষ নই।চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই যে পুরুষ!এরা সমাজপতি। স্বামী তোমার পরমেশ্বর! তোমার উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার।সে যেমন ইচ্ছে,তোমাকে চাইতে পারি।যেমন খুশি চালাতে পারে।তোমার সকল সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে।বিদ্যা বুদ্ধি যতই থাকুক,বিনাবাক্যে তোমাকে সব মানতে হবে।
এভাবেই রোজ মিথিলার নিজের সাথে নিজের কথোপকথন চলে।এভাবেই নিজেকে দেয় সামান্য সময়।নিজের সাথে সব ভাললাগা,মন্দলাগার সহবাসে কাটিয়ে দেয়া এক জীবন।
একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করতাম।ভালো বেতন।বছরে তিনটে ইনক্রিমেন্ট।কিন্তু বিয়ের পর কেউ আর চাইলো না আমি চাকরিটা কন্টিনিউ করি।ফুল টাইম বাড়িতেই থাকি।হোম মেকারের ভূমিকায় অভিনয় করি।হাড়ি-কড়াই ধুঁই, ঘর ঝাড়ু দেই, কাচাকুচি করি, ঘর গোছাই, বারান্দাবাগানের গাছগুলোতে দুইবেলা জল দেই, আগাছা পরিষ্কার করি, রান্নাবান্না করি, বেড়েকুড়ে খাওয়াই।শশুর-শাশুরির সেবা করি।ছেলেকে পড়াই,হোমওয়ার্ক করাই।এসবের ফাঁকেফোঁকরে এদিক-সেদিক নিজের জন্য একটুখানি সময় খুঁজি।মন ভালোর অনুষঙ্গ হাতরে বেড়াই।
আমার ফ্ল্যাটের দক্ষিণ ও পশ্চিমের বারান্দা দুটো একান্ত আপন হয়ে ওঠেছে।পশ্চিমের বারান্দায় আমার প্রিয় গাছগুলোর সাথে আত্মীক সময় কাটাই। এই বারান্দা থেকে দেখা যায় অজস্র পাখির মেলা।তারা ভোরে জেগে উঠে গান শোনায়।সন্ধ্যে নামার আগে বেশ অনেকক্ষণ আকাশচুম্বী দালানগুলোর ছাদ,চিলেকোটা ছুঁয়েছুঁয়ে ডানার গানে বাতাসে মায়া ছড়িয়ে গৃহবাসী হয়।
দক্ষিণের বারান্দার দুইদিকে রাস্তা,সামনের দুটি প্লটে এখনও বাড়ি ওঠেনি,তুলনামুলক উন্মুক্ত।এখান থেকে পথচারী, হকার, ফেরিওয়ালা, সবজিওয়ালা সহ নানান কিসিমের লোকের দেখা পাই।বিকেলের আকাশে বেশ কয়েকটি ঘুড়ি ওড়ে।কোন কোন বাড়ির ছাদে ছেলেমেয়েরা কিচিরমিচির করে।এইসব দেখতে আমার ভারী ভালো লাগে।
গত কদিনে অবশ্য আমার বিনোদনটা একটু ব্যতিক্রম।ভালো হয় যদি বলি,আমার হারিয়ে যাওয়া দিনের রূপকথার গল্পেরা নতুন সংস্করণে ধরা দিয়েছে আমার চোখে।
আমার ফ্ল্যাটের ডানদিকের বাড়ির তিনতলার পনের/ষোল বছর বয়সী মেয়েটি খানিকক্ষণ পরপর বারান্দায় আসছে।এলোমেলো হাত নাড়ে,অকারণে হাসে,গ্রিল ধরে দোল খায়।তার হাতের ইশারা সামনের বাড়ির খোলা জানালায়।সেখানে কয়েকজন ব্যাচেলর ভাড়া থাকে।তাদেরই একজন তার হাসির প্রতিউত্তর দেয়, হাত দিয়ে টেলিফোনের ইমোজি দেখায়, উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দেয়।
এই দৃশ্য আমার ভালো লাগে।এসব মন্দ নয়।বয়সের সৌন্দর্য।বহুদিন এমন দৃশ্য দেখিনি।আবার কখনও দেখতে পাবো ভাবনার বাইরে ছিল।ফেসবুক,ইন্সট্রাগ্রামের যুগে এসব কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।নতুন প্রজন্মের কাছে এগুলো তো ব্যাকডেটেড ট্রেন্ড।তাহলে ওরা কেন চর্চা করছে! এই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে মুগ্ধতা আমাকে ঘিরে ধরে।ওদের মাঝেই ফিরে পাই আমার স্মৃতিগন্ধা স্বর্ণবিকেল।
রাজকন্যা রাপুনজেলের মত দীঘল কালো কেশ নেই,ছিল না কোনকালে।কোন ডাইনিবুড়ি বন্দি করে রাখেনি দূর বনের দরজা বিহীন আকাশচুম্বি কোন ঘরে।চুল বেয়ে উদ্ধার করতে আসেনি পথভোলা কোন রাজপুত্তুর।
তাই বলে কি ছাদে গিয়ে চুল শুকোতে মানা? একদম না।
রোজ বিকেল হলেই ছেলে-বুড়ো সবাই দলবেঁধে ছাদে উঠতাম।মহল্লার সবগুলো ছাদের ছিল একই চিত্র।এবাড়ি-ওবাড়ির আন্টি,চাচীরা আচার-চাটনি বানানোর আলোচনা করতেন।নতুন শাড়ি-গয়নার গল্প করতেন।কিশোর-কিশোরীর দল হৈচৈ করে ঘুড়ি উড়াতো।পুচকোরা ছাদময় ছুটোছুটি করতো।আর সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বড়আপু-ভাইয়ারা চোখেচোখে মনের ভাব প্রকাশ করতো।কখনও আবার একছাদ থেকে অন্যছাদে ঢিল ছুড়ে পাঠাতো চিরকুট।
একদিন এক ঢিলকাব্য উড়ে এলো আমাদের ছাদের ঠিকানায়।সদ্য কৈশোর পেরুনো আমরা প্রায় সমবয়সী তিনকন্যা গল্পে মশগুল।লক্ষভ্রষ্ট ঢিলটি গিয়ে পড়লো দোতলার চাচীর পায়ে।সেকি রক্তারক্তি কাণ্ড!কোন বাড়ির ছাদ থেকে এসেছে ঢিল,কাকে পাঠিয়েছে এসব বোঝার আগেই চাচীর চিৎকারে সব ছাদের বড়ভাইয়েরা এক নিমিষেই লাপাত্তা।আর চাচী বকতে বকতে বর্ষার গতিতে চিরকুট সমেত ঢিলটি ছুড়ে দিলেন শূণ্যে।ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে তার শেষকৃত্য হলো ড্রেনের পচা জলে।
আমাদের সমবেত হাসির ঢেউয়ে দুলে উঠেছিল আকাশ।
আমার জীবনেও একদিন রাজপুত্তুর এলো।বাবার পছন্দ করে দেয়া রাজপুত্তুরের সাথে আমার দেখা হল বিবাহ আসরে।কথা হল,একেবারে বাসরঘরে।
প্রতিটি দম্পতির বাসরঘরের কিছু পুতুপুতু গল্পের স্মৃতি থাকতে হয়। মুলত ওটা দাম্পত্য জীবনের চমৎকার শুভারম্ভ।যেমন, তখন শ্রাবণ মাস। আমাদের বিয়ের রাত।সন্ধ্যা থেকে একটানা বৃষ্টি ঝরছে।বাড়ির সামনের রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে গেছে।অতিথিদের অনেকেই জল ভেঙে বাড়ি ফিরতে পারেনি।গোটা বাড়ি জুড়ে আনন্দের শোরগোল।ভীড় সামলে রাত একটায় তুমি বাসরঘরে এলে। বললে- বৌরাণী, একদিন এইরকম বৃষ্টিতে আমরা সমুদ্রস্নান করবো।
যেন তুমি অবধারিতভাবেই জানতে সমুদ্র এবং বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়।আমি রোমাঞ্চিত হলাম।হঠাৎ দমকা বাতাসে যেমন করে ফুল ঝরে পরে আমিও তেমন করে এক পলকে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম।
আমাদের শ্রাবণ মাসেই বিয়ে হয়েছিল।সে রাতেও বৃষ্টি ঝরেছিল খুব।অথচ বাসরঘরের পুতুপুতু কোন গল্পের স্মৃতি নেই।এখনও স্পষ্ট মনে আছে,ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রথমেই তুমি বলেছিলে- তোমার একটাই চাওয়া।এখন থেকে বাবার বাড়ির কথা ভুলে গিয়ে আমি যেন তোমার, তোমার বাবা-মা,দাদী আর ছোটবোনের মনের মত হয়ে উঠি।কখনও কারও কথার অবাধ্য না হই।সবার প্রয়োজন,ভালো-মন্দের খোঁজ রাখি।
একবারও বলোনি,আজ থেকে এটাই তোমার বাড়ি।যদি বলতে তাহলে এবাড়িটা আমাদের হত।আমরা সবাই সুখে দুঃখে পারস্পারিক নির্ভরশীলতায়, সহযোগিতায় বাড়িটাকে স্বর্গোদ্যান বানাতাম।তবুও আমি তোমাদের সবার মনের মত হয়ে উঠেছি।তোমাদের বাড়ির যোগ্য বৌ হয়েছি।সকলের প্রিয় হতে পেরেছি।তোমার অহংকারের কারণ হতে পেরেছি।
শুধু আমি এখনও তোমাদের হতে পারিনি।
আমি আমারও হতে পারিনি।
যখন রোজ স্নানঘরে শাওয়ারের জলে আমি বৃষ্টিস্নানের স্বাদ নেই।ঘুমোতে যাবার আগে পর্দা টেনে দেবার ছলে এক ঝলক আকাশ দেখে নেই।তখন আমি আমার হয়ে উঠার ভান করি।
হ্যাঁ,আমি নারী।আমি মিথিলা বলছি।আমি-ই বাবার আদরের বারবিডল, মায়ের পাগলি মেয়ে,ভাইয়ার দস্যিরাণী।একদিন যেই আমি সারাক্ষণ বকবক করে বাড়ির সবাইকে অস্থির করে রাখতাম।আজ তার কথা শোনার কেউ নেই।এবাড়ির সবাই যখন দুপুরের খাবারের পর ভাতঘুমে অচেতন থাকে।তখন চুপিচুপি বাবার কিনে দেয়া সেই ছোট্ট নূপুরের গায়ে হাত বুলাই।আর নিজের সাথে অনবরত কথা বলে যাই।
মাকে বলি,তুমি শিখিয়েছিলে দিনের বেশিরভাগ সময় মেয়েদের চুলোর কাছাকাছি থাকতে হয় তাই সংসারের উত্তাপ তাদের পোড়াতে পারে না।যদি না শিখাতে হয়ত জীবনটা অন্যরকম হতো।কেবল নাকফুলের মায়ায় রোজ বেঁচে থাকতে হতো না।
ভাইয়া,সবসময় তোর জিনিসে জবরদস্তী ভাগ বসাতাম বলে বলতি,কবে যে তুই বিদায় হবি।যদি তোকে ওভাবে না রাগাতাম।তাহলে হয়ত আজ শিকড়হীন হতাম না।
বাবা,আমার ছোট্টছোট্ট পায়ে যে নূপুরটা তুমি পরিয়েছিলে।যেই নূপুরধ্বনি তোমাকে আনন্দের জোয়ারে ভাসাতো।আজ সেটাই অদৃশ্য বেড়ি হয়ে আমায় বেঁধে রেখেছে।
কতদিন বাড়ি যাইনি,দেখিনি তোমাদের।
প্রিয় নদী,কতদিন শুনিনি তোমার জল কলরব।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সবুজ ডিম লাইটের আলো অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠে।ঘরের সবকিছু তখন স্পষ্ট দেখা যায়।আমার বুকসেলফে রাখা ঘুম-অঘুম ও দুঃস্বপ্নের গল্পটি কথা বলে ওঠে।বলে,বলতে পারো-অসুখ করে কেন? স্বপ্নেরা আগুন হয়,হৃদয় পোড়ায় কেন?
মাথার উপর জোরে শোঁ শোঁ করে ঘুরতে থাকা সিলিংফ্যানটার দিকে আমি নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকি।কিন্তু, ফ্যানটাকে সিনেমার স্লোমোশান দৃশ্যের মত লাগে।আমি ঘামতে থাকি, ঘেমে নেয়ে চুপচুপে হয়ে যাই।
স্বপ্নটা প্রায়ই দেখি। আজও দেখলাম।প্রতিবারই স্বপ্নের একই জায়গায় এসে ঘুমটা ভেঙে যায়।ঘুম আর স্বপ্ন দুটোই ভেঙে গেলে ঢকঢক করে এক বোতল জল খাই।পাশ ঘুরে তোমাকে দেখি।বিকট শব্দে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছো।আমি উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই....
ব্যালকনিতে জেগে থাকা নিঝুম রাতের মন কেমনিয়া সময়ে হঠাৎ প্যাঁচার ডাক ভীষণই এলোমেলো করে দেয়।যেন পুকুরের শান্ত জলে কেউ একটি ছোট্ট ঢিল ছুড়ে দিলো।আর জলে ভেসে থাকা পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে সেই জলে বাড়িয়ে দিলো ঢেউয়ের দোলা।অমনি আমি ঘষেমেজে স্মৃতিকে চকচকে করতে লেগে গেলাম।
বর্ষায় যৌবনপ্রাপ্ত জল থৈথৈ কুমারনদটা ফুলে-ফেঁপে উঠলে তার রূপসৌন্দর্য অনেকটাই বেড়ে যায়।আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরের বাজারের ঠিক মাঝ বরাবর সোনালী ব্যাংকের পাশ ঘেষে যে সরু রাস্তাটা এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে নদীর দিকে তার শেষ মাথায় নৌকো ঘাট।প্রায় গোটা তিরিশেক নৌকো বাঁধা থাকে ঘাটে।কোনটি খেয়া পারাপারের,কোনটি পাট বোঝাই,কোনটি আবার দূর গায়ের যাত্রী পরিবহণের।
মাঝি,খালাশিদের হাঁকডাক, লোকের যাওয়া-আসা, শোরগোলে ব্যস্ত ঘাটটির এককোণে বড় দুটো সিমেন্টের চাঈয়ের উপর বসে থেকে প্রায়ই এই দৃশ্য দেখতে দেখতে যখন মন হারাতো।তখন একজন আমার মনের কথা বুঝতে পারতো।
আমার মেজমামা।শান্ত স্বভাবের ঘরকুনো লোক।বন্ধুবান্ধব খুব একটা ছিল না।বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতো।কাছাকাছি বয়সের না হলেও আমাদের দারুণ বন্ধুত্ব।বেড়াতে যাওয়া, মেলায় যাওয়া, সার্কাস-সিনেমা দেখার মত শখগুলো মেজমামার আস্কারাতেই মিটতো।ঠিক সেভাবেই আমার নৌকাভ্রমনের শখটাও মিটতো মেজমামার বদৌলতে।
নৌকা রিজার্ভ করে আমরা ঘাট থেকে অনেকটা দূরে নৌবন্দর টেকেরহাট পেরিয়ে সেন্দিয়াঘাট পর্যন্ত যেতাম।সে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পথ।নদীতে তখন বেশ শুশুক দেখা যেত।স্রোতের উল্টো দিকে তারা চকচকে কালো পিঠ উঁচিয়ে ডিগবাজি খেতো।একটা, দুটো,তিনটে.....আমি গুনতে থাকতাম কয়টা শুশুক দেখতে পেলাম।কোনটা কতবার ডিগবাজী খেলো... কোনটা বেশি চঞ্চল... এইসব দেখতে দেখতেই আমরা সেন্দিয়া পৌঁছে যেতাম।
সেন্দিয়াঘাটের দুইদিকে কুমার নদ।একদিকে নালাখাল।অনেকটা দ্বীপের মত।আমার যখনই ওখানে যেতাম,মামার কাছে জানতে চাইতাম সেন্দিয়া নামের রহস্য কি? কেন এই জায়গার নাম সেন্দিয়া হল?
মেজমামা প্রতিবারই নতুন নতুন গল্প বানাতেন এর নামকরণের।এরমধ্যে আমার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল যে গল্পটি সেটি হল- নাবিক সিন্দবাদ একবার এই পথে যাচ্ছিল।তখন একটি শুশুক জাহাজের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে পথ আটকে দিলো।সবাই মিলে খুব চেষ্টা করেও কোনভাবেই শুশুকটাকে সরাতে পারেনি।অগত্যা সিন্দাবাদ এই ঘাটে নোঙর করেছিল।তখন থেকে এর নাম সিন্দাবাদের ঘাট হয়ে গেলো।কিন্তু মানুষের মুখেমুখে পরিবর্তণ হতেহতে এখন এর নাম সেন্দিয়াঘাট।
সেন্দিয়ার পূর্বপাশের নালাখালে নৌকো থামলে সিঁড়িপথ বেয়ে উপরে উঠে গেলেই চমৎকার সানবাঁধানো ঘাট।পাশেই বুহুদিনের পুরনো বটগাছকে ঘিরে হাঁট।সেখানে নানারকমের সওদা নিয়ে আসতো লোকে।বেঁচাকেনা শেষে সন্ধ্যায় ফিরতো নিজ নিজ গাঁয়ে।
আমরা একটা রেঁস্তোরায় বসতাম।গরমগরম দানাদার,মুচমুচে নিমকি,আর মালাই চা খেতাম।তারপর সাপ আর বানরের খেলা দেখতাম।কোনকোন দিন টগিও দেখতাম।খেলনা কিনতাম......
আজ সময়ের পরিহাসে বদলে গেছে আমার জীবন নদীর বাঁক!
উত্তর দিক থেকে হু হু করে উড়ে আসে একরাশ হিম বাতাস।
শান্ত বাতাসে মায়ের বুকের গন্ধ পাই।মায়ের কথা স্পষ্ট শুনতে পাই।অনেক দূর থেকে মা ডেকে বলছে,জেগে ওঠ মিথিলা।মিথিলা জেগে ওঠ।জেগে ওঠ...
আমি জেগে উঠি।
সেদিন থেকেই বুঝলাম অস্পষ্ট ছায়াকেই তোমরা আমি ভাবো।সেদিন থেকেই পুরনো পারদ উঠে যাওয়া আয়নায় নিজের মুখখানা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখি।একবার দুবার নয়,বারবার দেখি।
প্রতিবারই দেখি, আমি একটা জলজ্যান্ত মানুষ!
এখন আমি বুঝে গেছি,আমাকে ঝাপসা ছায়া রূপে দেখতেই তোমরা আনন্দ পায়।চকচকে আমিটাকে তোমরা ভয় পাও। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবো।
আমার ভিতরে একটি শালিক বাস করে।একটি খয়েরী রঙের শলিক।তার ডানার পালক অনেকটাই শক্ত।বহুদিন তার সাথে আমার দেখা নেই।কিন্তু এখন সে আবার ফিরে এসেছে।সেদিন থেকে আমি বুঝতে পারলাম অন্যের সুখের জন্য নিজের বিশ্বাসকে ছাইয়ের মত উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
ঠিক সেদিনই,সেই মুহূর্তেই শালিকটি ফিরে এলো।এখন সে তোমাদের দেখলেই কর্কশ স্বরে হাসে।অট্রহাসি......
শালিকটি যত জোরে হেসে ওঠে,আমার অবয়ব ততই স্পষ্ট হয়।
এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক!
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment