বাগদি চরিত
লেখক- শ্রীজিৎ জানা
আলোচক-গুরুপদ মুখোপাধ্যায়
শ্রীজিৎ জানার বাগদীচরিত প্রথম পর্ব থেকে উনষাট পর্ব পর্যন্ত একটানা পড়েছি। উনষাট সপ্তাহ মানে এক বছর দুমাস তিন সপ্তাহ ধরে লেখা। দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক উপন্যাসটি জ্বলদর্চি ওয়েব ম্যাগে বেরিয়েছে। অনেকটা নামকরণ ও আঙ্গিদের ক্ষেত্রে 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' এর আদলে লেখা একটি আঞ্চলিক উপন্যাস। প্রথমত একে কি আঞ্চলিক উপন্যাস বলবো? আঞ্চলিক উপন্যাস কাকে বলে? আঞ্চলিক উপন্যাস একটি বিশেষ ভূখণ্ডে, একটি বিশেষ জনজাতির জীবন, সংস্কৃতি, লোকাচার ও সম্পর্কের কাহিনী। তাদের ভাষা নিজস্ব। সেই অর্থে এটি একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। আবার অন্যদিকে ঢোলের এই জনপদে কিন্তু শুধু বাগদি নয়, অন্য জাতির বসবাস আঞ্চলিকতার মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে। হোসেন মিয়াদের মত অন্য জাতির মানুষ পরিযায়ী হিসেবে আসতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট জাতির বসতি অঞ্চলে অন্য জাতির বাস আঞ্চলিক উপন্যাসে থাকতে পারেনা।
উপন্যাস কাকে বলব? উপন্যাস মানে উপন্যস্ত বা ব্যাপন। যা কথার মাধ্যমে, গদ্যের মাধ্যমে, পাঠকের কাছে পরিবেশন করা হয়। হিন্দিতে বলে কঁহানি বা কাঁহানী।সেদিক থেকে উপন্যস্ত ঠিকই করেছেন। কিন্তু তার মাঝেও কিছু ফাঁকফোকর থেকে গেছে। কারণ উপন্যাসে যে টান বা চোরাস্রোত থাকে তা কিঞ্চিৎ বাধার সৃষ্টি করেছে। এপিসোড বা সাবপ্লট গুলি নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখকের আরো বেশি সচেতন হওয়া জরুরি ছিল। কিছুটা খাপছাড়া হয়েছে উপন্যস্ত রূপ। মাঝে মাঝে কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে সরে গেছে গল্পের প্লট। গল্পের মধ্যে টান বা স্রোত জরুরি। লেখক হয়তো শ্বাসরুদ্ধকারী অবস্থা থেকে বেরোনোর জন্য মোক্ষণ (cathersis) দিতে চেয়েছেন।
গল্প লিখতে বসে লেখককে একটি নির্দিষ্ট প্লট নির্বাচন করতে হয়। আঙ্গিকগত সৌকর্যের দিক থেকে লেখক কল্পনা ও বাস্তবের পোঁচ দিতে থাকেন। শ্রীজিৎ জানা সেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট জনজাতির গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনকে বেছে নিয়েছেন। তাদের লোকাচার, যৌনতা ও ভাষার পূর্ণ ব্যবহার করেছেন। উপন্যাসে দু ধরনের চরিত্র থাকে। কেন্দ্রীয় বা মুখ্য চরিত্র। দুই পার্শ্ব বা গৌণ চরিত্র। গল্পের প্লটের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় প্লট ও সাবপ্লটের নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু অনেক ছোট ছোট নদী, নয়ানজুলি মিলে যেমন একটি বড় নদী হয়ে মোহনাতে মিশে, উপন্যাসও ঠিক তাই। এতে গল্পের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। মোহনা হল সেই বৃত্ত। লেখক অনেকগুলি সাবপ্লট এনেছেন। যার মধ্যে কিছু সাবপ্লট অসংগতির আভাস দেয়।
'বাগদি চরিত'এর কেন্দ্রীয় চরিত্র খগেন মাস্টার ও মাধু। তারা দুজনেই বাগদি জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছে। সমান্তরাল চরিত্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে লোখা। লোখাকে ঠিক পার্শ্ব চরিত্র বলা যায় না। লোখা খগেন মাস্টারের বিপরীত প্রতিরূপ, ছায়া সঙ্গী। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে এসেছে সুবল, ময়না, সাগরি , আরতি ভবতারণ প্রভৃতি আরো অনেকের নাম। কিন্তু কাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রকৃতি,কাঁসাই, শিলাই। সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতির অপরূপ রূপ হলো চঞ্চলা বা নারী। ঢোল,কালসাবা এবং এখানের চরিত্রগুলি নিয়তির নিয়ন্ত্রণাধীন। এখানে লুকিয়ে রয়েছে ঢোলের জিওন কাঠি। তবে বাগদি জাতির উৎস সন্ধানে বেরিয়ে লেখক কাহিনীকে বিন্যস্ত করে করতে গিয়ে তা অভিকেন্দ্র বা অপকেন্দ্র বলের টানাপোড়নে কেন্দ্রাতিগ হতে চেয়েছে। এটা উপন্যাসে কাম্য নয়। যেখানে গল্প অনেক সময় মূল থেকে সরে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বৃত্তে ঢুকে পড়েছে।
খগেন মাস্টার ও মাধুর জীবনপ্রবাহের মাঝে যে চোরাস্রোত ঢুকে পড়েছে তা লেখককে বারবার উতলা করেছে। প্রকৃতি এখানে জীবন্ত। সে-ই নিয়ন্ত্রক। তার উপরেই নির্ভর করে আছে ঢোলের জীবন। নদীমাতৃক বাংলায় গঙ্গা, পদ্মা,তিতাস, সুবর্ণরেখার মত উপন্যাসের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে কাঁসাই ও শিলাই। ঢোল এখানে নিয়তি বা উপলক্ষ্য মাত্র।
তবে সার্বিক বিচারে একে আঞ্চলিক উপন্যাস বলা যায়। কারণ ঢোলে অন্য জাতির বাস থাকলেও তারা সক্রিয় নয়, অন্যদিকে মানিকের 'পদ্মা নদীর মাঝি' অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম', সমরেশ বসুর 'গঙ্গা' বা নলিনী বেরার 'সুবর্ণরেনু সুবর্ণরেখা' আঞ্চলিকতার গণ্ডি অতিক্রম করেও যেভাবে আঞ্চলিক উপন্যাস,সেই অর্থে শ্রীজিৎ জানার 'বাগদি চরিত' একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। এখানে সার্থকভাবে বাগদী জনজাতির লোকাচার, ভাষা, সংস্কৃতি, অনার্য দেবদেবী, বিবাহ, কলহ, পড়শিকলহ, পরকীয়া , সন্দেহ, অবিশ্বাস সবকিছুই সার্থকভাবে উঠে এসেছে। এটি গুণময় মান্নার 'মুটে' উপন্যাসের মতো কালজয়ী তকমা পেতে পারে। এখানে একজন লেখকের শ্রমের সার্থকতা। উৎসুক পাঠকের চেতনার শিকড়েও জল দেবে।
কালসাবার মাঠ ও কাঁসাই শিলাই এর রুপাোলি শস্যের মধ্যে রয়েছে ঢোলের খিদের তালিকা। আর সন্ধ্যে নামলে ক্লান্ত শরীরে যৌন আকাঙ্ক্ষায় এদের চোখগুলো চিতা বাঘের মতো জ্বলজ্বল করে। এখানে রয়েছে জাতিদ্বন্দ্ব ঝগড়া বিদ্বেষ ঈর্ষা প্রভৃতি। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে এরা টোটাল ইউনিট। এরা মুখ্য সুখ্য হলেও এরা দুই খিদের মাঝে জীবনকে খুঁজে বেড়ায়। রাতের অন্ধকারে আরতির ভাসুর খুদা তার একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে আগড় ঠেলে মাঝরাতে ঘুমন্ত অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরক্তিম আরতি লজ্জায় তা কাউকে বলতে পারেনা। আবার ময়না সারাদিন লোখার সঙ্গে ঝগড়া করলেও, লোখা যখন তাকে বুকের মাঝে টেনে নেয়, তখন ময়নাও ও সাপের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই হয়তো খগেন মাস্টার বারবার হেরে গিয়েও জিতে যায়। মাঝে শুধু বাগদী জাতির শিকড়ের সন্ধান টুকু বাদ দিলে একটা চোরা টান ঘিরে থাকে এই রক্তমাংসের মানুষ গুলোকে। এখানে অভাব আছে, দারিদ্র্য আছে, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত আছে, আবার শিলাইয়ের জলে পানসি ভাসিয়ে দেওয়ার মত রোমান্টিক জীবনও আছে। দ্বন্দ্বের অবসান হতে চায় না। এক দ্বন্দ্ব অন্য দ্বন্দ্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। যুগ যুগ থেকে রাজা রাজড়া আর জমিদার জোতদার ব্রাহ্মণ ও অভিজাত সম্প্রদায় ও বর্তমানের রাজনৈতিক দলগুলি এদের ছোট জাত বলে দাগিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এসেছে। লেঠেল হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। তাই হয়তো লেখক অপ্রাসঙ্গিক হলেও বাগদি জাতির শিকড়ের অন্বেষণ করতে চেয়েছেন।
যদিও মাধু ও খগেন মাস্টার দূরে দূরে থেকেছে, শশীডাক্তার- কুসুম, বা পাভলব- শাশার মত, যেখানে শূলের মতো দাঁড়িয়ে আছে সমাজ। যে সমাজ দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল উপীন ও কিরণময়ীর জীবনে। কিন্তু ফল্গু স্রোত মাধু ও খগেনের জীবনে চরের মতো বিষন্নতা (saddestic love) ছড়িয়ে রেখেছে। তাকে শিলাই বা কাঁসাইয়ের কোটালও ধুয়ে দিতে পারেনা। তাই যখন শেষ পর্বে এসে মাধু তার সন্তানের ভার খগেন মাস্টারের হাতেই দিতে চায়, তখন মনে হয় নারীর অন্তঃসলিলা স্রোত দ্বিরূপী--প্রেমিকা ও মাতা। যেন এক মাতারূপী প্রেমিকা এসে দাঁড়িয়েছে পাবলভ অথবা শশী ডাক্তারের মত প্রেমিকের কাছে। এ যেন শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের রমা রমেশ এর মত। রমাও শেষ পর্বে এসে নাবালক ভাইয়ের দায়িত্ব রমেশের হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রেমের বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। জেঠাইমার সাথে কাশি চলে যেতে চেয়েছে। আর এখানে মাধু অন্তর্লোকের চোরাবালির গহীনে হারিয়ে যেতে চায়। আজ মাধুর কাছে সমাজের চোখ রাঙানি লোকলজ্জা নেই। খগেন মাস্টারকে সে আত্মকেন্দ্রিকতার গর্ত থেকে টেনে বের করে আনে। মুখোমুখি দাঁড়ায় 'শেষের কবিতা'র লাবণ্য ও অমিতের মতো। 'ঘরে-বাইরে'র নিখিলেশ সন্দীপ বিমলার মতো।
তারা জীবনকে দেখেছে, চিনেছে, শেষে জয় ছিনিয়ে এনেছে। একটা সময় এসে তারা প্রেমকে উপলব্ধি করে। শরীর প্রেমের অঙ্গ হতে পারে, সর্বস্ব নয়। তারা ভেবেছে বড় প্রেম এভাবেই হয়তো দূরে ঠেলে দেয়। এ প্রেম রবীন্দ্রনাথের স্বভাববৈরাগী, সে পথের ধারে ধুলার পরে আপনার অজস্র ফুল ফুটিয়ে দেয়, বৈঠকখানায় টিনের টবে ঐশ্বর্য মেলতে পারে না। দূর থেকে মাধু ও খগেনের যে টানাপোড়েন সেখানে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে লোখা। তাই লোখা প্রতিদ্বন্দ্বী বা পার্শ্বচরিত্র নয়, সে সমান্তরাল।
এখানেই লেখকের শিল্পচাতুর্য ধরা পড়ে।শেষে বিষন্নতা থাকলেও নতুন দ্বন্দ্ব যেন মোক্ষণ বা cathersis এনে দেয়। পাঠকের চেতনায় লেখক ইমেজিস্ট। উপন্যাস যেন চিত্রশালা। উপন্যাসটি সময়ের জীবন্ত দলিল, যা দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানে। চরিত্রগুলি যেন বনবেলা হয়ে সৌন্দর্য ও সৌগন্ধ দান করেছে। আর্ট (Art) এখানে শিল্প ও মানুষের জীবনের ভাষ্য রচনা করে। এখানে নারী পুরুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন নয়, নতুন দ্বন্দ্ব কামগন্ধহীন অরণ্যে নিয়ে যায়। এখানে অর্জুনের মতো মাছের চোখ দেখি।শরীর গৌণ হয়ে যায়। মাধু - খগেনের প্রেম শরীর ছাড়িয়ে কাম গন্ধহীন নিসর্গলোকের যাত্রী। আর বাজে সুর -
"কতদিন পর বঁধুয়া এলে
দেখা না হইত পরান গেলে।"
প্রচ্ছদ - আরাধ্যা জানা
সর্বনাশ , এতো সুন্দর ভাবে যে বিশ্লেষণ করা যায়
ReplyDeleteতা
এক নিঃশ্বাসে শেষ না করলে বুঝতেই পারতাম না
প্রসাদ পাঠক 👌