তৃষ্ণা বসাকের “চরের মানুষ”
(দেশ ও দ্যাশের মাঝে একটুখানি আশ্রয়ের খোঁজ)
আলোচক- রক্তিম ভট্টাচার্য
‘দেশভাগ’ – শব্দটার মধ্যে একটা অদ্ভুত শিহরণ আছে। শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাওয়া হিমস্রোত আছে। কালের পলিগর্ভে জমে থাকা ইতিহাস আছে। অতীতের চাবুক আছে, ঘাম-রক্ত মিশে একাকার হয়ে আছে। শ্রীজাত লিখেছিলেন, “পায়ে পায়ে হেঁটে গেলে পৃথিবী তোমার, আর সীমান্ত পেরোলেই দেশ”। আসলে সেও এক ভৌগোলিক ব্যাখ্যা। ভূগোলের ভাষায়, সত্যিই আমাদের পৃথিবী এক বিরাট শরীর। একেকটা মহাদেশ-দেশ তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। গায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে অজস্র জীবাণু – যাদের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে কারোর সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু এই অঙ্গকেই যদি মাপে মাপে ভাগ করে দেওয়া হয়? ছিঁড়ে নেওয়া হয় একেকটা টুকরো? রক্তের মেজাজি ফোঁটায় কান্নার রঙ মিশিয়ে দেওয়া ছাড়া গতি থাকে না। কী হয় সেই জীবাণুদের? কোথায় যায় তারা? আদৌ কি তাদের আর শিকড়ে ফেরার কোনও সম্ভাবনা থাকে আজীবন?
এই চিরাচরিত প্রশ্ন তুলেই তৃষ্ণা বসাকের আখ্যান, “চরের মানুষ”। বস্তুত, দেশভাগ এমনই এক মর্মান্তিক বিষয়, তা নিয়ে যতই লেখা হোক, ভাঁড়ার যেন পূর্ণ হয় না। আর বাংলা সাহিত্যে এবিষয়ে আখ্যানের সংখ্যা নেহাত কম নয়ও। তৃষ্ণা বসাকের এই উপন্যাস এই গোত্রে এক নতুন সংযোজন তো বটেই, আর তার সঙ্গে সেই উত্তাল সময়ের খণ্ড-বিখণ্ড চিত্রের আরেক টুকরোও বটে। ‘চর’ কথাটির আভিধানিক অর্থ, নদীগর্ভে পলি পড়ে উৎপন্ন স্থলভাগ (দ্রঃ সংসদ বাংলা অভিধান)। সে যেন এক নো ম্যানস ল্যান্ড। যেখানে কেউ কখনও টের পায় না, কোনদিক থেকে আসতে পারে ভালোবাসা অথবা মৃত্যুর গন্ধ।
লেখিকা লিখছেন, “এপারে বাপের ঘর, ওপারে শ্বশুরঘর আর মধ্যিখানে চর”। প্রভাসুন্দরী বিষয়টা টুনুকে বোঝান তার মা লক্ষ্মীরানির অবস্থা বোঝাতে। তার বোধ হয় কোথাও যাবার নেই, কিছু হারানোরও নেই আর। বংশপরম্পরায় বাহিত হয় এই শিকড়-উৎপাটনের আখ্যান। খানসেনাদের অত্যাচার, সুরেশ ডাক্তার, অমর ডাক্তার, নুসরত খালা, পুঁটি – প্রত্যেকের উপস্থিতি কাহিনির অবধারিত সত্য। এ যেন হবারই ছিল কোনও একদিন। উত্তর-উপনিবেশবাদের দৃষ্টি থেকে দেখলে, এই চর শুধু বস্তুকেন্দ্রিক নয়, এই চর মানসিকও। শিকড় ছেঁড়ার কালের জন্ম শুধু দেশে-দেশে হয় না, তৈরি হয় মনেও। অত্যাচারের উপাখ্যানও সৃষ্ট হয় অবচেতনেই। পরে এক জায়গায় রয়েছে তার দৃষ্টান্ত, “মাতৃগর্ভে থাকা পুংশিশু তাকে যতই অসহায় ভাবো না কেন, সে তো আসলে পুরুষ। নারীকে যন্ত্রণা দেওয়ার মহড়া সে মাতৃগর্ভ থেকেই শুরু করে দেয়”।
একটু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশ এবং ভারত (ইন্ডিয়া) – এর মাঝেই অবস্থান চরিত্রদের। ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় মানুষ আসেন কাজের খোঁজে, মনে থাকে না, এই আসাই হয়ত ভিটে ছেড়ে পরবর্তী কোপ আসার আগের মুহূর্তের এক জৈবিক উচ্ছেদ। আর পরবর্তী কোপ তো রাষ্ট্রীয়। এবং অত্যাচার কোনও শ্রেণীবৈষম্য দেখে না। পুঁটি, কাজের মেয়ে, সেও বুঝে গেছে— “সব মাথাগুলো বাইছা রাখসে। দাঁড়া করায়ে গুলি করব“। কণ্ঠে ফুটে ওঠে দার্শনিক ব্যগ্রতা— ‘একহানে আগুন লাগলে সবাইতো পুড়ে।’ সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত মানুষ পালানোর চেষ্টা করেছে দূরে কোথাও। আসলে কোথায় যেতে চেয়েছে, কোথায় পৌঁছতে চেয়েছে, তারা জানে না। শুধু এটুকু বুঝেছে, এখানে থাকলে সমূহ বিপদ। শুধু উৎখাত নয়, সমূলে নিধন। পুরুষের ক্ষেত্রে হত্যা, আর নারীশরীরের ওপর জান্তব লালসা – যে কোনও অত্যাচারীর পরিচিত অস্ত্র।
সময়ের পাতা উলটে অকালজাত টুনুর কাছে এখন কোলের শিশু মিন্টু। শুধুমাত্র আগে-শেখা কলমা আবৃত্তির জেরে সে নিজেকে বাঁচাতে পারে পাকিস্তানি সেনার নির্মম লালসার হাত থেকে। লক্ষ্যণীয়, ভাষাও কীভাবে পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসের প্রতীক হয়ে ওঠে। আলথুসারের Ideological State Apparatus এভাবেও স্মর্তব্য হয়ে থাকে মানুষের মননে, অজান্তেই।
লেখিকা কিন্তু শুধুমাত্র সাত মাসে হওয়া একজন অকালজাত শিশু এবং তার বড় হওয়ার গল্প বলেননি। শুধুমাত্র একটি ‘bildungsroman’ হিসেবে এই কাহিনিকে দেখা অনুচিত। বহুমাত্রিক ও বহুকৌণিক স্তর থেকে দেখলে একটি ‘চরের মানুষ’ আসলে দেশ আর দ্যাশের দ্বন্দ্ব। যে দ্বন্দ্ব নির্মিত, অধীত নয়। এর সঙ্গে জুড়ে থাকে ত্রাসের চিহ্ন। একটা সময় আসে, যখন বয়ঃসন্ধিতে টুনু ঋতুমতী হয়ে অজানা ভয়ে কাঁদে, কাঁদে তার মা লক্ষ্মীরানিও। আর্ত হাহাকার করে, “ঋতুমতী হওয়া মানেই তো বিয়ার খুব কাছে চলে যাওয়া। যার মানে অন্য ঘর, অন্য দেশ। ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের মতো। একবার দেশান্তর হলে কেউ কি ফেরে?”
উপন্যাসের ভাষা আখ্যানটির সম্পদ। রাজনৈতিক-প্রাকৃতিক-আর্থসামাজিক দোটানা ও স্নায়বিক টানাপোড়েন লেখিকা ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। এই চরের মধ্যে থেকে যাওয়া মানুষের কোথাও না যেতে পারার, কোথাও না পৌঁছতে পারার উপাখায়ন মনে করিয়ে দেয় সাদাত হাসান মান্টোর “টোবা টেক সিং”, যে কি না শেষ অবধি বিলীন হয়ে যায় অক্ষত ভূমিতেই। টুনু আর তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা দুই বাংলার নকশিকাঁথা – এক দেদীপ্যমান উপকথা হয়ে থাকে স্মৃতিবিধৌত দুই দেশের হৃদয়ে।
গ্রন্থঃ চরের মানুষ
গ্রন্থকারঃ তৃষ্ণা বসাক
প্রকাশকঃ ধানসিঁড়ি
প্রচ্ছদঃ সুপ্রসন্ন কুণ্ডু
মূল্যঃ ২৫০ টাকা মাত্র
No comments:
Post a Comment