পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০
রূপছায়া টকিজ – বালিচক
শ্রীজিৎ জানা
সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই! বিরক্ত হন কেন! দেখুন না ক্যামন রুমাল থেকে বিড়াল করে দিই! মানে মিলিয়ে দেব সিনেমার সাথে সিনে -ম্যানের। আসলে তিনি মানুষটা ছিলেন অন্য মনের — অনন্য মনের। এক প্রকার জসিদার বলা- ই যেতে পারে। নাম রাসবিহারী করসিংহ। বাবা ভজহরি করসিংহ। মাতা চম্পকলতা দেবী। পড়াশুনা তাঁর মাত্র ক্লাস এইট অব্দি। কিন্তু তিনি শিক্ষাদরদী এবং দূরদর্শী। এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য দান করলেনযৃ পঁয়ষট্টি একর জমি। গড়লেন বাবার নামে ভজহরি উচ্চ বিদ্যালয়, বালিচক। মায়ের নামে ছাত্রদের জন্য গড়লেন 'চম্পকলতা' ছাত্রাবাস। একটা নয় তিনখানা ছাত্রাবাসের বিল্ডিং! আবাসিবক ছাত্ররা যাতে মাছ ভাত খেতে পারে সেইজন্য দু'খানা পুকুর কাটলেন! শুধু কী পড়াশুনা! খেলাধূলাকে উৎসাহিত করতে চালুন করলেন মায়ের নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করলেন – চম্পকলতা শিল্ড। বাইরের রাজ্য থেকে দল অংশগ্রহন করত সেই টুর্নাসেন্টে। আর সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে স্থাপন করলেন বিনোদনের কেন্দ্র রূপছায়া টকিজ।
রূপছায়া টকিজ -এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে চারটি পরিবার। বালিচকের করসিংহ, রায়, জানা এবং রাধামোহনপুর গ্রামের হুই পরিবার। রাসবিহারী করসিংহ হলেন রূপছায়ার প্রতিষ্ঠাতা। অজিত রায়,সুরেশ হুই, ত্রৈলোক্যনাথ জানা প্রমুখরা ছিলেন রূপছায়া টকিজের অংশীদার। সিনেমাহলের শুরুটা হয় একটু অন্য ভাবে। ওই চার পরিবার প্রথমে বালিচক রেললাইন সংলগ্ন চার একর বিয়াল্লিশ ডেসিমাল জায়গা ব্যাবসার জন্য কেনেন। চালু করেন শশী রাইস মিল। ওই মিলের শশীবালাম চাল কলকাতার বাজারে যথেষ্ট কদর ছিল। রাইস মিল চলছে রমরমিয়ে। হঠাৎ খেয়াল চাপল সিনেমাহল করার। ওই মিলের দক্ষিণ পূর্ব কোণে গোটগেড়া মৌজার দশ ডেসিমাল এবং গৌরাঙ্গপুর মৌহার আঠার ডেসিমাল জায়গার উপর তৈরি হল রূপছায়ার কাঠামো। কংক্রিটের দেয়ালের মাথায় বসল টিনের চাল। রূপছায়া পথ চলা শুরু করে ১৯৫৪ সালে। তখন মেঝেতেআর পাটাতনে বসে দর্শকরা সিনেমা দেখতেন। টিকিট মূল্য ছিল চার পয়সা, দশ পয়সা। মেসিনপত্র সব ভাড়ায় আনা হয়েছিল। কিন্তু ভাল সাড়া মেলায় মালিক পক্ষ এবার সিনেমাহলের দিকে একটু বাড়তি নজর দিলেন। কলকাতার জনৈক বিশ্বনাথ সেনগুপ্তকে ধরে কিনে আনলেন প্রোজেক্টর। কাঠের চেয়ার বসানো হল। টকিজ চলতে লাগল সগৌরবে।
কিন্তু ১৯৮৪ সালের মে মাসে সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। কারণ একটি অভিযোগ। প্রেক্ষাগৃহের যেদিকে পর্দা, সেই দিকেই ছিল পস্রাবখানা। দুর্গন্ধ ছড়ানোর জনবয প্রক্ষাগৃহে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কেউ অথবা কারা তৎকালীন ডি. এম সাহেবের কাছে অভিযোগ জানান। লাইসেন্স রদ করেন। তারপর আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয় রূপছায়াকে। এবার সিটে গদি লাগানো হয়। ব্যালকনি করা হয়। এরই মাঝে ওই অংশীদাদের মধ্যে অজিত রায়, যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এমনকি পরে তাঁর অংশ বিক্রি করে দেন। এবার বাকি তিন অংশীদারদের মধ্যে করসিংহ পরিবারের স্বপন করসিংহ সিনেমাহলের দায়িত্ব নিলেন। নতুন করে সেজে উঠল সিনেরমাহল। তাঁর আমলে প্রথম ছবি চলল আগামীকাল'। আগে রূপছায়ার সিট সংখ্যা ছিল ৫২০। কিন্তু এবার তা বাড়িয়ে করা হল ৬১৪ আর ব্যালকনিতে রাখা হল ১০০ টি আসন। এমন সময় হঠাৎ রূপছায়া টকিজের টিনের চাল ভেঙে পড়ে। ফলে আবার নতুন করে গড়তে হয়।এবার কিন্তু ব্যালকনিতে দুজন করে বসার জন্য কাঁচের ঘরের বক্স করা হল। নীচে টিকট মূলবয ছিল ১০ টাকা,১৫ টাকা ২০ টাকা আর বক্সের জন্য ছিল ১০০ টাকা। তবে পরে নীচের তিনটে রো এর জন্যই ২৫ টাকা দর্শনী করে দেন। রূপছায়ার শো টাইম ছিল ২.৪৫ মিনিট, ৫.৪৫ মিনিট এবং ৮.৪৫ মিনিট। তবে মূলত দুটো শো হত। আপ ও ডাউন ট্রেন আসত ২টা ১০ মিনিট। ফলে প্রথম শো তে ভীড় থিকথিক করত। হাউর, ক্ষীরাই, মাদপুর, জকপুর, শ্যামচক, রাধামোহনপুর থেকে দর্শক আসতেন।
প্রতি শুক্রবার গাড়িতে প্রচার হত। এছাড়া রিক্সাতে প্রতিদিন প্রচার করতেনশঙ্কর সুর। বিরতির মাঝে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ছবি ভেসে উঠত রূপছায়ার ৩২ ফুট বাই ২৮ ফুট পর্দায়। মাসে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া নেওয়া হত প্রতি বিজ্ঞাপনে। ওই বিরতি চলাকালীন ছোলা, বাদাম বিক্রি করতেন স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বনাথ গাঙ্গুলী। স্টাফ ছিলেন প্রথম দিবকে একুশ জন। পরে তের জন থাকতেন। চিফ অপারেটর ছিলেন সাধন জানা (বালিচক), রাধেশ্যাম দে (নরসিংহপুর), নব চ্যাটার্জি (বালিচক) প্রমুখ। কলকাতা থেকে বই আনতেন অশোক দে (বালিচক)। সিনেমাহল বন্ধের পর প্রত্যেককে সেইসময় এককালীন তিরিশ হাজার করে টাকা দেন মালিকপক্ষ। অনেকে বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন। তাঁদের অনেকেই আজ জীবিত নেই। দু'একজনের এখনো পান দোকান রয়েছে বালিচক বাজারে।
রূপছায়া নামের সিবনেমাহল আরও আছে। হাওড়ার বেড়াচাপাতে আছে রূপছায়া এবং ঝাড়গ্রামে আছে রূপছায়া। কিন্তু ডেবরা ব্লকের বালিচক স্টেশন সংলগ্ন রূপছায়া ছিল বাংলা ছবির স্টেশন। সংঘর্ষ, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, প্রতিবাদ প্রভৃতি বই টানা তিন মাস, ছ'মাস করে চলে। সেই সময় 'নবাব নন্দিনী' সিনেমা চলাকালীন আসেন নায়িকা পল্লবী এবং নায়ক—। শুরুর দিকে ১৫ ই আগষ্ট স্টুডেন্টদের জন্য ফ্রিতে দেশাত্মবোধক ছবি দেখানো হত। রূপছায়াতে সিনেমা প্রদর্শনের বাইরে সাংস্কৃতিক প্রসার ও প্রচার কার্যে ভাড়ায় হত। বালিচকের আকাশকুসুম সংস্থার উদ্যোগে বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠান হয় রূপছায়া প্রেক্ষাগৃহে। আসেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নচিকেতার মতো নামীদামী সংগীতশিল্পী বৃন্দ। রপছায়াতে সিনেমার শুটিং পর্যন্ত হয়েছিল। রূপছায়ার মালিকপক্ষের মধ্যে প্রফুল্ল রায় এবং বিভূতি হুইয়ের নেশা ছিল সিনেমায়। কলকাতায় তাঁরা গড়লেন ডিস্ট্রিবিউটার হাউস। নাম রাখলেন ভবতারিণী পিকচার্স। তাঁদের প্রোডাকশনে মুক্তি পেল 'ত্রৈলঙ্গ স্বামী', 'জন্মতিথি', 'বীরেশ্বর বিবেকান্দ', 'লবকুশ' প্রভৃতি সিনেমা। এদের মধ্যে জন্মতিথি ছবি জাতীয় পুরস্কার পায়। যার শুটিং হয় রূপছায়া সিনেমাহলে এবং পার্শ্ববর্াতী রায়খাঁ গ্রামের হরিসায়র পুকুরে।
এত ঘটনাবহুল রূপছায়া বন্ধের প্রধান কারণ হিসেবে তায়ী করলেন স্বপন করসিংহ জানালেন শরীকী ঝামেলাকে। রূপছায়ার অংশীদার তিনটি পরিবারের সদস্য মিলে অনেক ছিল। সেইসব চাপ এড়াতেই ২০১৬ ৩১ শে মার্চ বন্ধ হয়ে যায় রূপছায়া। আজ বালিচক পৌঁছে ট্রেন লাইনের ক্রসিং পেরিয়ে হাঁটা দেবেন দক্ষিণে। মাথার উপরে ওভার ব্রিজ ঝুলে থাকবে। খুজবেন রূপছায়াকে। কিন্তু সেই একসময়ের বাংলা ছবির স্টেশন রূপছায়া, রূপ মিলিয়ে গেছে কোথায়! শুধু তাঁর ছায়াটুকু স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে স্টশন চত্বরের অনেকের মনে।
তথ্যসূত্র :—
শ্রী স্বপন করসিংহ – বালিচক,ডেবরা।
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment