Sunday 31 March 2024

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা// ইকোরাস ১৭

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা- ১৭

মিতালি টকিজ - লোয়াদা, ডেবরা

শ্রীজিৎ জানা


কেশপুর থানার কাপাসটিকরির কাছে কংসাবতী স্রোত দু'দিকে ভাগ হয়েছে। তবে মূল স্রোত বয়ে গেছে লোয়াদা ছুঁয়ে পাঁশকুড়ার দিকে। এই কংসাবতী নদী তীরের ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন সিংহ পরিবার। পরিবারের বর্তমান প্রবীণ সদস্য অর্জুন সিংহ মহাশয় জানালের তাঁদের পূর্বপুরুষের কথা। প্রসঙ্গত এল 'মিতালী টকিজ' এর ইতিবৃত্ত। প্রয়াত বনবিহারী সিংহ ছিলেন ভারতীয় সৈন বিভাগের কর্মী। অবসর গ্রহণ করে প্রথমে কোলাঘাট - নরঘাট রূটে বাস চালান। কিন্তু বাস মালিক হয়েও মন ভরছিল না। অবশেষে ভ্রাম্যমাণ সিনেমা প্রদর্শনী ব্যাবসা শুরু করেন। সেই কাজে ম্যানেজার নিযুক্ত করেন লোয়াদা পার্শ্ববর্তী নন্দবাড়ি গ্রামের সুধাংশুশেখর মন্ডলকে। পলাশি,বেথুয়াডহরি প্রভৃতি অঞ্চলে তিনি তখন সিনেমা প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছেন। সেই সময় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয় অভিনেতা ছবি বিশ্বাস মহাশয়ের সাথে। তিনি স্থায়ী সিনেমাহল করার সহযোগিতা পেলেন। প্রোজেক্টর মেশিন ও জেনারেটরে ভাড়া করে দেন তিনিই। বনবিহারী বাবু প্রথমে নিজেদের বাড়ি সংলগ্ন স্থানে গড়লেন 'পূর্ণশ্রী' সিনেমাহল। মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া প্রেক্ষাগৃহ। পর্দার সামনে বসতে হত চটের আসনে। তার পরে ছিল বেঞ্চ,তার পিছনে ছিল ঠেসবেঞ্চ। দর্শনী ছিল যথাক্রমে উনিশ পয়সা, চার আনা ও আট আনা। সেই আমলে সিনেমাহলের লাইসেন্স নিয়ে সরকারি জটিলতা ছিল। সেইজন্য নিয়মকে ফাঁকি দিতে সিনেমাহলের নাম বদলে সরকারি ছাড়পত্র নিতেন অনেকেই। বনবিহারী বাবু ওই পথ ধরে পূর্ণশ্রী সিনেমাহলের নাম বদলে করলেন 'সন্ধ্যাশ্রী'।

সিনেমাহল চলছে তখন সাড়ম্বরে। কাঁসাই পেরিয়ে দূরদূরান্ত থেকে সিনেমা দেখতে আসতেন দর্শকরা। তখনও মলিঘাটি থেকে ডেবরা- পাঁশকুড়া রোডের সংযোগ হয়নি। গরুর গাড়ি করে কাতারে কাতারে মানুষ আসতেন। সন্ধ্যাশ্রীর শো টাইম ছিল ৩ ৩০ মিনিট এবং ৫.৩০ মিনিট। কিন্তু জট পাকলো অন্য কারণে। হঠাৎ আপত্তি এল পার্শ্ববর্তী স্কুল কর্তপক্ষের কাছ থেকে। পাশেই লোয়াদা প্রাথমিক ও লোয়াদা উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। লোয়াদা প্রাথমিক বিদ্যালয় আবার বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রতিষ্ঠিত।  কর্তপক্ষের চাপে সিনেমাহল সরল অন্যত্র। নদী বাঁধ থেকে অনতীদূরে রাস্তার পাশে গড়ে উঠল মিতালী টকিজ। এবার কিন্তু মিতালীর মালিক একা বনবিহারী সিংহ রইলেন না। সাথে নিলেন পশুপতি দত্ত,রাধাগোবিন্দ সিংহ এবং শ্রীহরি দে- কে। কংক্রিটের দেওয়াল তুলে, টিনের ছাউনি দিয়ে নতুন সাজে সেজে ওঠে মিতালী টকিজ।

  এখানে বলে রাখি পূর্ণশ্রী ও সন্ধ্যাশ্রীর পোস্টাল অ্যাড্রেস কিন্তু তালবেড়িয়া ঘুনঘুনি পাটনা। আর মিতালীর নতুন ঠিকানার নাম ফতেবাড়। সাড়ে পাঁচশ আসন বিশিষ্ট মিতালী সগৌরবে চলতে থাকে। আশেপাশে তখনো কোন সিনেমাহল গড়ে ওঠেনি। এদিকে মলিঘাটীর শ্রীমা চিত্রমন্দির ওদিকে বালিচকের রূপছায়া। ডেবরায় তখন অব্দি সিনেমাহল হয়নি। প্রতি শোতেই ছিল উপচে পড়া ভিড়। শোটাই করা হয় ২.৩০ মিনিট, ৫.৩০ মিনিট এবং ৮.৩০ মিনিট। বর্ষার মরসুমে কিছুটা ভাটা পড়লেও বছরের বাকি দিনে দর্শক আসন ভিড়ে ঠাসা থাকত। মিতালী টকিবজকে কেন্দ্র করেই ওই এলাকায় বাজার গড়ে ওঠে। একসময় নাম হয় সিনেমাহল বাজার। আজকে কাঁনাইয়ের উপরে ব্রিজ তৈরী হয়েছে। কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত নদীর শুকনো বুকের উপর দিয়ে চলত বাস। আগে চলত গরুর গাড়ি। সেইসব যানবাহনে চড়ে সবাই আসত। আনুমানিক ষাটের দশকে মিতালীর যাত্রা শুরু হয়।

মিতালী টকিজকে ঘিরে একটি জনশ্রুতি রয়েছে। তখন মিতালীতে চলছে 'কালী আমার মা' সিনেমা। পাশের ত্রিলোচনপুর গ্রামের জাগ্রত মা কালী মহিলার ছদ্মবেশ ধরে ওই ছবি দেখতে আসেন। আর ওই রাতেই তিনি সিনেমাহল মালিকদের একজনকে স্বপ্ন দেন। মায়ের স্বপ্নাদেশের কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ভীড় বাড়তে থাকে। ছবিটিকে কয়েক সপ্তাহ চালানো হয়। বাংলা পারিবারিক ছবি এবং পৌরাণিক ছবির দর্শক ছিল বেশি।  গুরুদক্ষিণা সিনেমা চলেছিল দশ সপ্তাহ। ওই সময় পাঁচটি করে শো টাইম করা হয় - ৯ টা,১২টা,৩টা,৬টা এবং ৯ টা। এছাড়া মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে স্থানীয় যে শতাধিক বর্ষ প্রাচীন মহপ্রভুর মেলা, তাতেও দিন রাত সিনেমাহল খোলা থাকত। এমনকি স্বাধীনতা দিবসের দিনে দেশাত্মবোধক সিনেমা চালানো হত। সকাল থেকে রাত অব্দি চলত ছবি। দিনের ভাগে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কনশেশন মূল্যে বিদ্যাসাগর,সুভাষচন্দ্র,দেবী চৌধুরাণী সিনেমা দেখানো হত।

মিতালীর প্রথম দিকের ম্যানেজার ছিলেন শশাঙ্ক শেখর তরোয়াল। পরে হন অজিত সিংহ। রিক্সায় চড়ে মাইকে ক্যানভাস করতেন শম্ভু দাসগুপ্ত। অন্যদিকে তিনিই ছিলেন অ্যাসিসট্যান্ট অপারেটর। চিফ অপারেটর ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র পন্ডিত ও পূর্ণেন্দু তরোয়াল। মিতালীতে সিনেমা শুরুর আগে শোনানো হত কলের গান। যেটি সিংহ পরিবারের অন্দরমহলে একসময় বাজত। মিতালীর পথচলা প্রায় ষাট বছর। বিগত ২০১০ সাল নাগাদ মিতালী টকিজ বন্ধ হয়ে যায়। একদিন যেখানে মিতালী টকিজ গমগম করত,আজ সেইস্থান ফাঁকা পড়ে আছে। এতটুকু ইঁটের চিহ্ন নেই। বনবিহারী সিংহের কাছে মিতালী টকিজ ছিল বড় আবেগের। বিকেলে ছোটদের দল বায়না ধরলে বিনা টিকিটে ছবি দেখতে দিতেন। সারাক্ষণ থাকতেন সিনেমাহলে। শেষের ছাব্বিশ বছর ম্যানাজার পদে ছিলেন তাঁর পুত্র অর্জুন সিংহ। কথা বলতে বলতে চাপা কান্নায় স্বর কেঁপে ওঠে। বলেন " "যেদিন মিতালী ভাঙা হোলো দাঁড়িয়ে দেখতে পারিনি। কেঁদে ফেলেছিলাম।"


তথ্যসূত্রঃ— 

শ্রী অর্জুন সিংহ - লোয়াদা,ডেবরা।

......................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪



No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...