Sunday 31 December 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১২

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১২

মতি সিনেমা--ঘাটাল  

শ্রীজিৎ জানা


শিলাবতী এখানে উত্তর বাহিনী। শাস্ত্র উবাচ উত্তরবাহী নদী নাকি পূণ্যতোয়া। পৌষ সংক্রান্তিতে এখানকাার বাঁধানো নদীঘাটে  মকরডুব দিতে আসতেই পারেন। তিন ডুবকিতে পূণ্যফল পেতেই পারেন। তার আগে আসুন,সীসানাটা স্পষ্ট করে দিই। এখানে বলতে রসিকগঞ্জ– নিমতলা থেকে পোস্তাবাজার অব্দি। রূপনারায়ন উজিয়ে আসা জোয়ারের জলে ভরা থাকে সারাবছর। শহরের ঘরবাড়ি ডিঙিয়ে ওই যে রোদ্দুর ফিরে যাচ্ছে তার বাড়ি, আর ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে শেষবেলার কুমড়োফুল রঙ। শিলাবতীর তিরতিরে ঢেউয়ে সেই রঙ মিশে যেন চোখে ঝিলমিল লাগিয়ে দেয়। আহারে শিলাবতী! তার পুব-পশ্চিবম দুই পাড়ে এখন ঘিঞ্জি দোকানপাট। মৃদু ঢেউ ভেঙে সারি সারি কাঁচা বাঁশের ভেলা ভেসে যাচ্ছে মহনগরের দিকে। বুকের উপরে বিদ্যাসগর সেতু আর শতবর্ষ প্রাচীন পোনটুন ব্রিজ যাকে ভাসাপোল নামেই চেনে সকলে। ছোট্ট শহরটার অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে ভাসাপুল অনন্য।

কিন্তু কথা তো সিনেমাহল নিয়ে। গৌরচন্দ্রিকা আরো কত লম্বা করিবে হে বাপু! আরে মশাই যেই সিনেমাহলের হালহকিকত জানাবো, তার অকুস্থলে যেতে হলে ভাসাপুল পেরিয়ে কুঠিবাজারে ঢুকতে হবে। পছন্দ না হলে বিদ্যাসাগর ব্রিজ পেরিয়ে, বর্তমান সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড ছুঁয়ে ডাইনে মোড় নিয়ে সোজা উত্তরে কদম কদম বাড়ায়ে যা..। তবে এপথে তখনি যাবেন যখন আপনি পুব কিংবা দক্ষিণের লোক হন। পশ্চিম দিক থেকে আসলে, উত্তর থেকে আসলে তার নির্দেশ আলাদা। কিন্তু কোথায় যাবেন? সিনেমাহল। কোন সিনেমাহল? কেন, মতি সিনেমা! রাগেন কেন মশাই! শান্ত হোন, বলছি। শিলাবতীর পশ্চিম পাড়েই দুটি সিনেমাহল। তার মধ্যে একটি মতি। বিষয়টাকে যদি আরেকটু গুবলেট করে দিই,তবে মতি নিয়ে মতিগতি অবাক হওয়ার জোগাড়। কুঠিবাজারে আজকের মতি সিনেমাহলের জায়গায় একদা গড়ে উঠেছিল 'ভারতী টকিজ'। তা নিয়ে আলোচনা পরের পর্বের জন্য আপাতত তোলা থাক। তবে একটা বিষয় একটু বলা দরকার কুঠিবাজার রামজি দাসসুরেখা ট্রাস্টি বোর্ডের জায়গা। সিনেমাহল মালিক সেই ট্রাস্টি বোর্ডের কাছ থেকে  প্রেক্ষাগৃহ করার জন্য জমি লিজে নেন।আনুমানিক ১৯৭৬-৭৭ সাল নাগাদ ভারতী টকিজের কাঠামো ভেঙে সরিয়ে নেওয়া হয় ওইস্থান থেকে। আর ১৯৭৯ সালের ১৫ই এপ্রিল মাস থেকে মতি সিনেমার জয়যাত্রা শুরু হয়। মতি সিনেমাহলের মালিক হলেন শ্রী তপন কর্মকার মহাশয়। বাড়ি খড়ার, ঘাটাল মহকুমা। 

কর্মকার মহাশয়ের ঠাকুমা ছিলেন শ্রদ্ধেয়া মতিবালা কর্মকার। তাঁর নামে চন্দ্রকোণায় আগে থেকেই ছিল মতি কোল্ড স্টোর। প্রিয় ঠাকুমার নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইলেন। প্রেক্ষাগৃহের নাম রাখলেন মতি সিনেমা। ঘাটালের বন্যার কথা মাথায় রেখে বেশ উঁচু করে স্ট্রাকচার নির্মাণ করা হল। বেশ সাজানো গোছানো সিনেমাহল। সিঁড়ি ভেঙে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করতে হয়। সার দেওয়া কাঠের চেয়ারে সজ্জিত দর্শকাসন। ততোধিক ছিমছাম ব্যালকনি। আলো-আঁধারের ভুবনে ম্যাটিনি শোয়ে কত যে যুগল বাঁধা পড়েছে প্রেমের ফাঁদে তার হিসেব নেই কারুর কাছেই। কত মান অভিমান,কত নোনা জলের বৃষ্টিপাত,প্রথম স্পর্শ,আদুরে চুম্বন সবই হয়তো নির্বাক হয়ে দেখেছে প্রেক্ষাগৃহ। মতির যাত্রা শুরুর প্রথম দিনে পর্দায় ভেসে ওঠে যে ছবি তার নাম 'জয় মা তারা'। প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়ে ভীড়। তখন ফ্রন্ট স্টলের টিকিট মূল্য ছিল ১৯ পয়সা। মিডিল স্টলে ৭৫ পয়সা এবং আপার স্টলে ১.৫০ পয়সা। আর ব্যালকনির টিকিট মূল্য ২.৫০ টাকা। চিফ অপারেটর ছিলেন বিকাশ রঞ্জন ভূঞ্যা। প্রথম দিকে প্রোজেক্টেরের মাধ্যমে ছবি প্রদর্শিত হত। পরে স্যাটেলাইট সিস্টেম চালু হয়। ইয়োফো কোম্পানির ইন্টারনেট যন্ত্রের মাধ্যমে বই ডাউনলোড করা হত এবং ছবি পর্দায় ফুটে উঠত। মতি সিনেমায় ওই সিস্টেম চালু হয় ২০২১২ সাল থেকে। ওই সিস্টেমের প্রথম ছবি ছিল'খোকাবাবু'।



ঘাটাল শহরের মধ্যে মতি সিনেমাহল। দর্শক সংখ্যায় তেমন ভাটা পড়েনি কখনোই। স্কুল- কলেজপড়ুয়ারা ভরিয়ে রাখত ম্যাটিনি শো। তাছাড়াও শহরে আসা দূরদূরান্তের সিনেপ্রেমীরা সিনেমা দেখতে ভীড় জমাতো।  মতি সিনেমাহলের শো টাইম ছিল, ১২ টা,৩ টা এবং ৬ টা। শহরের অন্যতম কবি মহাশ্বেতা দাস মতি সিনেমাহল নিয়ে বললেন তাঁর কথা–" যতদূর মনে পড়ে,মতি হলে আমার দেখা প্রথম সিনেমা মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত 'পরিবার'। ছোটবেলায় বাড়ি থেকে সহজে সিনেমা দেখার অনুমতি মিলত না। পরীক্ষা শেষ হলে ছাড়পত্র মিলত। আর আত্মীয় এলে দলবেঁধে ভিড় জমাতাম। মতি হলে হিন্দি সিনেমা চলত বেশি। এই হলের ব্যালকনিতে বসে সিনেমা দেখার মজাই ছিল অন্যরকম। মতি  সিনেমাহল চত্বরে বেশকিছু দোকান ছিল। তার মধ্যে ফ্যাতনের মোগলাই ছিল বিখ্যাত। শহরের দুটো সিনেমাহল-ই এখন বন্ধ। খুব খারাপ লাগে।"  একথা সত্যি যে তখন মুখে মুখে কথটা ফিরত, মতি মানে হিন্দি বই,ভারতী মানে বাংলা। হিন্দি ছবি তোফা শোলে,দিবার ফাটাফাটি ভাবে চলে। 'শোলে' সিনেমা চলেছিল তিন মাস। হিন্দেতে ডাবিং করা ইংরেজি সিনেমা 'অ্যানাকোন্ডা', 'জুরাসিক পার্ক প্রভৃতিতেও ভিড় উপচে পড়ে।'লাল-সাদা আর নীল- সাদা রঙে ছাপা পোস্টারে প্রচার হত। নতুন হিট ছবি আসলেই মাইকেও প্রচার চলত। মতি সিনেমাহলের ব্লকবাস্টার ছবি 'বাবা তারকনাথ '।  টানা তিরিশ সপ্তাহ চলেছিল সগৌরবে। 'গুরুদক্ষিণা' সিনেমাও চলে চার মাস।তারপরেই আছে লাঠি–দু''মাস, অনুসন্ধান –তিন মাস, ফাইটার– ২ মাস। এছাড়াও ছোটবউ,বলিদান,অনুরাগের ছোঁয়া,খোকাবাু দীর্ঘদিন ধরে চলে। ঘাটাল শহরের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অশোক সামন্ত মহাশয় মতি সিনেমাহলের স্মৃতিচারণায় বলেন," স্কুল কলেজ লাইফে সিনেমাহলে প্রচুর বই দেখেছি। মতিতে হিট ছবিতে টিকিট প্রচুর ব্ল্যাক হত। পুলিশ মোতায়েন অব্দি করতে হয়েছে। আমদের একটা স্টুডেন্ট গ্যাং ছিল,যারা ব্ল্যাকারদের দাদাগিরি দমিয়ে দিয়েছিলাম বেশ কয়েকবার।আরও একটা বিষয়,স্কুল থেকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকবার। তাছাড়া করমুক্ত ছবিও দেখানো হয়েছে একটাকা টিকিটের বিনিময়ে। সবুজ দ্বীপের রাজা,দ্বীপের নাম টিয়ারঙ,ছুট প্রভৃতি সিনেমাগুলো দেখতে গেছি স্কুল থেকে"।

সিনেমাহলের মালিক তপন কর্মকার মহাশয় জানাচ্ছেন, " কোভিড আসার মুখ অব্দি প্রোটোকল মেনে সিনেমাহল চালু রেখেছিলাস। লস হচ্ছিল। তবুও চালাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষ অব্দি বন্ধ করকে বাধ্য হই"।

২০২০ সালের শুরুতেই মতি সিনেমাহল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেষ সিনেমা 'ইন্সপেক্টর দাউদ'। তিনি আরো বলেন," একসময় মতিতে টলিউডের সুপারস্টাররা আসতেন। যখনই তাঁদের সিনেমা কয়েকসপ্তাহ অথবা  মাস অতিক্ম করে চলত তাঁরা আসতেন। রঞ্জিত মল্লিক,প্রসেনজিৎ, জিৎ, তাপস পাল, অনামিকা সাহা প্রমুখরা এসেছেন আমার হলে"। ২০০০ সালের পর থেকে মতির টিকিট মূল্য বাড়ে। তখন ফ্রন্ট ২০ টাকা,মিডিল ২৫, রেয়ার ৩০ এবং ব্যালকনির মূল্য ছিল ৫০ টাকা। তবে আগে সিট চারটি স্টলে ভাগ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে তিনটি ও শেষে দুটি স্টলে ভাগ করা হয়। মতি হলের সিট সংখ্যা ছিল ব্যালকনির ১৮৬ সহ ৯১৫। স্টাফ ছিলেন ১০–১২ জন। তপন বাবুর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি মতি সিনেমাহল নিয়ে তাঁর ইচ্ছের কথা। এখনো আগ্রহ রয়েছে সিনেমাহল চালু করার। কিন্তু একদিকে বয়স অন্যদিকে আজকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে টিকিটের মূল্য কেমন করা যাবে, দর্শক ক্যামন ভিড় করবে ইত্যাদি বিষয়ে ভাবনা। বিকেলে সিনেমাহলটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেও ফিরে যাচ্ছিলাম ডাউন মেমোরি লেনে। মতি সিনেমার ব্যালকনির কোনার সিটে বসেছি আমিও। পর্দায় তখন চলছে  হৃত্বিক রোশনের প্রথম ছবি 'কহোনা প্যায়ার হ্যায়'। পাশে ছিল আমিশা প্যাটেল। রসিক পাঠক যা বোঝার বুঝে নিন।


তথ্যসূত্র:—

প্রসাদ পাঠক ব্যানার্জী – বিশিষ্ট আইনজীবী, ঘাটাল

তপন কর্মকার— মালিক,মতি সিনেমা,মেছেদা

অশোক সামন্ত– বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, ঘাটাল

দীবাকর সী – বিশিষ্ট সাংবাদিক,ঘাটাল

মহাশ্বেতা দাস– বিশিষ্ট কবি ও গদ্যকার,ঘাটাল 

নিতাই ঘোড়ই- ম্যানেজার, ঘাটাল

            …………………… 

সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...