রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৪৯
সাগর বলে কূল মিলেছে আমি তো আর নাই
মহাশ্বেতা দাস
অপারেশনের পর একটু একটু করে আরো অবনতি হতে লাগলো,.....জ্ঞান নেই। গিরিডি থেকে আনানো হল কবির বিশিষ্ট বন্ধু ও বিখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকার কে । কবির নাড়ি দেখে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের বুঝতে বাকি রইলো না!... আর যে কিছুই বলার মত নেই, সব বলা কওয়ার ঊর্ধ্বে ওঠার সোপানে যে পা রাখতে শুরু করে দিয়েছেন কবি। শুধু পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিলেন বন্ধু'র কপালে। কবি-কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুহৃদ বন্ধু নীলরতন বাবুর দুচোখে নামলো বিচ্ছেদের শ্রাবণ ধারা।
২২শে শ্রাবণ, ১৯৪১ সাল… সকাল থেকে কবির রোগ শয্যার পাশে বসে অবিরাম ধারায় পড়া চলছে কবির জীবনের বীজমন্ত্র–
শান্তম্ ,শিবম্,অদ্বৈতম্।
সকাল ন'টায় কবিকে অক্সিজেন দেওয়া হলো। বেলা বাড়তে লাগলো৬। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণ তখন ভরে উঠছে কৌতূহলী মানুষের উপস্থিতিতে। হিক্কা উঠছে অনবরত। একসময় খুলে দেওয়া হল অক্সিজেনের নল। একটু একটু করে কমতে লাগল পায়ের উষ্ণতা। ঘড়িতে বেলা ১২টা বেজে১০ মিনিট, চিরতরে স্তব্ধ হল কবির হৃদয়ের স্পন্দন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ প্রভাত পাখির গান জাগিয়ে পশিল যে রবির কর... তারপর "কত বর্ণে কত গন্ধে কত গানে কত ছন্দে" ভুবন আলোকিত করে সেই রবি ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ সাঙ্গ করলেন ধরার পালা।
কবির জীবন সায়াহ্নে (১৯৪১সালে) ত্রিপুরার রাজা শান্তিনিকেতনে এসে কবিকে "ভারত ভাস্কর" উপাধি দান করেছিলেন। সব ঠিকই ছিল, ২৫ শে জুলাই এর পর থেকে কবির জীবন সায়াহ্নকাল যেভাবে অতিবাহিত হল.... একজন বিশ্বখ্যাত মহামানবের এমন মর্মান্তিক পরিণতি মেনে নিতে কষ্ট হয়। অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়াই তো ছিল চিকিৎসকদের চরম ভুল.... তার ওপর সেই সময়ে কলকাতা নগরীর যথেষ্ট আধুনিকিকরণ হওয়া সত্ত্বেও কবির অপারেশন কেন কোন চিকিৎসালয়ে ব্যবস্থা না করে পুরানো দিনের ঠাকুর বাড়ির বারান্দায় করা হল এ প্রশ্ন আজও রবীন্দ্রপ্রেমীদের মন ভারাক্রান্ত করে!
"সমুখে শান্তি পারাবার
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।"
তরণী ভাসিয়ে দেওয়ার সময় যে এসেগেছে। নিজের শেষ যাত্রার গানটিও কবি লিখে গিয়েছিলেন। কবির ইচ্ছে ছিলো কলকাতায় জনকোলাহলের মধ্যে জয়ধ্বনি তুলে নয়, তাঁর শেষকৃত্য হবে শান্তিনিকেতনের শান্ত পরিবেশে খোলা আকাশের নীচে। কিন্তু সেদিন কবির এই কথার কেউ মর্যাদা রাখেনি, পূর্ণ করা হয়নি কবির অন্তিম ইচ্ছে কে।
কবিকে বেনারসি জোড়ে রাজবেশ পরানো হল। গরদের পাঞ্জাবি, সুন্দর করে কোঁচানো ধুতি, চাদর। গলায় ফুলের মালা, কপালে চন্দন আর কবির বুকের উপর রাখা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল পদ্ম কোরক।
মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। পরমাত্মীয় বিয়োগের বিচ্ছেদ বেদনায় সারা বিশ্ব সেদিন যে যার নিজের মতো করে শোক পালন করলো। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে জড়ো হল আশ্রমের সবাই। ঠাকুর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় অবন এঁকে চললেন রবিকা'র শেষ যাত্রার ছবি। ঠাকুর বাড়ির ফটক পেরিয়ে বিশৃঙ্খল জনস্রোতের মাঝখান দিয়েই একটু একটু করে এগিয়ে নিমতলা মহাশ্মশানের দিকে নিয়ে যাওয়া হল কবির দেহ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন–
"আমার মৃত্যুর মিছিলে যেন উন্মাদনা না হয়। আমার নামে কোন জয়ধ্বনি যেন না দেওয়া হয়।"
কিন্তু….. রবি প্রয়াণের ইতিহাস বলে অন্য কথা!!!
কবিকে যখন রাজবেশে অন্তিম সাজে সজ্জিত করা হচ্ছে তখন উন্মত্ত জনতা দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল কবিকক্ষে, চিৎকার করে জয়ধ্বনি তুলল….
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি জয়।
এখানেই থামলো না..... রবি-স্মৃতি নিজের কাছে রাখার উন্মাদনায় যে যেমন করে পারলো ছিঁড়ে নিল কবির চুল, দাড়ি, নখ।
"স্তবের বাণীর আড়াল টানি তোমায় ঢাকি,
দেখব ব'লে এই আয়োজন মিথ্যা রাখি।"
কোলাহলের মধ্যে দিয়ে নিমতলা মহাশ্মশানে যখন রবি ঠাকুরের দেহ পৌঁছালো..... ততক্ষণে তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর সৌম্যকান্তি বিকৃত হয়ে গেছে। এমন কি রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির মুখাগ্নি করার সুযোগ টুকুও পাননি। এভাবেই শেষ হল বিশ্ববরেণ্য কবির সমস্ত পার্থিব হিসেব নিকেশ।
"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–"
…………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment