Friday, 15 December 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১১

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা

বঙ্গলক্ষ্মী টকিজ- রানীচক, দাসপুর

পর্ব--১১

শ্রীজিৎ জানা


এক টাকায় তিন জেলা দর্শন করিয়ে দিতে পারি। ভাবছেন গুল মারছি! মোটেই না। ভদ্দর লোকের এক কথা। বিশ্বাস না হয়, সঙ্গী হোন আমার। অনুরোধ একটাই গমনকালে মুখটি রাখুন স্পিকটি নট্। ওই 'আগে যান ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়ে,পাছু পাছু যান গঙ্গা' র মতো কদম তলে হাঁটুন। প্রথমে যেইখানে পৌঁছালুম তার নাম রানীচক, দাসপুর -১ ব্লক,পশ্চিম মেদিনীপুর। জমজমাটি বাজার। একখানা নাম আছে তার লক্ষ্মীবাজার। সেখান থেকে কয়েক পা লেফ্ট-রাইট করে হাঁটা দিলেই পাবো রূপনারায়ণ নদী। নদীর এপার মানে পুবে রানীচক আর একটাকা পারানীর বিনিময়ে নদী পেরোলেই পশ্চিমে গড়ের ঘাট। মানে হল হুগলী জেলা,সেখান থেকে আরেকটু এগোলেই হাওড়া। পশ্চিম মেদিনীপুর - হুগলি - হাওড়া,তিন জেলা ক্যামন ঘুরিয়ে দিলাম দেখুন ম্যাজিকের মতো। আচ্চা,একে ম্যাজিক বলে না! একে বলে বাগাড়ম্বর!  হোক বাগাড়ম্বর, শুনলে কান দিন, নইলে টান দিন, মানে পিঠটান দিন। এক্ষুনি বাগাড়ম্বর থামছে না। আরো কয়েকখান কথা আছে।

রানীচক। চক্ মানে বসতি। তার মানে ওখানে এককালে রানীর বাস ছিল।  রানীচক মানে রানী থাকবেই? আলবাত থাকবে। ওই গ্রামের পাশেই তো আছে কুমারচক গ্রাম। কুমোরদের বসতি বেশি বলে নাম হয়েছে কুমোরচক, তা থেকে কুমারচক। তাহলে রানীচকে রানী থাকা অমূলক নয়।রানী থাকলে রাজাও থাকবে। তবে কোন রাজ? কোন রানী? কেউ বলেন বর্ধমান রাজা হতে পারে। কারণ তার রাজ্যের অধীন ছিল এই এলাকা।আবার কারো মকে অনতিদূরে জোতকানুরামগড় গ্রাম। জোেত কথার অর্থ নিজস্ব বা খাস। কানুরাম কী তাহলে কোন রাজা? তার খাস তালুক এই এলাকা? অনুমানের মানে খুঁজতে যাবেন না মশাই,তাহলে সব ভন্ডুল হয়ে যাবে।


কিন্তু রানীচক নিয়ে এত খোঁজতল্লাশি কেন? কারণ রানীচক শুধু রানীর জন্য নয়, লক্ষ্মীবাজারের জন্য নয়,সেখানের 'বঙ্গলক্ষ্মী টকিজ' এর জন্যও জনপ্রিয়। আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে এই সিনেমাহলকে ঘিরে গমগম করত বাজার এলাকা। তিন জেলার সিনেপ্রেমীদের ভিড় থই থই করত বঙ্গলক্ষ্মী টকিজে। বাজার এলাকার ব্যাবসার উন্নতিতে এই সিনেমাহলের এতটাই প্রভাব পড়ে যে,বাজারের একপাশে নতুন করে গড়ে ওঠে বঙ্গলক্ষ্মী মার্কেট। 'বঙ্গলক্ষ্মী টকিজ' এর শুভ মহরৎ হয় ১৯৮৬ সালে। শুরু করেন রানীচক গ্রামের রক্ষিত ব্রাদার্স— মদন রক্ষিত,মোহন রক্ষিত এবং বিশ্বনাথ রক্ষিত। বনেদি পরিবারের ছিল ভূসিমাল ব্যবসা। হঠাৎ সিনেমাহল করার ঝোঁক হল মাথায়। নিজস্ব জায়গায় একদিকে কংক্রিটের দেয়াল তুলে,বাকিটা কাটের পাটাতন পুঁতে কাঠামো দাঁড় করালেন। মাথায় চাপল টিনের ছাইনি। এমনভাবে প্রেক্ষাগৃহ নির্মিত হল যে, দেয়াল পাকার নাকি কাঠের বাইর থেকে সহজে বোঝা মুশকিল ছিল। বঙ্গলক্ষ্মী টকিজের বিশেষত্ব ছিল তার সাউন্ড সিস্টেমে। ঘাটাল মহকুমার একমাত্র এই টকিজেই ছিল ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম। সেইসময়ে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে রক্ষিত ব্রাদার্স সাউন্ড সিস্টেম করেন। সামান্য পিন পড়ার শব্দ শোনা যেত হলের ভিতর।

বঙ্গলক্ষ্মী টকিজে দর্শকদের বসার আসন সংখ্যা ছিল ছয়শ। ব্যালকনিতে সিট ছিল একশ বাকি তিনটি রোয়ে পাঁচশ। শুরুর দিকে তিন টাকা, চার টাকা আর পাঁচটা করে টিকিট মূল্য ধার্য করা ছিল। তবে ১৯৯৬ সালের পর টিকিটের দাম বাড়িয়ে দশ,বার,কুড়ি এবং পঁচিশ টাকা করা হয়। বাংলা ছবি মানেই প্রথম দু'সপ্তাহ টকিজ হাউসফুল। পাশের হুগলী,হাওড়া থেকেও নদী পেরিয়ে এই সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে দর্শকরা ভীড় করতেন। টিকিট ব্ল্যাক পর্যন্ত হয়েছে। টানা দু-তিন মাস চলেছে 'দোলন চাঁপা', 'বৌমা' এবং 'লাঠি' সিনেমা। শো চলত তিনটা ও ছটার। তবে ভীড় দেখে বারটা,তিনটা এবং ছটার শো চালাতে হয়েছে অনেকবার। 


রক্ষিত ব্রাদার্স প্রথম থেকেই তাদের প্রেক্ষাগৃহকে যথেষ্ট যত্ন দিয়েই গড়েন। তাঁদের নিজস্ব প্রোজেক্টর ছিল তিনখানা। চোদ্দ জন স্টাফ থাকতেন হলে। চিফ অপারেটর ছিলেন দিলীপ জানা এবং শীতল মাইতি ( কুমারচক)। পোস্টারিং সহ  মাইক প্রচারের মাধ্যমে ছবির প্রচার চালানো হত। গোপাল ভূঞ্যা, হারু দোলইরা পোস্টার আর আঠার বালতি সাইকেলে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তেন মনোহরপুর,হরিশপুর,গোপীগঞ্জ, কেশবচকের দিকে। এমনকি নদী ডিঙিয়ে খানাকুল,রাজহাটি অব্দি সিনেমার পোস্টারিং হত। কিন্তু একটা সমস্যা বঙ্গলক্ষ্মীর লক্ষ্মীলাভে কাঁটা হচ্ছিল। প্রায়শই স্টাফেদের সঙ্হে মালিকপক্ষের মনোমালিন্য হত। মাঝে বাধ্য হয়ে মালিকপক্ষ ১৯৯৬ সাল নাগাদ হল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। প্রায় চার বছর পর আবার ২০০২ সাল নাগাদ সিনেমা দেখানো শুরু করেন। এদিকে তখন রানীচক বাজারেই গড়ে উঠেছে ভিডিও হল। দর্শক ভীড়ে ভাটা পড়তে থাকে।শেষমেশ বঙ্গলক্ষ্মী টকিজের পখচলা থেমে যায়। সাল ২০০৬, পর্দায় চলছে অন্তিম ছবি 'মেজরসাব',বঙ্গলক্ষ্মী টকিজের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আজ রানীচক বাজার গেলে বঙ্গলক্ষ্মী মার্কেট পাবেন কিন্তু সিনেমাহলের চিহ্নটুকুও মিলবে না। তবে বাজার পাড়ায় কান পাতলে শোনা যাবে সেদিনের সিনেপ্রেমীদের স্মৃতিচারণ। 


তথ্যসূত্র:—

শুভাশিস রক্ষিত, রানীচক।

                  ……………..........


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...