Tuesday, 12 December 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪৮

 


রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৪৮

 শেষ অর্ঘ্য 

 মহাশ্বেতা দাস 


কোন বয়সে কবিতা লেখা শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস উদ্ধার করা দূরূহ । তবে ১৮৭৩ সালে পিতার সাথে হিমালয় ভ্রমণে বেরিয়ে পিতার সান্নিধ্য, শান্তিনিকেতনের শান্ত পরিবেশের সাথে পরিচয়, ডালহৌসি পাহাড়ে বক্রোটা শৈলশিখরে আকাশের তলায় বসে পিতার সাহচর্যে জ্যোতিষ্ক রহস্য ও নক্ষত্র চেনা সব মিলিয়ে বালক রবীন্দ্রনাথের অন্তরে লুকিয়ে থাকা  কাব্যিক হৃদয়  ডানা মেলতে শুরু করেছিল… সেদিনের শিশুমনে অনুরণিত হয়েছিল যাকিছু!  ... পরে সেই অব্যক্ত বাণী প্রকাশিত হল কাব্যে, গানে, ছন্দে, সুরে। তারপর বীণাপাণির বরপুত্র সুরের দীক্ষায় চিত্ত ভরিয়ে নিয়ে মন্দাকিনীর ধারা, শুকতারা, কনকচাঁপা… আরও কত কিছু নিয়ে জীবনের "কান্নাহাসির-দোল- দোলানো" র মধ্যেই চিরজীবন বয়ে চললেন অজস্র গানের, কাব্যের, সাহিত্যের ডালা। 


"বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যেথায় বাজে।"


কিন্তু  অনেকদিন ধরে, অনেক বছর ধরে যে সুর শ্রাবণের ধারার মতোই বর্ষেছে, ১৯৪১সালের শ্রাবণের আকাশের ছবি টা ঠিক তেমন নয়.... কালো মেঘে আকাশ ক্রমশ ছেয়ে আছে, গম্ভীর মুখে স্তব্ধ হয়ে আছে যেন প্রায়! কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী তখন অসুস্থ অবস্থায় শান্তিনিকেতনে। ৩০শে জুলাই, ঠাকুরবাড়িতে বসে সকালবেলা কবি তাঁর আদরের মামণিকে (প্রতিমা দেবী) চিঠি লিখলেন। অতি কষ্টে নিজের কাঁপা হাতে চিঠির নীচে লিখলেন "বাবামশায়"। এটাই ছিল কবির জীবনে লেখা শেষ চিঠি। এই চিঠি পাওয়া মাত্র প্রতিমা দেবী কলকাতায় চলে আসেন।   



    রবীন্দ্রনাথ সমগ্র জীবনে যে পরিমাণ চিঠি লিখেছেন এ পর্যন্ত কোনো সাহিত্যিক এত চিঠি লেখেননি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি পেতেও যেমন ভালবাসতেন লিখতেও ভালবাসতেন তেমনই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল সাহিত্যকর্মের মতোই তাঁর চিঠিপত্রের সংখ্যাও বিপুল। সেগুলির সাহিত্যমূল্যের পাশাপাশি ঐতিহাসিক মূল্যও কম নয়। একবার ক্ষিতিমোহন সেন কে তিনি বলেছিলেন…

 

"আমার লেখার চেয়ে কম হবে না আমার চিঠি।" 


 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম চিঠি লিখেছিলেন তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, সম্ভবত ২৩ অগস্ট ১৮৭০ সাল। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ১০ বছর । আর শেষ চিঠি লেখেন ৩০ জুলাই ১৯৪১ সালে  পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে। রবি জীবনের প্রথম ও শেষ রেল যাত্রার মতোই 

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকেই তিনি প্রথম চিঠি লিখেছিলেন এবং শেষ চিঠিটিও লিখেছিলেন এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বসেই। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা প্রায় আট হাজার... যার বেশিরভাগই এখনও অপ্রকাশিত। 


   যাইহোক, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আজ অর্থাৎ ৩০ শে জুলাই ১৯৪১সাল.. হাসপাতালের রূপ নিয়েছে। সকাল থেকেই চলছে তোড়জোড়… আজই অপারেশন হবে রবীন্দ্রনাথের। কবি তখনও সেকথা জানেন না।  সবকিছু আয়োজন চলছে নিঃশব্দে। পূবের বারান্দার দক্ষিণ দিক ঘেঁষে অপারেশনের টেবিল সাজানো হয়েছে। সাদা রঙের পর্দা টাঙিয়ে অপারেশন টেবিল আড়াল করা হয়েছে।

   

      পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কবি জিজ্ঞেস করলেন, "কবে অপারেশন হবে"।  কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাল-পরশু’।  ডা. ললিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবির ঘরে এলেন একটু পরে। বললেন… "আজকের দিনটা ভালো আছে। আজই সেরে ফেলি, কী বলেন?"  চিরদিন ছুরি কাঁচির ভয়ে অপারেশন এড়িয়ে গেছেন….হকচকিয়ে গেলেন কবি। খানিক থেমে বললেন,..... "আজই! তা ভালো। এ রকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।"  


   এদিন সকালে "আপন আলোকে অন্তর ধৌত" করে লিখলেন তোমার সৃষ্টির পথ কবিতাটি। মুখে মুখে বলে গেলেন…. লিখে নিলেন রাণী চন্দ। রাণী চন্দকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখালেন তাঁর সর্বশেষ সৃষ্টি….  


     "তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি 

             বিচিত্র ছলনাজালে 

                  হে ছলনাময়ী!

   মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে 

                  সরল জীবনে!…."


   তারপর চিরদিনের মতো থেমে গেলো সে কলম....  আমাদের জন্যে "শেষ পুরস্কারের" ডালা সাজিয়ে বিশ্বকবি পেলেন শান্তির অক্ষয় অধিকার



     বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসা বিশ্বজয়ী কবির কলম চিরদিনের মতো থেমে গেল ১৯৪১ সালের ৩০শে জুলাই  'শান্তির অক্ষয় অধিকার' নিয়ে।

                    …………………


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...