Tuesday, 7 November 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪৩

 


রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব -৪৩

সকল গানের ভাণ্ডারী

মহাশ্বেতা দাস 


   "আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি 

               আমার যত বিত্ত প্রভু 

       আমার যত বাণী সব দিতে হবে।" 


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের সমস্ত শাখায় রবীন্দ্র প্রতিভা হিমাদ্রি চূড়ার মতোই জাজ্বল্যমান। তবুও বিশ্বের দরবারে তাঁর অন্যান্য সৃষ্টি অপেক্ষা সঙ্গীত স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ বেশী মাত্রায় মনোগ্রাহী। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম মূল্য হারালেও সঙ্গীত কালজয়ী গরিমা লাভ করবে। 

   

       "আজি হতে শতবর্ষ পরে

   কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি 

                কৌতূহলভরে 

       আজি হতে শতবর্ষ পরে!" 

    

রবীন্দ্রজন্মের পর পেরিয়ে গেছে দেড়শোটি বছর৷ সার্ধ শতবর্ষ পরেও কতটা প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্র সঙ্গীত? সে প্রশ্ন  জরুরি মনে হতেই পারে৷ কিন্তু এত বছর পেরিয়ে গেলেও আজও  মনে হয়না রবীন্দ্রসঙ্গীত তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে৷ বরং  বারেবারে বাঙালি মননকে ঋদ্ধ করছেন, আপ্লুত করছেন সেই রবীন্দ্রনাথ৷ লালন ফকির যাঁর প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সত্যদ্রষ্টা বাউল৷'


রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীলতার নেশায় একের পর এক গান রচনা করেছেন এবং সেই গানের সুরও দিয়েছেন  তাৎক্ষণিক। কিন্তু যে মানুষটি রবীন্দ্রনাথের এই কালজয়ী সৃষ্টিকে সংরক্ষণ ক’রে অনাগত কালের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি শান্তিনিকেতনের সবার প্রিয়  "দিনু দা"  আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "সকল গানের ভাণ্ডারী"। তাঁর সম্বন্ধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন…..


“তার (দিনেন্দ্রনাথ) চেষ্টা না থাকলে আমার গানের অধিকাংশই বিলুপ্ত হত। কেননা নিজের রচনা সম্বন্ধে আমার বিস্মরণ শক্তি অসাধারণ। আমার সুরগুলি রক্ষা করার এবং যোগ্য এমনকি অযোগ্য অপাত্রকে সমর্পণ করা তার যেন সাধনার বিষয় ছিল। তাতে তার কোন দিন ক্লান্তি ধৈর্যচ্যুতি হতে দেখিনি”।

        

শান্তিনিকেতনের সবার প্রিয়  "দিনু দা" আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "সকল গানের ভাণ্ডারী" দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুরের পৌত্র অর্থাৎ দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র। ১৮৮২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি তে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 

       

প্রেসিডেন্সি কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে ১৯০৪ সালে আইন নিয়ে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে গেলেও পাঠ সমাপ্ত না করেই দেশে ফিরে আসেন... তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌঁছে গেছেন জীবনের শেষ লগ্নে.. এসে গেছে "মেঘের পালা সাঙ্গ" করবার সময়। ১৯০৬ সালে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার লন্ডনে যান.... কিন্তু প্রথাগত শিক্ষা কী বাঁধতে পারে এসব প্রতিভা কে!! ছকে বাঁধা জীবনে সৃষ্টিশীলতার ছন্দ কোথায়!!! আবার পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসেন তবে এবার পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তালিম নিয়ে এসেছেন বটে। 

     

সম্পর্কে নাতি হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। দিনেন্দ্রনাথ প্রায় বেশিরভাগ সময়ই রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ গান লিখে সেই গানে সুর দিলে দিনেন্দ্রনাথকে বলতেন শিখে নিতে। রবীন্দ্রনাথ সংশয়ে থাকতেন, গানের যে সুর তিনি করেছেন তা হয়তো তিনি ভুলে যাবেন! তাই তিনি এই বিষয়ে দিনেন্দ্রনাথের উপর ভরসা করতে ভালোবাসতেন। কবিকন্যা মীরা কথায়….

 "বাবা নতুন নতুন গান তৈরি করে তখনই দিনুকে ডেকে পাঠাতেন, পাছে সুর ভুলে যান।" জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে কবিগুরু এই বিষয়ে বলেছিলেন…. "আমার মুশকিল এই যে সুর দিয়ে আমি সব ভুলে যাই। দিনু কাছে থাকলে তাকে শিখিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ভুলতে পারি,।"

 

গান শেখার জন্য দিনেন্দ্রনাথের উৎসাহছিল অন্তহীন। একবার ডাক পেলেই হল….হাজির হতেন তখনই। এইভাবে একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথের গানের বিশাল ভাণ্ডার নিজ আয়ত্তে নিয়ে আসেন দিনেন্দ্রনাথ। সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তাঁর সকল গানের ভাণ্ডারি হচ্ছেন দিনেন্দ্রনাথ। নিজের উদ্যোগেই বেশিরভাগ রবীন্দ্র সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরী করেছিলেন এবং সেগুলি সংরক্ষণের উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। ২৫ বছর বিশ্বভারতীর সঙ্গীত শিক্ষকের ভূমিকা দায়িত্ব সহকারে পালন করেছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথের গান কে "রবীন্দ্র সঙ্গীত" বলে তিনিই  পরিচিতি দেন। ভীমরাও শাস্ত্রী, নকুলেশ্বর গোস্বামী এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছিল সঙ্গীত ভবন। 


রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরের বহু নাটকে অসামান্য অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "ফাল্গুনী" নাটকের উৎসর্গ পত্রে তাঁকে…. 

"সেই বালকদলের সকল নাটের কাণ্ডারি, আমার সকল গানের ভাণ্ডারী"  আখ্যায় অভিহিত করেন। 


শান্তিনিকেতন ছিল দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রাণ। তবু এই প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, কবি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ দিকে একান্ত অপমানিত হয়েই বিশ্বভারতীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে চলে এসেছিলেন।  এক্ষেত্রে কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খামখেয়ালী মন অনেকখানি দায়ী। 


জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের শিশুদের স্মৃতিতে উদ্বেলিত ছিল তাঁর হৃদয়। ১৯৩৫ সালের ২১শে জুলাই অমৃত লোকে পাড়ি দেন এই মহান মানুষটি। 

              ………………. 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...