Wednesday, 15 November 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ৯

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ৯

গোপাল টকিজ – পলশপাই, দাসপুর - ২ ব্লক 

শ্রীজিৎ জানা 


কংসাবতী নদী কাপাসটিকরির ( কেশপুর )  কাছে দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেল। পুব পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে, জলের ভাগে কেউ যেন একচোখেমি করেছে। এখানেই শেষ নয়, নাম ছিল কংসাবতী, অম্নি হয়ে গেল কাপাসটিকরি খাল। আরো কয়েকশ মিটার পুবে এসে পুনরায় দু'ভাগে ভাগ হল জলধারা। একভাগের নাম হল দুর্বাচটি খাল নাম নিয়ে শ্রীবরার ( দাসপুর ২ ব্লক) কাছে মিশেছে রূপনারায়ণে। অন্যভাগ পলশপাই খাল রূপে রূপনারায়ণের দিকে 'মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর'! হায়রে কংসাবতী! হায়রে আদুরিনী কাঁসাই তোর নদী নামের গৌরবটুকু তোর কাছ থেকে কেড়ে নিল সব্বাই। এমন কি তোর নাম পরিচয়টুকুও মুছে দিল নিষ্ঠুর ভাবে। এখন তুই নদী নোস্,কারো কাছে দুব্বাচটিখাল,কারো কাছে পলশপাইখাল।

ভাবছেন কেমন বেয়াক্কেলেপনা! সিনেমাহলের কথাকে নদীর জলে নামিয়ে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছি কাঁহাতক! একথা এক্কেবারেই সত্যি না,মশাই। কাদার প্রলেপ লাগানোর আগে প্রতিমার খড়ের কাঠামো বানাচ্ছিলাম মাত্র। আসলে এবারের সিনেমাহল কাঁসাই থুড়ি পলশপাইখালের দক্ষিণ পাড়ের গোপাল টকিজ। আরো একখানা মিল আছে নদীর সাথে। কংসাবতীর নাম যেমন বাঁকে বাঁকে বদলেছে,একইভাবে সিনেমাহলের নামেও বারবার বদল এসেছে। কখনো নাম হয়েছে পদ্মা টকিজ, কখনো সুভাষিণী টকিজ আবার কখনো গোপাল টকিজ। নিশ্চিত এই নামাবলী পড়ে গান ধরেছেন 'একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে'। আরে মশাই, মহাজনের বাক্যে মনোনিবেশ করুন – নামে কি আসে যায়!  হোয়াটস্ ইন এ নেম্! গোলাপকে যে নামেই ডাকুন,গোলাপ সুন্দর। পদ্মা, সুভাষিণী, গোপাল,সবই সুন্দর। তবে সবার চেয়ে চমৎকার সিনেমাহল শুরুর গল্প। ওরে বাবা! গল্প নয়, সত্যি ঘটনা।


পলশপাই গ্রামে এক কালে জমিদার ছিলেন সত্য দাশঠাকুর। তাঁর দাপটে নাকি বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। সেই সত্য জমিদার একবার তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে মেলা দেখতে যান জোতঘনশ্যাম (দাসপুর ২ ব্লক)  গ্রামে। মেলায় নাকি ভ্রাম্যমাণ সিনেমাহলে সিনেমা দেখানো হচ্ছিল। ছোট্ট দুই মেয়ে বায়না ধরে সিনেমা দেখার। সেই সময়ে ওই ধরণের চলন্তিকা মেলাতে বসত। তাতে সিনেমা দেখার আকর্ষণ কম ছিল না। সত্য জমিদার বিনা টিকিটে চলন্তিকায় মেয়েদের সঙ্গে নিয় সিনেমা দেখতে ঢুকতে চায়। বাধা দেয় গেট কিপার। আত্মসম্মানে লাগে জমিদারের। তাঁর মতো জমিদার টিকিট কেটে ছবি দেখবে! আর তাঁকে বাধা দেবে সামান্য একটা গেটকিপার! মেয়েদের নিয়ে তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে চলে আসেন। আর মেয়েদের জানিয়ে দেন আগামীকাল থেকেই শুরু করবেন সিনেমাহল তৈরীর কাজ। দাসঠাকুর জমিদারের মুখের কথাকে হাকিমও টলাতে পারে না। কাঠের কাঠামোতে ঝিটাবেড়ার দেওয়াল তুলে পলশপাইখালের দক্ষিণে বাঁধের কোলে পুব-পশ্চিমে লম্বা সিনেমাহল তৈরী করলেন। যেই দুজন মেয়েকে নিয়ে মেলার চলন্তিকা থেকে সিনেমা না দেখে ফিরে এসেছিলেন,তাদের মধ্যে বড় মেয়ে পদ্মার নামে সিনেমাহলের নাম রাখলেন 'পদ্মা টকিজ'। আনুমানিক পঞ্চাশে দশকের গোড়ার দিকে (১৯৫১–৫২) নির্বাক চলচিত্র দিয়ে পদ্ম টকিজের জনযাত্রা শুরু হয়। এই টকিজের নির্দিষ্ট কোন শো - টাইম ছিল না। স্থানীয় অনেক প্রবীণ মানুষদের মতে একটা টাইমে বিশেষ করে বিকাল পাঁচটায় একটা শো হত। তখন ইলেকট্রিক না থাকায় জমিদারের ধানকলের ডিজেন ইঞ্জিনের মাধ্যমে প্রোজেক্টর চলত। 'পদ্মা টকিজ' কয়েক বছর চলার পরে ঝড়- বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জমিদার সত্য দাসঠাকুরের বয়স তখন অনেকটাই। কিন্তু মাথা থেকে সিনেমাহল করার নেশা কিছুতেই যায় না। চার ছেলের মধ্যে ভীমচরণ এবং অর্জুনের মাথায়ও সিনেমার ভূত চেপে বসে। যাকে বলে বাপকা বেটা, সিপাহীকা ঘোড়া। ব্যস্, দুয়ে দুয়ে চার হল। আবার গড়ে উঠল সিনেমাহল।  এবার যেহেতু ছেলেরা মেইন ভূমিকায় এগিয়ে এল,সেইহেতু তারা মায়ের নামে অর্থাৎ সত্য দাসঠাকুর মহাশয়ের স্ত্রীর নামে সিনেমাহলের নাম রাখলেন 'সুভাষিণী টকিজ"।


রমরমিয়ে চলতে থাকে 'সুভাষিণী টকিজ' -এর শো। এবারেও মাটির দেয়াল আর টিনের ছাউনির প্রক্ষাগৃহ। পর্দার সামনে দর্শরা বসতেন মাটিতে খড় বিছিয়ে। তারপর বাঁশের খুঁটি পুঁতে কাঠের পাঠাতন বিছানো সিট থাকত। সব শেষে থাকত কাঠের ঠেস বেঞ্চ। সাধারণত তিনটা ও ছ'টার শোতে ছবি দেখানো হত। জমিদার সত্য দাসঠাকুর প্রকৃতপক্ষে ব্যাবসায়ী মনোবৃত্তি নিয়ে সিনেমাহল করেন নি।  এলাকার মানুষদের মনোরঞ্জন করা ছিল তাঁর বিশেষ উদ্দেশ্য।  হয়তো এর নাম জমিদারী খেয়াল। যেই খেয়াল তাঁর ছেলেদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। সিনেমাহল পার্শ্ববর্তী পাড়ার লোকজনদের দর্শনী টিকের মুল্য নিতেন না। আর দূর দূরান্তের দর্শকদের জন্য পর্দার সামনের সারির টিকিট মূল্য ছিল ১৯ পয়সা, পাটাতনের আসনের জন্য ধার্য ছিল ৪০ পয়সা ও ৫০ পয়সা। একেবারে শেষের ঠেস বেঞ্চের টিকিট মূল্য ছিল ১.৫০ পয়সা। মদন দাস ছিলেন 'সুভাগিনী টকিজ' এর ঘোষক। অদ্ভুত তাঁর প্রচারের কৌশল। পায়ে হেঁটে পাড়ায় পাড়ায় হেঁকে বেড়াতেন। তাঁর পিঠে ঝুলানো থাকত চটের বস্তায় চিটানো পোস্টার, পায়ে তাঁর বাঁধা থাকত ঘুঙুর। ঝমঝম শব্দ করে মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করতেন। বিশেষ করে নবীনমানুয়া ( দাসপুর ২ ব্লক )  এবং জোতঘনশ্যাম  ( দাসপুর ২ ব্লক )  হাটের দিনগুলোতে মদন দাস ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অ্যানাউন্স শুরু করতেন এই বলে, " আমি মদন বলছি.. "। তাঁর কন্ঠস্বর শোনামাত্রই ভিড় কান খান খাড়া করে শুনতেন সিনেমার নাম। সুভাষিনী টকিজে বেশ কয়েকটি বই হাউসফুল হয়। সীতাপুর গ্রামের বিশিষ্ট গদ্যকার প্রবীর রায় মহাশয় জানান, " নল দময়ন্তী, বিদ্যাসাগর, সুভাষচন্দ্র সিনেমাগুলিতে মারাত্মক ভিড় হতে দেখা যায়।  এমনকি 'পথে হল দেরি' সিনেমা চলাকালীন একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। ওই সিনেমার জনপ্রিয়তার কথা ভেবে সিনেমাহল মালিকের কাছ থেকে কয়েকজন উৎসাহী যুবক এক সপ্তাহের জন্য হল লিজে নেন। দর্শক টানতে তারা এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকিট সেল করে"। সুভাষিণী টকিজ- এর আরো একটি বিশেষ ঘটনার কথা জানালেন দাসঠাকুর পরিবরের জনৈক প্রবীণ,-- " 'বিদ্যাসগর' সিনেমা যখন দেখানো হয় তখন প্রত্যেক দর্শককে টিকের সঙ্গে একটি করে লেখার খাতা দেওয়া হয়েছে। খাতার উপরের পাতায আঁকা ছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ছবি"। প্রসঙ্গত সীতাপুর গ্রামের বিশিষ্ট প্রধান শিক্ষক সুব্রত বুড়াই জানালেন সুভাষিণী টকিজে সিনেমা দেখার স্মৃতি–" একাধিক সিনেমা দেখার স্মৃতি রয়েছে ওই সিনেমাহলে। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বিদ্যাসগর ছবি দেখতে গেছি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে, তাও বাড়ির লোকদের না জানিয়ে। তখন কেবল পাঁচটার শো হত হলে। হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলে ফিরতে রাত হয়। তারপর যা হওয়ার তা হল,কাকার হাতে উত্তমমধ্যম খেলাম। এর পরে 'পলাতক','শাপমোচন',  'বনপলাশীর পদাবলি প্রভূতি সিনেমা দেখেছি"। সুভাষিণী টকিজের সময়কাল নানা ঘটায় মোড়া। বিভিন্ন সময়ে যন্ত্র বিভ্রাটের দরুণ তুমুল উত্তেজনা হয়েছে সিনেমা চলাকালীন। ভাযচুর হয়েছে পর্যন্ত। এমনকি শেষ মুহুর্তে মেশিন খারাপ হওয়ায় টিকিটের মূল্য ফেরত দিতে হয়েছে। এরই মাঝে হঠাৎ করে সুভাষিনী টকিজ বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে বলেন ঠিকমতো আয়- ব্যয়ের হিসেব না রাখায সিনেমাহল চালাতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করতে হয়। সেই কারণে সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয মালিকপক্ষ। 


কিন্তু ওই 'বৃথা আসা মরিতে মরিতেও মরে না' বলে যে কথা চালু আছে খানিকটা সেইরকম হল। আবার সিনেমাহল গড়লেন দাসঠাকুর পরিবার। এবার ভীমচরণ এবং অর্জুন দাসঠাকুর তৈরি করলেন 'গোপাল টকিজ'। কংক্রিটের দেয়াল তুলে টিনের ছাউনি দিয়ে পাকাপাকি ভাবে শুরু হয়। শুরুর সাল ১৯৮৩। নাম দিলেন গোপাল টকিজ। দাসঠাকুর পরিবারের কুলদেবতা গোপাল জিউ - এর নামে সিনেমাহলের নামকরণ করেন। প্রথম ছবি 'ডাক্তার বউ'।  ফাটাফাটি ভিড় হয় প্রথম সিনেমায়। গোপাল টকিজে ব্যালকনি মিলিয়ে দর্শক আসন ছিল সাতশ। প্রায় ১৫ জন স্টাফ কাজ করত হলে। মহিলা ও পুরুষদের আলাদা বসার ব্যাবস্থা ছিল। সেভেন্ট টু মিলিমিটারের ছবি পড়ত পর্দায়। এবার মেশিনপাতি সবই ছিল নিজস্ব। সুন্দর চেয়ারে সাজানো হল। শেষের দিকে  ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটের সূল্য ছিল যথাক্রমে ৮ টাকা ও ১০ টাকা। ব্যালকনির টিকিটের মূল্য ছিল ১৩ টাকা। 'গুরুদক্ষিণা ' সিনেমা সেইসময় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার যে তিনটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় তার মধ্যে একটি হল গোপাল টকিজ। টানা একমাস চলে এই সিনেমা। এই গুরুদক্ষিণা সিনেমা গোপাল টকিজে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে অর্জুন দাসঠাকুরকে সহযোগিতা করেন ভবেশ কুন্ডু মহাশয। একইভাবে 'আমার মা', 'ছোট বউ', 'মান মর্যাদা','পুতুলের প্রতিশোধ' প্রভূতি ছবিগুলি গোপাল টকিজে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে। ভীম দাসঠাকুর ছিলেন চিফ্ অপারেটর। বারটা,তিনটা ও ছ'টার শো চলত গোপাল টকবজে। এই সিনেমাহলকে কেন্দ্র করেই পলশপাই খালের উপর সিনেমাহলের সোজাসুজি চালু হয় খেয়া পারাপার। সেই থেকে আজও নাম রয়ে গেছে সিনেমাঘাট। কিন্তু গোপাল টকিজ বন্ধ হয়ে গেছে ২০০১-০২ সাল নাগাদ। শেষ ছবি ছিল 'ভালবাসা ভালবাসা'। নাহ্, সেই জমিদারী নেই। সিনেমাহল প্রতিষ্ঠাতারাও কেউ বেঁচে নেই। জরাজীর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোপাল টকিজ। সেই পরিত্যক্ত ঘরে এখন ভাড়ায় থাকেন মুর্শিদাবাদ থেকে আগত জনৈক ভদ্রলোক। কঙ্কালসার সিনেমাহলের অন্দরমহলের ছবি ক্যামেরাবন্দী করতে ঝুঁকি নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই ভদ্রলোক বলে ওঠেন,-- "দাদা ভিতরে যাবেন নে। কিস্যু নেই। কবেই বন্ধ হয়ে গেসে হলখানা।


তথ্যসূত্র :—

শ্রী প্রবীর রায় - সীতাপুর

শ্রী সুব্রত বুড়াই - সীতাপুর

শ্রী গনেশ মান্না – সীতাপুর

শ্রী প্রদ্যোৎ রায় – সীতাপুর

শ্রী দেবাংশু ভূক্তা - পলশপাই

শ্রী আশুতোষ মাইতি - পলশপাই।

                  ……………………. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...