রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৪৪
আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার
মহাশ্বেতা দাস
"দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়।।"
সারা জীবন ধরে বিশ্ববাসীর মনের ভার লাঘব করেছেন বিশ্বকবি। ব্যক্তিগত জীবনে নিরন্তর যন্ত্রণা ভোগ করেও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, উল্টে বলেছেন….
"পুণ্য সঞ্চয় করলেই স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে এই কথাই চলতি কথা; কিন্তু আমি বলছি যে, আমি স্বর্গ থেকেই পুণ্যের জোরে মর্তে নেমে এসেছি।"
তবু আজ যখন (১৯৪১সালের শ্রাবণ মাস)
"সময় হয়ে এল এবার,
স্টেজের বাঁধন খুলে দেবার।"
এ বাঁধন তো আজকের নয়, সেই শিশুকালে পিতৃদেবের সাথে হিমালয় ভ্রমণে বেরিয়ে প্রথম ভুবন ডাঙায় আসা.... তারপর পরিণত বয়সে সারা বিশ্ববাসীকে এক ছাদের তলায় নিয়ে আসার ভাবনা নিয়ে "বিশ্বভারতী"র সৃষ্টি। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে একটি একটি ভালবাসার ফুল দিয়ে, আন্তরিকতা আর স্নেহ মমতার সুতোয় গাঁথা হয়েছে যে মালা, তাকে খুলে দেওয়া তো সহজ কথা নয়।! সে মালার বাঁধন ছিঁড়তে গেলে তো বাজবেই!
১৯৪০ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে কালিম্পংয়ে পুত্রবধু প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কালিম্পংয়ে ২৬শে সেপ্টেম্বর রাতে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিতে ছুটে এলেন দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন। রক্ত পরীক্ষার পর জানা গেল প্রস্টেট গ্ল্যান্ডে সমস্যা…. দ্রুত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কলকাতা থেকে চিকিৎসক নিয়ে এলেন কালিম্পংয়ে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথকে কলকাতায় নিয়ে আসা হলো….. প্রায় এক মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। একটু সুস্থ হলে কবি ফিরে যেতে ব্যকুল হলেন প্রাণপ্রিয় শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনে কবির থাকার ব্যবস্থা হলো উদয়ন ঘরে….. এবং সবসময় দেখাশোনার জন্য রইলো চিকিৎসক ও নার্স। রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লিখতে পারেন না আর….. তাই বলে লেখনী কি থেমে থাকতে পারে!!!! কবি মুখে মুখে বলে চলেন কবিতার লাইন আর শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সচিব অনিলকুমার চন্দের স্ত্রী ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা রাণী চন্দ খাতা কলমে লিখে রাখেন কবির সেই সময়ের অমর সৃষ্টি।
কিন্তু কোন চিকিৎসাতেই আর তেমন কোন সাড়া মিলছে না। কবির শরীরের অবনতি হচ্ছে ক্রমশঃ। কলকাতা থেকে ডাক্তার ইন্দুভুষণ বসু, বিধানচন্দ্র রায়, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও পারিবারিক বন্ধু জ্যোতিপ্রকাশ সরকার এলেন শান্তিনিকেতনে । আলোচনার এক পর্যায়ে বিধানচন্দ্র রায় রবীন্দ্রনাথকে বললেন, 'আপনি আগের থেকে একটু ভালো আছেন। সে কারণে অপারেশনটা করিয়ে নিতে পারলে ভালো হবে, আর আপনিও সুস্থ বোধ করবেন।' সবাই অপারেশনের পক্ষে মত দিলে রবীন্দ্রনাথ সবার অনুরোধে রাজি হলেন। এরপরই সিদ্ধান্ত হলো রবীন্দ্রনাথের অপারেশন করা হবে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে। ১৯১৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করছিলেন কবির বন্ধুবর বিখ্যাত চিকিৎসক অধ্যাপক নীলরতন সরকার। বিশেষভাবে উল্লেখ্য চিকিৎসক নীলরতন সরকারও চাননি এই বয়সে অপারেশন হোক রবীন্দ্রনাথের…… রবীন্দ্রনাথ অপারেশন পরবর্তী ধকল নিতে পারবেন না বলেই তাঁর ধারণা। তাই তিনি ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন। হঠাৎ ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ায় গিরিডিতে চলে যান তিনি এবং গিরিডিতে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন। ওনাকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলো অস্ত্রপ্রচারের। ভারাক্রান্ত মনে সায় দিলেন কবি।
"খেলনা খোকার হারিয়ে গেছে,
মুখটা শুকনো।
মা বলে দেখ,
ওই আকাশে আছে লুকোনো।"
১৯৪১সালের ২৪শে জুলাই সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কথায়….
"বিকেলের দিকে সঙ্গীত ভবনে বসে আছি। হঠাৎ করেই খবর পেলাম যে, কালই (২৫শে জুলাই) গুরুদেব কে অপারেশনের জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। মনে আছে- বিকেলের পড়ন্তবেলা, দিনের শেষে পশ্চিমের আকাশে রবি ঢলে পড়েছে। আর ঠিক সেই সময় আমাদের সবার পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রাণের রবি ঠাকুরের আশ্রম ছেড়ে কলকাতা যাত্রার খবরে মনটা কেমন উদাস ও বিষণ্ণ হয়ে গেল। তাই মনে মনে ঠিক করলাম যে, আমরা বৈতালিকের গানে গানে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দেবো।"
কিন্তু আজ কবির চোখে ঘুম এলে তবে তো ঘুম ভাঙানো...!! সারা জীবন ধরে এতো বিচ্ছেদ বেদনা সহ্য করেছেন। এই বোধয় কবি জীবনের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিচ্ছেদবেদনা!!
"পথে চলা এই দেখাশোনা
ছিল যাহা ক্ষণচর
চেতনার প্রত্যন্ত প্রদেশে,
চিত্তে আজ তাই জেগে ওঠে;
এই সব উপেক্ষিত ছবি
জীবনের সর্বশেষ
বিচ্ছেদবেদনা
দূরের ঘণ্টার রবে
এনে দেয় মনে।।"
………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment