রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৪০
রাণু ও ভানু
মহাশ্বেতা দাস
"সময় যদি ফুরিয়ে থাকে...
হেসে বিদায় করো তাকে,
এবার না হয় কাটুক বেলা
অসময়ের খেলা খেলে॥"
রবীন্দ্রনাথের জীবনে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে বহুগুণ। নোবেল প্রাপ্তি দেশ কালের সীমা ছাড়িয়ে এক লহমায় তাঁকে গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক কবি। সারা বিশ্বের কাছে তখন তিনি বিরাট ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বিশ্বকবি। তাই নিত্য দিন যাপনে তাঁর কাছে যেমন নানা মানুষের অসংখ্য অনুরোধ, উপরোধ নিয়ে আনাগোনা চলেছে, তেমনই দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে অজস্র চিঠি। এমনই এক ব্যস্ত সময়ে, ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে তাঁর কাছে এসে পৌঁছল একটি অভিনব চিঠি….. যে চিঠি পড়ে বিশ্বকবি রীতিমত থমকে গেলেন! এমন চিঠি এর আগে তো কখনও পাননি !!
কবিকে "রবিবাবু" সম্বোধন করেছেন চিঠি লেখক। চিঠিতেই কবির কাছে জানতে চেয়েছেন তাঁরই লেখা কোনও গল্পের মানে। আবার কোনও গল্পের পরিণতিকে বদলে দেওয়ারও পরামর্শ রয়েছে সেই চিঠিতে। তখনও অবধি রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ তাঁর পড়া হয়েগেছে। আর তাই "রবিবাবু" কে তাঁর "খু-উ-উ-উ-উব" দেখতে ইচ্ছে করছে! কবি কে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েই ক্ষান্ত নয়... লোভ দেখিয়েছেন তিনি এলে তার পুতুলও দেখাবেন। চিঠিটি এসেছে কাশী থেকে …..লেখকের নাম শুধুই "রাণু"।
ছাপান্ন বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথকে এভাবেই চিঠি লিখলেন একাদশ বছরের কিশোরী রাণু অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ তখন খ্যাতির শীর্ষে। তবুও সেদিনের সেই কিশোরীর অমোঘ ডাক কিছুতেই ফেরাতে পারলেন না। এই বয়সে চরম ব্যস্ততার দিনে এমনই অভিনব চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ চিনলেন চিঠি লেখককে। ভেবেও ছিলেন উত্তর দেবেন সময় করে। রাণুর পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় অবশ্য আগেই ঘটেছিল। কিন্তু মুশকিল হলো সেই চিঠি যত্ন করে রাখলেও উত্তর লেখার সময় খুঁজে পাওয়া গেল না চিঠিটি ! তারপর একদিন হঠাৎ করেই ডেস্কের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল। ব্যস্… তারপরেই শুরু হয়ে গেল স্নেহ ও কৌতুকে ভরা অভিনব এক রবীন্দ্রপত্রধারা, যে ধারায় সিক্ত হয়ে আমরা দেখা পাই অন্য এক রবি ঠাকুরের।
" আমার আপনার জন্য মন কেমন করে…।"
রবিবাবু কে দেখার জন্যে বড়ই উদগ্রীব রাণু। শুধু চিঠি লিখে মন ভরে না কিশোরীর। অপেক্ষার অবসান হলো। ১৯১৮ সালের মে মাসে সপরিবারে কলকাতা এলেন রাণুর বাবা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ফনিভুষণ অধিকারী। রবীন্দ্র-জীবনও সেই সময় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে টালমাটাল। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন, কী ভয়ঙ্কর মৃত্যুপরম্পরা বৈতরণী তিনি পার হয়েছিলেন। কয়েক বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যা রাণু এবং কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রকে হারিয়েছিলেন। তাঁর ভরা সংসার ভেঙে চুরমার হয়েগেছিল। আর এই মুহূর্তে আরও এক মৃত্যুর মুখোমুখি…..মৃত্যুশয্যায় দিন গুনছে কবির পরম আদরের কন্যা বেলা। তাই রবীন্দ্রনাথের পিতৃ হৃদয়ে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে হঠাৎই ফণিভূষণের কন্যা রাণু যেন রবীন্দ্রনাথের সেই হারিয়ে যাওয়া ‘রাণু’ হয়ে ফিরে এল। প্রথম চিঠির উত্তরেই লিখলেন, “তোমার নামটি খুব মিষ্টি। আমার একটি মেয়ে ছিল, তাকে রাণু বলে ডাকতুম, কিন্তু সে এখন নেই।” এই শূন্যতাই রাণু অধিকারী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯১৮ সালের মে মাসে ফণিভূষণ অসুস্থ হয়ে কলকাতায় সপরিবারে এলেন চিকিৎসার জন্য। কলকাতায় এসে তাঁরা উঠলেন ভবানীপুরের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে। পরের দিনই সেই বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে রাণু রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন…..
“আপনি মঙ্গলবার দিন সন্ধ্যাবেলা নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ি আসবেন। নয়ত জন্মের মতন আড়ি।”
রবীন্দ্রনাথ রোজ একবার করে কন্যা বেলা কে দেখতে যান। সেদিনটি ছিল ১৯১৮ সালের ১৬ই মে। সেদিনও গেলেন মেয়েকে দেখতে…. কিন্তু দরজা পেরিয়েই খবর পেলেন বেলা আর নেই! মুখোমুখি হতে পারলেন না বেলার মৃতদেহের। উপরে উঠলেন না আর.….. ফিরে এলেন ওখান থেকেই। সোজা চলে গেলেন ভবানীপুরের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে। বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই দৌড় এসে দরজা খুলে দিলেন প্রগলভ কিশোরী রাণু। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনের চরম বেদনার দিনে মুখোমুখি হলেন রাণুর। পারস্পরিক নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে গেলেন ছাপান্ন বছরের রবির জীবনে এগারো বছরের রাণু।
প্রথম চিঠির "রবিবাবু" সম্পর্কের নিবিড়তায় আর চিঠি আদান প্রদানে ক্রমশঃ বদলে হলেন "ভানুদাদা"। রাণু এখন বেশ শাসন করে চিঠি লেখেন….
"শুনুন আপনি ভালো করে চুলটুল আঁচড়াবেন। কাপড়ও বেছে বেছে পড়বেন, দিনরাত লিখবেন না।"
প্রেমের গতি বিচিত্র। প্রেম… বয়স, জাত-পাত, স্থান, কাল, পাত্র কিছু মানে না। দুটি হৃদয় কোন কিছু বিচার না করে কখন একে অন্যের নিকটে এসে যায় আমরা বুঝতে পারিনা। কবিও তাই বলেছেন…
"প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে —“
রাণুর যৌবনের শ্রেষ্ঠ বসন্তের দিনগুলি শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাঁকে ভালবেসেই কেটে গিয়েছিল। একে অপরের প্রতি ভালবাসায় কোন অস্পষ্টতা ছিল না। শিলং পাহাড়ের পথে রবীন্দ্রনাথকে দিনের পর দিন ভ্রমণরত অবস্থায় দেখা গেছে সপ্তদশী রাণুর সঙ্গে। শেষের কবিতার অমিত লাবণ্যর কাহিনী যেন রাণু ভানুরই প্রেম কাহিনী! বিসর্জন নাটকের অভিনয়ে বাষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ জয়সিংহর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আর রাণুকে অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয় করিয়েছিলেন।
কোন এক শরতের ভোরবেলা শান্তিনিকেতনের শিউলিতলায় আঁচল ভরে ফুল কুড়োচ্ছেন রাণু। রবীন্দ্রনাথ ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালেন…. "কে? রাণু?" আঁচল ভর্তি সব ফুল রাণু উজাড় করে ঢেলে দিলেন ভানুদাদার পায়ে। রবির শরৎসকাল মুহূর্তে হয়ে উঠলো যেন রূপকথার রাজ্য। ক্রমশঃ রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে রাণু শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রী থেকে সমস্ত আশ্রমবাসীদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। এখানকার পরিবেশ রাণুর মনে অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। একটু একটু করে বদলেছে দু’জনের মধ্যেকার চিঠির মেজাজও। শান্তিনিকেতনের সাথে এতটাই একাত্মতা গড়ে উঠেছিল যে, আশ্রমের অর্থকষ্ট মেটাতে তেরো বছর রাণু স্কুল থেকে পাওয়া ছাত্রবৃত্তির পুরো টাকাই দান করেদিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রমকে…. যা দিয়ে সুরেন্দ্রনাথের পরিকল্পনায় তৈরি হল আশ্রমের বিখ্যাত ঘণ্টাতলাটি।
"আবার তুমি ছদ্মবেশে
আমার সাথে খেলাও হেসে-
নূতন প্রেমে ভালোবাসি আবার ধরণীরে ॥"
একদিন নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সান্নিধ্য সেদিনের কিশোর রবির লেখনীকে দিয়েছিল "ভানুসিংহের পদাবলী" সৃষ্টির প্রেরণা। আর আজ এতো বছর বাদে সেই ভানু আবার ফিরে এলেন রাণুর টানে। রাণুর মুখাবয়বে ছিল কাদম্বরী দেবীরই প্রতিচ্ছবি। রবির জীবনে রাণু তাই এলেন অন্যরকম অনুভূতিতে। এ যেন অতীতের পর্দা সরিয়ে পাশে এসে বসলেন রবির জীবনের ধ্রুবতারা কাদম্বরী দেবী। অকালে চলে যাওয়া রবির প্রিয় বৌঠান যেন নব রূপে আবির্ভূত হলেন রবির জীবনের অপরাহ্নকালে! ভোরের তারা যেন রবির জীবনে সত্যিই ফিরে এল সাঁঝের তারার বেশে। রবীন্দ্রনাথ মোট ২০৮টি চিঠি লিখেছিলেন রাণু কে…. যেগুলি পরবর্তী সময়ে সংকলিত হয় "ভানুসিংহের পত্রাবলী" নামে।
১৯২৫ সাল….. ক্রমে রাণুর বয়স ১৯ বছর।
কলকাতার বিখ্যাত শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পুত্র বীরেন মুখোপাধ্যায়ের সাথে রাণুর বিয়ের প্রস্তাব এলো। প্রিয় রাণুর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ উপহার দিলেন আলমারি ভর্তি নিজের যাবতীয় লেখা আর সোনার কাসকেটে সাজিয়ে নিজের মাথার কয়েক গুচ্ছ চুল…. যে চুল ছিল রাণুর ভীষণ প্রিয়।
"আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে -
কিছুই কি নেই বাকি?"
জীবনের দোলাচলে সম্পর্কের বাঁধন খানিকটা শিথিল হলেও রবীন্দ্রনাথের শেষ শয্যায় শান্তিনিকেতনে ছুটে এসেছিলেন রাণু। অসুস্থ ভানুদাদার কষ্ট লাঘব করতে লেডি রাণুর উপহার স্বরূপ উদয়ন গৃহে রবীন্দ্র কক্ষে বসানো হলো এ.সি। আর রবীন্দ্রনাথ…..!! তিনিও আদরের রাণুকে উপহার দিলেন হোয়াইট মেটালের মাঝখানে বসানো চোখ ধাঁধানো নীলা আর তার চারপাশ জুড়ে আঠেরটি ছোট ছোট হীরে বসানো একটি আংটি।
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"
রাণু সারাজীবনে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন মোট ৬৮ টি। ২০০০ সালের ১৫ই মার্চ রাণু জীবনের মায়া কাটিয়ে না ফেরার পাড়ি দিলেন। মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথকে তিনি লেখেন তাঁর জীবনের শেষ চিঠি, হয়তো! যে চিঠিতে ধরা পড়েছে ভানু-রাণুর সম্পর্কের বৃত্ত। যে চিঠিতে ৯৪ বছরের এক নিঃসঙ্গ নারী রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন-
"আমার পনেরো বছর বয়সের শরীর তোমার চোখে ছিল ভরা পূর্ণিমা, তুমি সেকথা জানিয়েছ তোমার একটি গানে, ওই গানেই বলেছ আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন তুমি আমার ঘুমের সুবাস পাও। সে গন্ধ তোমার কাছে প্রথম আষাঢ়ের কেতকী ফুলের সৌরভের মতন। ভানুদাদা, পৃথিবীর আর কোনও পুরুষ কখনও আমার ঘুমের সুগন্ধ পায়নি!"
……………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment