রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৩৯
জাপানের পথে
মহাশ্বেতা দাস
"পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে,
যাবে না ফিরে-"
রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই বিশ্বসংস্কৃতির সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি মনে করতেন বিদেশের সোনার কাঠির স্পর্শে আমাদের সাহিত্যে, শিল্পে নূতন প্রাণের সঞ্চার সম্ভব।
"বঙ্কিম আনলেন সাতসমুদ্রপারের রাজপুত্রকে আমাদের সাহিত্য-রাজকন্যার পালঙ্ক শিয়রে।"
সেই রাজপুত্রের সোনার কাঠির স্পর্শে আমাদের বাংলা সাহিত্য মুক্তিলাভ করেছে কবির মতে।
১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তবে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিলে অন্যান্য দেশগুলি ভ্রমণ করেছেন ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর। এই ভ্রমণগুলি রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও মননে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে যার প্রভাব পড়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যে, সৃষ্টিশীলতায়।
যাইহোক নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথ তো আর শুধু ভারতের কবি নয়… তিনি তখন বিশ্বকবি। সারা বিশ্ব তখন রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে শুরু করলো আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ। তিনিও তো চিরচঞ্চল, সুদূরের পিয়াসী তিনি….. একজায়গায় বেশীদিন স্থির হয়ে বসে থাকা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই অধিকাংশ আমন্ত্রণেই সাড়া দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। দেশ বিদেশে গেছেন ; পরিচিত হয়েছেন বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব, বিদ্বজন ও রাজ-রাজড়াদের সাথে। বিদেশের বহু স্থানে, বহু বিদ্যায়তনে, বহু সভায় স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন এক দেশ থেকে দেশান্তরে। আর এভাবেই তিনি তাঁর কাব্য কবিতা, জীবনদর্শন এবং কাব্যের মর্মবাণী সরাসরি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। পরিচিত হয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে।
১৯১৬ সালের ৩ রা মে কলকাতা বন্দর থেকে চড়ে বসলেন জাপানি জাহাজ "তোসামারু" তে। কবির সঙ্গী এবারে এণ্ডরুজ, পিয়ার্শন এবং মুকুল দে। এখানে উল্লেখ্য বঙ্গোপসাগর দিয়ে সমুদ্রযাত্রা কবির এই প্রথম। যেদিন জাহাজ রেঙ্গুন বন্দরে এসে ভিড়লো… কবিকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যেতে সেদিন লোকে লোকারণ্য ছিল জাপানের জাহাজঘাট।
এদেশে এসে কবির অনুসন্ধিৎসু মন ছুঁয়ে যায় এখানের অনেক কিছুই। জাপানবাসীদের চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্য কবিকে প্রথম মুগ্ধ করেছিলো তা হলো সংযম। শোকে, দুঃখে, আঘাতে, উত্তেজনায় ওরা নিজেকে সংযত করতে জানে। এই সংযম কবি লক্ষ্য করেছেন ওদের সাহিত্য রচনাতেও। ওদের তিন পঙক্তির কবিতা কবি ও পাঠক উভয়ের জন্যই যথেষ্ট। জাপানে আসবাবহীন ঘরের সৌন্দর্যও কবিকে মুগ্ধ করেছিল….
"যে জিনিস যথার্থ সুন্দর তার চারিদিকে মস্ত একটি বিরলতার অবকাশ থাকা চাই।"
রবীন্দ্র সাগরে তাঁর লেখনী-স্রোত যেমন ছিল চির প্রবাহমান তেমনই রবীন্দ্র জীবনে নারী প্রবাহ ছিল নিরন্তর ,সে সতেরো হোক বা সত্তর। কখনো সে নারী মারাঠি মেয়ে আনা তড়খড়, কখনো বিলেতের লুসি স্কট, কখনও বা আর্জেন্টিনার ভিক্টোরিয়া। জাপানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এখানকার একটি বালিকা বিদ্যালয় দেখে পুত্র রথীন্দ্রনাথ কে লিখলেন - "জাপানি মেয়েদের উপর আমার ভক্তি বেড়ে গিয়েছে। আমি এমন মেয়ে কোথাও দেখিনি।"
জাপানের বিভিন্ন স্থানে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবি আমন্ত্রিত হয়ে যান…. বক্তৃতা দেন, স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন, মুগ্ধ হয়ে শোনেন ওখানকার ছাত্রছাত্রী থেকে অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক, সাহিত্যপ্রেমী জাপানবাসী। আর এভাবেই একদিন দেখা হয়ে গেল জাপানি তরুণী তোমি ওয়াদা কোরার সাথে। আজ সে গল্পই না হয় বলা যাক!
রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন পঞ্চান্ন আর তোমির বয়স কুড়ি। তোমির কলেজে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চে উঠলেন তাঁর একান্ত নিজস্ব কিছু উপলব্ধির কথা বলতে। তোমি তাকালেন সৌম্য সহাস পুরুষটির দিকে। এমন লাবণ্যময় কণ্ঠস্বর, এমন কথা, দীপ্ত উচ্চারণ আগে শোনেননি তোমি। বয়সের তফাত যে পঁয়ত্রিশ বছরের একথা তৎক্ষণাৎ মনে স্থান পেলো না তোমির। ভুলে গেলেন দুজনের সামজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। পার্থিব বিভেদ রেখা কি সবসময় মন কে তার গণ্ডিতে আবদ্ধ করতে পারে!! প্রেম দেখা দিলো মহাসমারোহে। বছর কুড়ির জাপানি মেয়েটি এক অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়লেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
এমন ব্যক্তিত্বের কাছে এলে মন যে আলোড়িত হবে.... এ আর নতুন কথা কি!!! এখন হৃদয়ের মধ্যে দ্বিধা মিশ্রিত প্রশ্ন - আরো একটু কাছে যাওয়া যায়না কী ?!
অভাবনীয় সে সুযোগ এলো ক'দিনের মধ্যেই। কারুইজাওয়া পাহাড়ের শ্যামলিমায় কলেজ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রমোদ ভ্রমণে যাবেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এতো অভাবনীয়! ... খানিক রূপকথার মতো। আর সেই রূপকথার রাজপুত্র .....!!
তোমির সমবয়সি ছেলেরা , যাদের মধ্যে থেকে তোমি সহজেই বাছতে পারেন বন্ধু কিংবা প্রেমিক, তারা সবাই ম্রিয়মাণ রবীন্দ্র-বিভায়। মনে ধরছেনা যে কাউকেই ! তোমি তখন আচ্ছন্ন রবীন্দ্রমহিমায়।
বিকেলের অস্তগামী সূর্যের আলোয় অনেকটা পথ একা হাঁটেন রবীন্দ্রনাথ। আকাশের রবির সাথে মাটি ছুঁয়ে থাকা রবির কথা হয় অফুরান। এমনি এক বিকেলে একলা পথের পাশে হাতে বনফুলের গুচ্ছ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তোমি। সুযোগ বুঝে কৃতজ্ঞ চিত্তে এগিয়ে গেলেন কবির দিকে, হাতে তুলে দিলেন বনফুলের স্তবক। প্রথম দর্শনের মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়লো বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভায়।
সেদিনই সন্ধ্যায় শুরু হলো আর এক অধ্যায়--
এদেশের ছাত্রছাত্রীদের কাছে রবীন্দ্র কবিতা পৌছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলো একজন দো-ভাষীর। তোমি ই সেই মেয়ে যিনি ইংরেজি ভাষাটা জানেন, অনুভব করতে পারেন রবীন্দ্রকবিতা। এই সুযোগে সমস্ত তফাত গেলো মুছে.... দুজন দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন বন্ধুত্বের হাত।
শ্রদ্ধা যে ভালোবাসারই নামান্তর। পাহাড়ের পারে, গাছের ছায়ায় মুগ্ধ তোমি বসেন রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছটিতে। রবীন্দ্র কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত 'ওঁম্' শব্দে ব্যাপ্ত করে তোমির সমস্ত মনপ্রাণ।
"এই তোমারই পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত
এই তোমারই মিলন সুধা রইলো প্রাণে সঞ্চিত।"
এরপর কেটে গেছে প্রায় তিন বছর। ১৯১৯ সাল, আটান্ন বছরের রবীন্দ্রনাথ এলেন আমেরিকায়। ...আর তেইশ বছরের তোমি ? তিনি ও তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। গোলাপী কাগজের মোড়কে জাপান থেকে সঙ্গে করে এনেছেন অতি যত্নে রবীন্দ্রনাথের চুল। কী করে!! জাপানে তিনিই যে গুছিয়ে দিতেন রবীন্দ্রনাথের বিছানা। আর বালিশে লেগে থাকা কাঁচা পাকা চুল গুলি পূজার ফুলের মতোই রেখে দিতেন গোলাপী প্যাকেটে। এভাবেই তার প্রিয় মানুষটিকে কাছে রেখেছেন তোমি। কোনদিন কি ভাবতে পেরেছিলেন আবার দেখা হবে !!
তোমি রবীন্দ্রনাথ কে নিমন্ত্রণ জানালেন জাপানে। তোমির হাত ধরে প্রতিশ্রুতি দিলেন রবীন্দ্রনাথ। পাঁচ বছর পর ১৯২৪ সালে সেই প্রতিশ্রুতি রাখলেন রবীন্দ্রনাথ.... আরো একবার গেলেন জাপান। তাঁর বয়স তখন তেষট্টি। সারা জাপান জুড়ে রবীন্দ্র বক্তৃতা। সর্বত্র সঙ্গে যান এই ভাষা সঙ্গিনী তোমি। শুধু কি তাই ! টোকিও তে ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথের রাতদিন পরিচর্যা করলেন তোমি। ভালোবাসার রেশ নিয়ে প্রাণে রবীন্দ্রনাথ ফিরলেন শান্তিনিকেতনে ।
"গোপন পথে আপন মনে
বাহির হও যে কোন লগনে,
হঠাৎ গন্ধে মাতাও সমীরণ।"
১৯৩৬ সালে তোমি এলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ তখন ভগ্নস্বাস্থ্য পঁচাত্তর আর তোমি দুবছর আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন স্বনামধন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক তাকোহিসা কোরার সাথে। বোলপুরে লাল মাটির দেশে বিশ্বভারতীর আম্র ছায়ায় চলছে তখন "চিত্রাঙ্গদা" নৃত্যনাট্যের মহড়া। ছাতিম তলা, মাধবীবিতান, উপাসনা গৃহ, আম্র কুঞ্জ..... "মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম আর আত্মার শান্তির" আবেশ মেখে মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে গেলেন তোমি।
"এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম-জনমান্তর
সুন্দর হে সুন্দর।"
…………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment