রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৩৫
শমীর পৃথিবী
মহাশ্বেতা দাস
"বসন্ত সে যায় তো হেসে, যাবার কালে
শেষ কুসুমের পরশ রাখে বনের ভালে॥"
"শমী ঠাকুর" অর্থাৎ কবি পুত্র শমীন্দ্রনাথের জন্ম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হলেও তাঁর ছোটবেলাটা বেশিরভাগই কেটেছে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি…. মাঝে মধ্যে কলকাতা আর শান্তিনিকেতনে ঘুরে। ১৯০১ সালে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের সূচনা হলে এবং রবিপরিবার ওখানেই বসবাস করতে শুরু করলে শমীও বেড়ে উঠেছেন বোলপুরের মাটিতেই। ওই আশ্রমিক পরিবেশেই তাঁর প্রথম পাঠ শুরু।
নিরুপদ্রব শান্ত প্রকৃতির ছেলেটি আপনমনে খেলে বেড়ায় বোলপুরের শান্ত পরিবেশে। বাবার লেখা গান, কবিতা তাঁর বড়ো প্রিয়। আপন মনে গুন গুন আর একটি সাদা খাতায় লিখে রাখেন পছন্দের গান গুলি। খাতার মলাটের উপর লেখা থাকে "বন্দেমাতরম"। আর একেকটি গানের শেষে বাবার অনুকরণে স্বাক্ষর - "শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর" । রূপে, গুণে, ভাবে, ভঙ্গিতে কবি যেন নিজের শৈশবকেই ফিরে পান এর মাঝে। তাইতো আদর করে ডাকেন "শমী ঠাকুর" বলে।
মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু এবং কয়েক মাস পরেই রেণুকা…. শৈশব কাটতে না কাটতেই শমীর জীবনে নেমে এসেছিল মা ও দিদির মৃত্যুর করাল ছায়া। মৃত্যু কী!! এটা ঠিক করে বোঝার বয়সও তার হয়নি তখন! মাতৃহারা শমীকে কবি তাই বোধয় একটু বেশীই কাছে কাছে রাখতেন। তিনি অন্যান্য সন্তানদের সাথে এক শয্যায় ঘুমাতে পছন্দ করতেন না। কিন্তু শমী ইচ্ছে প্রকাশ করলে তাকে লাগোয়া খাটে নিয়ে ঘুমাতেন। গভীর রাতে শমী ঘুমের ঘোরে মা কে খুঁজে হাত বাড়িয়ে দিলে কবি পরম স্নেহে সেই হাত টেনে নিতেন নিজের কাছে।
" খোকা এবং খোকার মার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠমধুর সম্বন্ধ সেইটে আমার গৃহস্মৃতির শেষ মাধুরী"
এই স্মৃতির পাতা থেকেই উঠে এসেছিল "শিশু" কাব্যগ্রন্থের কবিতা গুলি। অর্থাৎ শিশু কাব্যগ্রন্থের নায়ক (খোকা) রবি-পুত্র শমীন্দ্রনাথই।
শমী'র দাদা রথীন্দ্রনাথ প্রায় আট বছরের বড়ো ছিলেন শমীর থেকে। রথীন্দ্রনাথ ও খুব স্নেহ করতেন ছোট ভাইকে। রথীন্দ্রনাথ আমেরিকায় কৃষি বিদ্যার শিক্ষা করতে গেলে তাঁকে চিঠিতে আশ্রমের সমস্ত খবরাখবর দিতেন এই ছোট্ট শমীন্দ্র। কোন বন্ধুর সাথে কী কথা হলো, কোন গাছে কী ফুল ফুটেছে, কোন সভায় কোন আবৃত্তি এমনকি জ্যোৎস্না রাতে তাঁরা কোথায় বেড়াতে বেরিয়েছে…. সব কিছুই তাঁর দাদাকে বলা চাই।
তাঁর সরল-শান্ত হাসি-খুশী মুখ, নম্র-শিষ্ট আচরণ সবাইকে আকৃষ্ট করত, মুগ্ধ করত খুব। নামমাত্র বিলাসিতা তো ছিলই না তাঁর পোশাকে-আশাকে,...… ব্যবহারে-চালচলনেও ছিল না বিন্দুমাত্র অহংকার। কবি বলতেন - 'আমার ছোট ছেলে শমী লোকজন এলে তাদের মোট ঘাড়ে করে আনত।' শমী বরাবরই দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন, তাই বড় ছেলেরা তাঁকে বেশি ভারী বোঝা বইতে দিতেন না কিন্তু শমী তাতে ক্ষুণ্ন হতেন- দুঃখিত হতেন।
অধ্যাপক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং ভূপেশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে প্রায়শঃই বিকেলের দিকে শমীন্দ্রনাথ যেতেন ভুবনডাঙায়, সঙ্গে থাকত হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স। গ্রামের অসুস্থ মানুষদের প্রয়োজন মতো সে-সব ওষুধ বিলিয়ে দিতেন, কখনও রোগীকে বিছানায় বসিয়ে নিজে হাতে ওষুধ খাইয়ে দিতেন।
১৯০৭ সালে বসন্তপঞ্চমীর দিন শান্তিনিকেতনে শমীন্দ্রনাথ ঠিক করলেন ঋতু উৎসব করবেন। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় শান্তিনিকেতনে উপস্থিত ছিলেন না। কী আশ্চর্যের বিষয়…. বাবার অনুপস্থিতিতেই মাত্র দশ বছরের ছেলেটি আয়োজন করে ফেললেন ঋতু উৎসবের! নিজে সাজলেন বসন্ত। অন্যান্য ছেলেদের কাউকে শরৎ, কাউকে শীত…. এভাবেই সূচনা হয়ে গেল ঋতু উৎসবের। নিজ কন্ঠে গান গাইলেন- "এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ"। অনুষ্ঠান হয়েছিল প্রাককুটিরে, আজ যা শমীন্দ্র পাঠাগার বলে পরিচিত। আর এভাবেই ঋতু উৎসবের মধ্যে দিয়ে সূচনা হয়েছিল আজকের বসন্ত উৎসবের।
"কাছে এল পূজার ছুটি" । মীরা অসুস্থ তাই কবিকে ফিরতে হবে কলকাতায়। শমী কলকাতা যেতে চায়না। এদিকে পূজার ছুটিতে সবাই বাড়ি চলে গেলে শান্তিনিকেতনে শমী একা থাকতে পারবে না।…. কোথায় রাখবেন শমী কে? প্রথমে ঠিক করলেন আশ্রমের শিক্ষক মহাশয় সুবোধচন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে দিল্লী পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু সেখানে তখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপ প্রচুর। বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদার কে চিঠি লিখলেন। ঠিক হলো শ্রীশচন্দ্রের ছেলে শমীর সমবয়সী বন্ধু সরোজ চন্দ্র মজুমদার ওরফে ভোলা' র সাথে মুঙ্গেরে ভোলা'র মামাবাড়িতে যাবে শমী। ওদের মুঙ্গের রওনা করিয়ে দিতে কবি সেই সময় এলেন শান্তিনিকেতনে। ১৯০৭ সালের ১৬ই অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিনে শমীন্দ্রনাথের যাত্রা শুরু হলো মুঙ্গেরের উদ্যেশ্যে। সেদিন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে বিজয়া দশমীর দিনে শমীর এই যাত্রা ছিল বিসর্জনের যাত্রা। এরপর আর কোনো দিন ফিরে আসেনি সে!
একমাস পরেই কবির কাছে দুঃসংবাদ এলো শমী কলেরায় আক্রান্ত। ১৭ই নভেম্বর কবি উপযুক্ত ডাক্তার সহ মুঙ্গেরে গেলেন। সেখানেও ভোলা'র দুই মামা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। অক্লান্ত চেষ্টা চললো কয়েকদিন ধরেই। কিন্তু সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে ২৪শে নভেম্বর অর্থাৎ পাঁচ বছর আগে ঠিক যেদিন মৃণালিনী দেবী পাড়ি দিয়ে ছিলেন না ফেরার দেশে…. আদরের শমীও পা বাড়ালো মায়ের কাছে যাবে বলে।
রবীন্দ্রনাথ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ও কন্যাদের বিদায় দিয়েছেন মৃত্যু শয্যার পাশে বসেই। কিন্তু সেদিন রাতে তিনি শমীর কাছে গেলেন না। ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে রইলেন পাশের ঘরে। কবির ভাবনায় - " বিরাট বিশ্বসত্তার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও যেন পিছনে না টানে।"
মুঙ্গের শ্মশানেই শমীন্দ্রনাথের শেষকৃত্য করা হলো। রবীন্দ্রনাথ শ্মশানে গেলেন না…. বসে রইলেন একই রকম ধ্যান গম্ভীর হয়ে। পুত্রশোকাতুর রবীন্দ্রনাথ পরের রাত্রে ট্রেনে করে ফিরে আসার সময় দেখলেন- "জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথা কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে, কম পড়েনি- সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তার মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনখানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়। যা ঘটেছে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।"
রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। তখনও আশ্রমের কেউ সেভাবে শমীর চলে যাওয়ার খবর পায় নি। খবর যখন আশ্রমিকদের কানে গেল… এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! রবীন্দ্রনাথ অবিচল। বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই। দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময় শান্তিনিকেতনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কবির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধু কয়েকবার উচ্চারণ করলেন - "রবি, রবি" ….. কবির চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো।
"মৃত্যুর পর সবাই যেখানে যায়, সেখানে মানুষের সেবা পৌঁছয় না কিন্তু ভালোবাসা হয়তো বা পৌঁছায়।"
কবি জগদীশচন্দ্র বসু কে একটি চিঠিতে লিখলেন - "আমাদের চারিদিকে এত দুঃখ, এত অভাব, এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের শোক লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষ রূপ দুর্ভাগ্য কল্পনা করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জা বোধ হয়।"
অপরিসীম এই মনের জোর থেকেই তিনি শমীর জামাকাপড় আশ্রমের ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন। শমীন্দ্রনাথ যে ঋতু উৎসবের সূচনা করেছিলেন কবি সেই উৎসব কে মনে রেখেই পুত্রশোক কে রূপান্তরিত করলেন প্রকৃতি বন্দনায়।
"সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে,
চাঁদের আলোর দেশে গেছে।"
প্ল্যানচেট করে শমীর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। সত্যাসত্য বিশ্লেষণ তর্কের বিষয়! কবি জেনেছিলেন শমী পরপারে এক নূতন পৃথিবী গড়েছে…. নাম রেখেছে "শমীর পৃথিবী।" পরপারে শমীর নাকি অনেক কাজ! "শমীর পৃথিবী" ভরে উঠছে শমীর লেখায়।
জীবনের শেষ প্রান্তে তাই কবিরও মনে হয়েছিল… এবার "শমীর পৃথিবী" তে যাওয়ার সময় হয়েছে তাঁর।
"আমারে যে জাগতে হবে,
কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥"
…………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment