Tuesday, 8 August 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা - মহাশ্বেতা দাস // ই-কোরাস ৩১

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৩১

বিশ্বভারতী

মহাশ্বেতা দাস 


    বিশ্ব প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া যাঁর চিরকালের অভ্যাস তিনি কি শুধু নিজের ক্ষুদ্র সংসারিক গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারেন! যদিও একাধারে তিনি স্নেহশীল পিতা, কর্তব্যপরায়ণ স্বামী তবু বিশ্বসংসারের ডাকে সাড়া যে তাঁকে দিতেই হবে। সেখানে যে তাঁকে খুব প্রয়োজন। কত মানুষ কে যে বিভিন্ন কাজে, গবেষণার কাজে, সাহিত্য লেখার কাজে সহায়তা করেছেন তার সঠিক হিসেব নেই আমাদের কাছে।

জগদীশচন্দ্র বসু বিলেতে গবেষণার কাজ যাতে নিরুদ্বেগে চালাতে পারেন  সেজন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের শরনাপন্ন হতেও দ্বিধা করেন নি। 


    ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটির বয়স ক্রমে চল্লিশ বছর। "বঙ্গদর্শন" পত্রিকার সম্পাদকের কাজের পাশাপশি কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প লেখালেখি তো চলছেই…… এভাবেই এবার লেখনী নিঃসৃত হয়ে এলো বাংলা সাহিত্যের যুগান্তকারী উপন্যাস "চোখের বালি"। বোধয় বঙ্কিমচন্দ্রের "বিষবৃক্ষ" উপন্যাসের পর এমন মন বিশ্লেষণমূলক উপন্যাস এই "চোখের বালি"। 


    যতই পর্বত শিখরে আরোহণ করা হয় ততই তো প্রকৃতির নিয়মে নিঃসঙ্গ হতে হয়! সে বিচারে রবীন্দ্রনাথও যেমন সাহিত্য রচনায় ছিলেন নিঃসঙ্গ তেমনই নিঃসঙ্গ ছিলেন সংসার জীবনেও। রবীন্দ্র প্রতিভার দোসর কি সহজে মেলে! জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সংসার নিয়ে থাকতে রাজি ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। তাই নিজের মতো করে শিলাইদহে সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে বসবাস শুধু নয় তাদের লেখাপড়ার ও ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সবকিছু তো নিজের খেয়াল মতো চলে না!! কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর কাছে শিলাইদহের এই অলস জীবন বড়ই দুঃসহ … নির্বাসন দণ্ডের মতোই। বেলা, রাণী বড়ো হচ্ছে রথীর জন্যেও অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজন…. কোনটাই শিলাইদহের অলস গ্রাম্যপরিবেশে সম্ভব নয়। আপাতত সপরিবারে ফিরে এলেন কলকাতায়। 


    "কাব্য পড়ে যেমন ভাব কবি তেমন নয় গো।" 


       ভারতী ও হিতবাদী পত্রিকায় বাল্যবিবাহ নিয়ে সোচ্চার হলেও নিজস্ব পারিবারিক জীবনে সংস্কার ও সংরক্ষণের চাপে আপস করতে হয়েছিল কবিকে। একমাসের ব্যবধানেই তাই বেলা আর রাণীর যখন বিবাহ দিলেন তখন বেলার বয়স চোদ্দ আর রাণীর বয়স বারো বছর। এই আপসের আরও একটা বড়ো কারণ রবীন্দ্রনাথ অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিলেন মহর্ষির উপর নির্ভরশীল…. রবির নিজস্ব কোন আয় ছিল না। ঠাকুরবাড়ির এই বাল্যবিবাহ রীতির ব্যতিক্রম ঘটেছিল ইন্দিরাদেবী ও সরলাদেবীর বেলায়…. তারও একটা বড়ো কারণ এঁদের পিতা সত্যেন্দ্রনাথ ও জানকী নাথ অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিলেন স্বনির্ভর, ঠাকুরবাড়ির আওতার বাইরে। 

  

    বছর তিনেক আগে বলেন্দ্রনাথ অর্থাৎ বলাই শান্তিনিকেতন সাধনা শ্রমের ট্রাস্টডিড অনুসারে এখানে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনে তৎপর হয়েছিলেন….. এবার সেই সলতে পাকিয়ে রাখা প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের কাজে হাত দিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন "ব্রহ্মচর্যাশ্রম" বিদ্যালয়ের।  নিজের সীমিত সঙ্গতি দিয়ে মাত্র পাঁচজন ছেলে নিয়ে বিদ্যালয়টি শুরু করেছিলেন। এই পাঁচজন ছাত্রের মধ্যে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ অন্যতম। এর আগে শান্তিনিকেতনে তেমনভাবে কোন স্থায়ী কাজ হয় নি। বিদ্যালয় সংগঠনের কাজে সহায়তা করার জন্য পেয়েছিলেন সমবয়সী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে। এখানে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে "গুরুদেব" বলার প্রবর্তন করেছিলেন সুহৃদ ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। 


      রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মে প্রাচীন ভারতের গুরুগৃহে থেকে শিক্ষালাভের প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ভাবনাকেই বাস্তবে রূপদান করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই বিদ্যালয় গড়ে তোলার পিছনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি লক্ষ্য ছিল …. প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের বেড়ে ওঠা, পরিবর্তনশীল ভারতে শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান এবং বৃহত্তর বিশ্বকে গ্রহণের উপযুক্ত করে তোলার জন্য জ্ঞানদান । 

     

        রবীন্দ্রনাথ যে ভাবনা থেকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন বাস্তবের অভিজ্ঞতায় সেখানে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ ছাত্রদের চেলির কাপড় পরিয়ে তাপসকুমার সাজানো গেলেও শিক্ষক মহাশয়রা সবাই তপস্বী নয়…. তাঁদের সংসার আছে, আছে নিত্য অর্থের প্রয়োজন। অপর দিকে রবীন্দ্র আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মুখে মুখে জয়গান গাওয়ার লোকের অভাব না থাকলেও অর্থ সাহায্য করার বিষয়ে অভাব ছিলো যথেষ্টই। তাই আশ্রম ধীরে ধীরে বোর্ডিং স্কুলে পরিণত হয়। শুরু হয় ছাত্রদের অবৈতনিক শিক্ষাদানের বদলে ছাত্র ও অভিভাবকদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন। তবুও কবির এই ভাবনা স্বতন্ত্রতার দাবী রাখে।


    " যত্র বিশ্বম্ ভবত্যেক নীড়ম্ ।" 


   বিশ্ব এক নীড়ে পরিণত হবে, এই  ভাবনা থেকেই এই বিদ্যালয় ১৯২১ সালে  "বিশ্বভারতী" বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে।

     " পৃথিবীর মধ্যে আমাদের এই আশ্রম এমন-একটি জায়গা হয়ে উঠুক যেখানে ধর্ম ভাষা এবং জাতিগত সকল প্রকার পার্থক্য সত্ত্বেও আমরা মানুষকে তার বাহ্যভেদমুক্তরূপে মানুষ বলে দেখতে পাই।" এই ছিল কবির অন্তরের কথা। তাই "শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী" শুধুমাত্র তাঁর স্বপ্ন ও সাধনা ছিল না, ছিল তাঁর আত্মার টান ।


   "শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী" গড়ে তোলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর অবদান কম নয়। স্কুলের শুরুতে এর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কবি-পত্নী  মৃণালিনী দেবী নিজের সমস্ত অলংকার বিক্রি করেছিলেন। আশ্রমের ছেলেদের তিনি মাতৃস্নেহে লালন করতেন….. সেখানে রথীন্দ্রনাথের সাথে অন্য ছেলেদের কোন তফাৎ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ পুরীতে অবস্থিত তাঁর বাংলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের জন্য। পিতার শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট থেকে আসা বছরে আঠারশ টাকার উপরই তিনি প্রধানত নির্ভর করতেন। পরে তিনি তাঁর নোবেল পুরস্কারের সমুদয় অর্থ বিদ্যালয় কতৃপক্ষকে দান করেন। ১৯২১ সালে এই বিদ্যালয় "বিশ্বভারতী" বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে এই বিপুল খরচ জোগাতে কবি তাঁর 'কলম' ছেড়ে নাচ-গানের দল নিয়ে দেশ-বিদেশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, বক্তৃতা  দিয়েছেন, তাঁর বই বিক্রির রয়‌্যালটির টাকা ঢেলে দিয়েছেন সদ্যজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে। বলতে বাধ্য হয়েছেন, “ভিক্ষাবৃত্তির ঘূর্ণি হাওয়ায় আমাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরপাক খাইয়ে বেড়াচ্ছে।” ১৯২২ সালে তিনি তাঁর বাংলা গ্রন্থাবলির গ্রন্থস্বত্ব বিশ্বভারতীকে দান করেন। প্রাথমিক অবস্থায় অতি অল্প বেতনের শিক্ষকদের কাছ থেকেও সাহায্য এসেছিল। ইংল্যান্ডের ডব্লিউ.ডব্লিউ পিয়ার্সন এবং সি.এফ এন্ড্রুজ তাঁদের সর্বস্ব স্কুলে দান করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডরোথি এমহার্স্ট স্ট্রেইট এবং ইংল্যান্ডের লিওনার্ড এমহার্স্ট শ্রীনিকেতনের উন্নয়নের জন্য নিয়মিত আয়ের উৎসরূপে তাঁদের ডার্টিংটন হল ট্রাস্ট থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ দান করেছিলেন।


     বিশ্বভারতী, আজও শুধুমাত্র বাঙালী নয়, সারা ভারতবাসীর কাছে শিক্ষা এবং শিল্পচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে পরিচিত। দেশ বিদেশের বহু রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষের কাছেও অন্যতম আকর্ষণ এই ব্যতিক্রমী বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানটি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সৃষ্টিকর্মে এই শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী' র উপস্থিতি সমুজ্জ্বল। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ  আশ্রম নিবাসী বিভিন্ন শিল্পী ও ভাস্করের সৃষ্টিশীলতায় সজ্জিত হয়ে  একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু এই প্রতিষ্ঠানের আচার্য্য ছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এ সম্পর্কে লিখেছিলেন-

          

         "যখন রব না আমি মর্ত্য কায়ায়

             তখন স্মরিতে যদি হয় মন

        তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়

             যেথা এই চৈত্রের শালবন।" 


     রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪০ সালে  গান্ধিজিকে বলেছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে তিনি যেন এই "বিশ্বভারতী" প্রতিষ্ঠানটিকে ভুলে না থাকেন। গান্ধিজিও পরে কবির সেই বার্তাটি জানিয়েছিলেন দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আজাদকে। সেই কারণে ১৯৫১ সালে "বিশ্বভারতী" ভারতের প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেল। আচার্য হলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, উপাচার্য হলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিন থেকেই চেয়ে এসেছেন "বিশ্বভারতী" হবে বিশ্ব ও ভারতের মিলনক্ষেত্র যেখানের আকাশে ও আত্মায় থাকবে অবিচ্ছিন্ন মানবতার আদর্শ। আবার আশঙ্কাও করেছিলেন,“আমি যতদিন আছি ততদিন হয়তো এ বিচ্ছেদ ঠেকাতে পারি, কিন্তু আমার অবর্তমানে কার আদর্শে চলবে?..." 

    আজ আমরা রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষজন সত্যিই কি এ বিষয়ে চিন্তিত নয়! বিশ্বভারতী ধীরে ধীরে কবির সেই উদার উন্মুক্ত আদর্শের পরিবর্তে কি রক্ষণশীলতার নামান্তরে পরিণত হচ্ছে না!  

                …………………


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...