রবীন্দ্র কবিতায় বর্ষার ছোঁয়া
মহাশ্বেতা দাস
ছয় ঋতুর দেশ ভারতবর্ষ। সারা পৃথিবীতে ভারতবর্ষই একমাত্র দেশ যেখানে বর্ষা ঋতুর স্বাতন্ত্র্য আলাদা করে অনুভব করা যায়। আষাঢ় আর শ্রাবণ দুইমাস বর্ষাকাল। রিমঝিম বৃষ্টি আর একগুচ্ছ সজীবতা নিয়ে তাপিত তৃষিত পৃথিবীকে শ্যামল সুন্দর করে সাজাতে ফুলের সুবাস মেখে হাজির হয় বর্ষারাণী। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের সুবাসে রোমাঞ্চিত হয়ে কবি মন গেয়ে ওঠে-
"মন মোর মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে,
শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে রিমিঝিম।"
একদিক থেকে বলতে গেলে বর্ষা আর রবীন্দ্রকবিতা যেন সমগোত্রীয়… একই ধারায় প্রবাহিত একই রকম উচ্ছল, প্রাণবন্ত। বর্ষাকালের বিরহ ক্লিষ্ট বিষাদগ্রস্ত বাঙালী হৃদয় কে সজীবতায় পুনরুজ্জীবিত করতে পারে রবীন্দ্র লেখনী। মেঘপুঞ্জের রথে চড়ে আসা বর্ষাকাল ছিল কবির প্রিয় ঋতু। তাই শ্রাবণের ধারার মতোই এই বর্ষাকালেই সৃষ্টি হয়েছে অজস্র রবীন্দ্র কাব্য। মেঘ যেমন করে বৃষ্টি হয়ে নেমে এসে আমাদের তাপিত তৃষিত পৃথিবীকে ফুলে ফলে লতায় পাতায় ভরিয়ে সঙ্গ সুধা দান করে তেমনিভাবেই রবীন্দ্র লেখনী নিঃসৃত বর্ষার কবিতা ও গান আমাদের মন কে রসদ সরবরাহ করে, রোমাঞ্চিত করে -
"দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা, পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ-
নব-অঙ্কুর জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ।"
বর্ষার বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মুহূর্তে কখনও শত বরণের ভাবের উচ্ছ্বাসে কবি হৃদয় কলাপের মতো বিকশিত হয়েছে আবার কখনও বা আষাঢ় মাসের মেঘ ঘনিয়ে এলে মনে জমা হয়েছে একরাশ অভিমান…. যে অভিমান বৃষ্টির ধারায় গলিত হয়েছে-
"বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়
এলো আমার মনে,
কোন সে কবির ছন্দ বাজে
ঝরঝর বরিষণে।"
কখনও আবার চোখের জলে ভেসে যাওয়া দিনের ছায়া দেখেছেন কবি শ্রাবণের গগনতলে। হারানো প্রিয়জনের কথা মনে পড়েছে তখন -
"তেমনি তোমার স্মৃতি ঢেকে ফেলে মোর গীতি।"
রবীন্দ্র কবিতায় ও গানে বর্ষা এবং জনজীবনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। জমিদারি দেখাশোনার কাজে কবিকে ঘুরে বেড়াতে হতো গ্রামে গঞ্জে। পরিচয় হতো সাধারণ মানুষের সাথে। পল্লী গ্রামের সুখ দুঃখ হাসি কান্না নিত্য দিনের যে অনুভূতির কথা কবি জেনে ছিলেন, অনুভব করেছিলেন অন্তর দিয়ে, সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখনীতে। "আষাঢ়", "সোনার তরী" ইত্যাদি কবিতা এবং প্রায় ১২০ টি বর্ষার গান লিখেছেন তিনি, যা আমাদের মন কে বিশেষ ভাবে ছুঁয়ে যায় আজও।
"বাদলের ধারা ঝরে ঝরো ঝরো
আউষের ক্ষেত জলে ভরো- ভরো,
কালীমাখা মেঘে ও পারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে।"
কবি দেখেছেন পল্লী গ্রামের রাস্তা দিয়ে গৃহহারা বাউল কেমন একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে যায়। বর্ষার সুরে কবি সেই সুর অনুভব করেছিলেন -
" বাদল বাউল বাজায় রে একতারা -
সারা বেলা ধ'রে ঝরোঝরো ঝরো ধারা।"
বর্ষা মানেই বৃক্ষরোপণ উৎসব নূতন প্রাণের সৃষ্টি, বর্ষা মানেই 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী', বর্ষা মানেই 'সোনারতরী '। শাঙন রাতে প্রিয়তমা সজনীর অভিসার যাত্রা রবীন্দ্র লেখনীর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পাঠককে স্বপ্নলোকে।
"শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা,
নিশীথযামিনী রে।
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব
অবলা কামিনী রে।"
বর্ষায় আনমনা মনের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন -
"আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে
জানিনে জানিনে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না।"
আবার দুঃখের রাতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করে পরানসখার দেখা মিলেছে রবীন্দ্র অনুভবে, যেখানে বরাবরের মতোই প্রিয় আর ঈশ্বর এক হয়ে গেছে -
"আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণসখা বন্ধু হে আমার।
আকাশ কাঁদে হতাশসম,
নাই যে ঘুম নয়নে মম-
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম,
চাই যে বারে বার।"
আষাঢ়-শ্রাবণ ফুরিয়ে ভাদ্রমাস এলে মেঘেদের দূর দেশে ফিরে যাওয়ার পালা…বর্ষার বিদায় সুরে কবি হৃদয় ব্যথিত হয়েছে -
"বাদল-ধারা হল সারা, বাজে বিদায়-সুর।
গানের পালা শেষ ক'রে দে রে, যাবি অনেক দূর।"
আর এভাবেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান গুলিই হয়ে উঠেছে আমাদের বর্ষা ঋতু উদযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।
মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তির জায়গা ছিল কবির প্রাণপ্রিয় শান্তিনিকেতন। বোলপুরের কঠিন মাটির বাধা ক্ষীণ করে নব অঙ্কুর জয় পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ন করতে আশ্রমবাসী এবং প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুরু করেছিলেন বৃক্ষরোপণ উৎসব। আবার প্রিয় ছাত্রছাত্রী, আশ্রমবাসী আর শান্তিনিকেতনবাসিন্দাদের চোখের জলে ভাসিয়ে দীর্ঘ সত্তর বছরের বাঁধন ছিন্ন করে শান্তিনিকেতন কে চিরবিদায় জানিয়েছিলেন কবি এমনই এক বর্ষাকালেই।
"যেতে যেতে পথপাশে
পানা- পুকুরের গন্ধ আসে,
সেই গন্ধ পায় মন
বহু দিনরজনীর
সকরুণ স্নিগ্ধ আলিঙ্গন।"
সেদিন শেষ গানেরই রেশ নিয়ে পথিক বুঝি পথ ভুলেছিল! শান্তিনিকেতনের তমাল- অরণ্য শুনেছিল শেষ কেকা।
"স্বপ্নে যে বাণী মনে মনে ধ্বনিয়া উঠে ক্ষণে ক্ষণে
কানে কানে গুঞ্জরিব তাই বাদলের অন্ধকারে।"
…………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সুকান্ত সিংহ
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment