নস্টালজিয়ায় সেন্দিয়াঘাট
তাহমিনা শিল্পী
ব্যালকনিতে জেগে থাকা নিঝুম রাতের মন কেমনিয়া সময়ে হঠাৎ প্যাঁচার ডাক ভীষণই এলোমেলো করে দেয়।যেন পুকুরের শান্ত জলে কেউ একটি ছোট্ট ঢিল ছুড়ে দিলো।আর জলে ভেসে থাকা পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে সেই জলে বাড়িয়ে দিলো ঢেউয়ের দোলা।অমনি আমি ঘষেমেজে স্মৃতিকে চকচকে করতে লেগে গেলাম।
বর্ষায় যৌবনপ্রাপ্ত জল থৈথৈ কুমারনদটা ফুলে-ফেঁপে ওঠলে তার রূপসৌন্দর্য অনেকটাই বেড়ে যায়।বাজারের ঠিক মাঝ বরাবর সোনালী ব্যাংকের পাশ ঘেষে যে সরু রাস্তাটা এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে নদীর দিকে তার শেষ মাথায় নৌকো ঘাট।প্রায় গোটা তিরিশেক নৌকো বাঁধা থাকে ঘাটে।কোনটি খেয়া পারাপারের,কোনটি পাট বোঝাই,কোনটি আবার দূর গায়ের যাত্রী পরিবহণের।
মাঝি,খালাশিদের হাঁকডাক, লোকের যাওয়া-আসা, শোরগোলে ব্যস্ত ঘাটটির এককোণে বড় দুটো সিমেন্টের চাঈ। তার একটির উপর বসে থেকে প্রায়ই এই দৃশ্য দেখতে দেখতে যখন মন হারাতো।তখন একজন আমার মনের কথা বুঝতে পারতো।
আমার মেজমামা।শান্ত স্বভাবের ঘরকুনো লোক।বন্ধুবান্ধব খুব একটা ছিল না।বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতো।কাছাকাছি বয়সের না হলেও আমাদের দারুণ বন্ধুত্ব।বেড়াতে যাওয়া, মেলায় যাওয়া, সার্কাস-সিনেমা দেখার মত শখগুলো মেজমামার আস্কারাতেই মিটতো।ঠিক সেভাবেই আমার নৌকাভ্রমনের শখটাও মিটতো মেজমামার বদৌলতে।
নৌকা রিজার্ভ করে আমরা এই ঘাট থেকে অনেকটা দূরে নৌবন্দর টেকেরহাট পেরিয়ে সেন্দিয়াঘাট পর্যন্ত যেতাম।সে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পথ।নদীতে তখন বেশ শুশুক দেখা যেত।স্রোতের উল্টো দিকে তারা চকচকে কালো পিঠ উঁচিয়ে ডিগবাজি খেতো।একটা, দুটো,তিনটে.....আমি গুনতে থাকতাম কয়টা শুশুক দেখতে পেলাম।কোনটা কতবার ডিগবাজী খেলো... কোনটা বেশি চঞ্চল... এইসব দেখতে দেখতেই আমরা সেন্দিয়া পৌঁছে যেতাম।
সেন্দিয়াঘাটের দুইদিকে কুমার নদ।একদিকে নালাখাল।অনেকটা দ্বীপের মত।আমার যখনই ওখানে যেতাম,মামার কাছে জানতে চাইতাম সেন্দিয়া নামের রহস্য কি? কেন এই জায়গার নাম সেন্দিয়া হল? মেজমামা প্রতিবারই নতুন নতুন গল্প বানাতেন এর নামকরণের।এরমধ্যে আমার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল যে গল্পটি সেটি হল- নাবিক সিন্দবাদ একবার এই পথে যাচ্ছিল।তখন একটি শুশুক জাহাজের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে পথ আটকে দিলো।সবাই মিলে খুব চেষ্টা করে, কোনভাবেই শুশুকটাকে সরাতে পারেনি।অগত্যা সিন্দাবাদ এই ঘাটে নোঙর করেছিল।তখন থেকে এর নাম সিন্দাবাদের ঘাট হয়ে গেলো।কিন্তু মানুষের মুখেমুখে পরিবর্তণ হতেহতে এখন এর নাম সেন্দিয়াঘাট।
সেন্দিয়ার পূর্বপাশের নালাখালে নৌকো থামলে সিঁড়িপথ বেয়ে উপরে উঠে গেলেই চমৎকার সানবাঁধানো ঘাট।পাশেই বুহুদিনের পুরনো বটগাছকে ঘিরে হাঁট।সেখানে নানারকমের সওদা নিয়ে আসতো লোকে।বেঁচাকেনা শেষে সন্ধ্যায় ফিরতো নিজ নিজ গাঁয়ে।
আমরা একটা রেঁস্তোরায় বসতাম।গরমগরম দানাদার,মুচমুচে নিমকি,আর মালাই চা খেতাম।তারপর সাপ আর বানরের খেলা দেখতাম।কোনকোন দিন টগিও দেখতাম।খেলনা কিনতাম......
আজ সময়ের পরিহাসে আমরা মানুষেরাই যখন বাদর নাচ নাচছি।কোন কোন মানুষ যখন সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।শুশুকটা যেমন করে সিন্দাবাদের জাহাজটাকে আটকে রেখেছিল।তেমন করে দুর্নীতি,অরাজকতা,অমানবিকতা আমাদের বিবেক ও সুবুদ্ধিকে যখন আটকে রাখে তখন আমার কেবল সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে যায়।মনে হয় কতই না ভালো ছিলাম আমরা।
মুলত মানুষ ততদিনই সুন্দর থাকে যতদিন সে শিশু।বড় হবার সাথে সাথে সময়ের জট-জটিলতা বুঝতে পেরে আবার ফিরতে চায় সেইসব দিনে।অথচ,আর কোনোদিন ফেরা যাবে না! আর কখনও ফেরা হয় না।
মধ্যরাত।চারদিক নিস্তব্ধ।শহর ঘুমিয়ে গেছে।
যেমন করে ঘুমিয়ে গেছে মানবিকতা।আমার চোখেও ঘুম নামছে।
ঘুম, গভীর ঘুম !
............................
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment