রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৩২
ছুটি
মহাশ্বেতা দাস
ব্যক্তি বিশেষে চিঠি লেখার রকমফের অনিবার্য, তা যদি আবার হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা মৃণালিনী দেবীকে চিঠি। ব্যক্তিগত পরিসরে লেখা হলেও সেসব চিঠি যে সাহিত্য রসে পরিপূর্ণ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে প্রায় ৩৬ টি চিঠি লিখেছিলেন রবি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী "ভাই ছুটি" কে। যদিও অভিমানী মৃণালিনী দেবী স্বামীকে চিঠি লিখতেন খুব কম এবং সেসব চিঠিতে সাংসারিক প্রয়োজনের কথা ছাড়া অতিরিক্ত কিছু থাকতো না। যাইহোক, ১৮৯০ সালে জাহাজে করে লন্ডনের পথে পাড়ি দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, জাহাজ থেকে মৃণালিনী দেবীকে একটি চিঠিতে লিখে জানাচ্ছেন যাত্রাপথের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা, জাহাজে বিভিন্ন মানুষজনের সাক্ষাতে নানা অভিজ্ঞতার কথা। জাহাজ থেকে লেখা এমনই এক চিঠিতে লিখলেন,- "আমাদের জাহাজে দু- তিনটে ছোট ছোট মেয়ে আছে-- তাদের মা মরে গেছে, বাপের সঙ্গে বিলেত যাচ্ছে। বেচারাদের দেখে আমার বড় মায়া হয়...।"
কয়েক বছর পরে এই চিঠিতে লেখা কথা গুলো যে একদিন তাঁর নিজের জীবনেরই গল্প হয়ে উঠবে সম্ভবত স্বপ্নেও তা সেদিন কল্পনা করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ।
১৯০১ সালের ২২শে ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপিত হলে ওখানের অতিথি নিবাসে পুত্র কন্যাদের নিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন মৃণালিনী দেবী। কবির সহধর্মিণী হিসেবে যেমন মনোনিবেশ করেছিলেন বিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজে, আশ্রমের ছেলেদের যত্ন নিতেন মাতৃস্নেহে, ঠিক তেমনি এই সবের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখে মৃণালিনী দেবী ভুলতে চেয়েছিলেন বলেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুর শোকের আঘাত। বিদ্যালয় ও আশ্রম পরিচালনার জন্য শুধু কায়িকশ্রম নয়, শুধু স্নেহমমতা নয়…. এক এক করে প্রায় সমস্ত গয়না বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়েছিলেন ব্রহ্মবিদ্যালয় গঠন ও পরিচালনার জন্য। আর এভাবেই তিনি সবদিক দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন স্নেহময়ী আশ্রমজননী। পুত্র রথীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী হাতের চার গাছি চুড়ি আর গলায় সরু চেন ছাড়া শেষে পর্যন্ত কোন গয়নাই আর অবশিষ্ট ছিল না তাঁর।
প্রতি নিয়ত অক্লান্ত পরিশ্রম আর জোর করে মৃত্যুশোক ভুলে থাকার চেষ্টা….. শরীর এতো ধকল সহ্য করতে পারলনা। ১৯০২-এর মাঝামাঝি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন মৃণালিনীদেবী যে তাঁকে নিয়ে যেতে হল কলকাতায়।
১৯০২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর, রেলপথে মৃণালিনী দেবীকে যেদিন কলকাতায় নিয়ে আসা হল, শান্তিনিকেতন থেকে তাঁর সঙ্গে সেদিন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ছাড়াও ছিলেন দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীর শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন…
'মা শুয়ে আছেন, তাঁর পাশে বসে দেখছি রাস্তার দুপাশে তালগাছের সারি, বুনো খেজুরের ঝোঁপ আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা গ্রামের পর গ্রাম। চোখে পড়ল মাঠের মধ্যে এক পুকুর, সেখানে ফুটে আছে অসংখ্য সাদা পদ্ম। দেখে এতো ভালো লাগল, মাকে ডেকে দেখালুম।
…..তারপর কত বছর কেটে গেছে, প্রতিবারই বোলপুর-কলকাতা যাতায়াতের সময় সেই পদ্মপুকুরটাকে দেখি— কেবল দেখতে পাই…..পুকুরে জল নেই, মাটি ভরে মাঠের সঙ্গে পুকুর সমান হয়ে গেছে, পদ্ম সেখানে আর ফোটে না।'
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে স্নেহশীল পিতা এবং কর্তব্যপরায়ণ স্বামী। তাই রথীন্দ্রনাথকে তার পড়াশুনার জন্য শান্তিনিকেতন পাঠিয়ে দিলেও প্রায় দুই মাস তাঁর প্রিয় "ভাই ছুটি"র নিরলস সেবা করে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। ডাক্তারদের পরামর্শ তো ছিলই এছাড়াও কোন চিকিৎসাতেই যখন সাড়া মিলছে না….. নিজে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতে শুরু করলেন l লালবাড়ির এক কোনায় মৃণালিনীর ঘরে তাঁকে রাতদিন পাখার বাতাস করতেন রবীন্দ্রনাথ। এত সেবা, এত যত্ন….. কিন্তু শেষ রক্ষা হল না তাতেও।
সেদিন যখন ছেলেমেয়েদের মৃণালিনী দেবীর ঘরে এনে রোগশয্যার পাশে বসালেন তখন বাকরোধ হয়েছে তাঁর। দুচোখে বয়ে গেল নীরব অশ্রুধারা। হয়তো সেই অশ্রুধারা বলতে চেয়েছিল রথী কে…. এখন আমার 'ছুটি' হয়েছে, আমি বাড়ি যাচ্ছি।
রাত্রে ছেলেমেয়েদের পুরানো বাড়ির তেতলার ঘরে শুতে পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজে জেগে রইলেন একান্ত ভালোবাসার মানুষটির মাথার কাছে। এক সময় লালবাড়ির সব আলো নিভে গেল, নিস্তব্ধ, নিঝুম। এভাবেই ১৯০২সালের ২৩শে নভেম্বর রাত্রিবেলা সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী। "ভাই ছুটি"র ছুটি হয়ে গেল বড্ড তাড়াতাড়ি। মাত্র ১৯ টি বছরের দাম্পত্য জীবন। ২৯ বছর বয়সেই নিভে গেল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মৃণালিনী দেবীর ঘরের সব আলো। পৃথিবীর মাটি আঁকড়ে পড়ে রইলেন শোকবিহ্বল রবি আর মা-হারা পাঁচটি ছেলেমেয়ে। শোকে পাথর রবীন্দ্রনাথ, সারাটা রাত ছাদে একা পায়চারি করে কাটালেন। বলে গেলেন কাউকে তাঁর কাছে না যেতে। ভোরবেলা পুরানো বাড়ির বারান্দা থেকে রথীন্দ্রনাথ দেখলেন মায়ের ঘর শূন্য। সূর্যোদয়ের আগেই শ্মশানে নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে মৃণালিনী দেবীর দেহ। মায়ের মুখাগ্নি করার বা শ্মশানে যাওয়ার সুযোগ পাননি রথীন্দ্রনাথ। আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ? না, তিনিও শ্মশানে যান নি। পরের দিন স্বজন-বন্ধু-প্রতিবেশীদের ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে মৃণালিনী দেবীর চটিজুতো-জোড়া তুলে দিলেন রথীন্দ্রনাথের হাতে। বললেন, “এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।”
রবীন্দ্রনাথ মাতৃহারা হয়েছিলেন চোদ্দ বছর বয়সে। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর সময় পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ও সেই চোদ্দ বছর। অথচ যে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হলে মুন্ডিত মস্তক হয়েছিলেন সংস্কারের বশে,তিনি মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুতে কেন নিজে শ্মশানে গেলেন না এবং রথীন্দ্রনাথ কে শ্মশানে মাতৃকার্য সম্পাদন থেকে কেন বঞ্চিত করলেন এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা।
বঙ্গদর্শন পত্রিকার "শেষকথা" কবিতায় লিখলেন -
" তখন নিশীথ রাত্রি; গেলে ঘর হতে
যে পথে চল নি কভু সে অজানা পথ।
যাবার বেলায় কোন বলিলে না কথা,
লইয়া গেলে না কারো বিদায় বারতা।
সুপ্তিমগ্ন বিশ্ব-মাঝে বাহিরিলে একা
অন্ধকারে খুঁজিলাম, না পেলাম দেখা।
মঙ্গলমুরতি সেই চিরপরিচিত
অগণ্য তারার মাঝে কোথা অন্তর্হিত!"
বাইশটা বছর কেটে গেছে….. ১৯২৪ সালে আন্দেজ জাহাজে কবি পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। প্রিয়তমা স্ত্রী "ভাই ছুটি" কে স্মরণ করে লিখলেন -
"আজ তুমি আর নাই, দূর হতে গেছ তুমি দূরে,
বিধুর হয়েছে সন্ধ্যা মুছে-যাওয়া তোমার সিন্দুরে,
সঙ্গীহীন এ জীবন শূন্যঘরে হয়েছে শ্রীহীন,
সব মানি -- সব চেয়ে মানি তুমি ছিলে একদিন।"
………………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment