পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমা হলের কথা ৩
সিদ্ধেশ্বরী ও আহেলি, —ডিঙ্গাল,চন্দ্রকোণা -১
শ্রীজিৎ জানা
গাঁয়ের নাম ডিঙ্গাল। চন্দ্রকোণা -১ ব্লকের মনোহরপুর -১ নং অঞ্চল। এখনো শেষ হয়নি। আরো লম্বা করে গাঁয়ের অবস্থান জানানো জরুরি। নইলে আলুনি লাগবে পরিবেশন। এবার আসল কথা হল ডিঙ্গাল যাওয়া যাবে কোন দিক দিয়ে। এক্কেবারে সোজা রাধানগর (ঘাটাল ব্লক) থেকে নোতুক মোড়( ঘাটাল ব্লক) ,আর নোতুক মোড় থেকে প্রায় আট-নয় কিলোমিটার পেরোলেই ডিঙ্গাল বাজার। মাঝে ডিঙোতে হবে কেঠিয়া নদীর শীর্ণকায় ব্রিজ আর বিস্তৃত একটা মাঠ। তবে যেতে যেতে মনোরম প্রকৃতির সৌন্দর্য যেমন মন ভরাবে তেমন বন্যায় এলাকার হাল কেমন হয় তার কিঞ্চিৎ আভাস চোখ ভিজিয়ে দেবে বৈকি। এতো গেল একটা পথের হদিশ। চাইলে ক্ষীরপাই থেকে, কুঠিঘাট থেকে যাওয়ারও সলুকসন্ধান দিতে পারি। চাইছেন না যখন, তখন ইতি গজ।
যাক্, ডিঙ্গাল পৌঁছলুম। তারপর? তারপর ডিঙ্গালের রথ। সেই রথ দেখা আর কলা বেচা দুই-ই ঘটবে। তার মাঝে যা ঘটবে তা ঘটিতব্য। চটছেন কেন? একটু ফেনিয়ে বলার ধাত আমার। তবে আজগুবি নয় মোটেই। প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমায় ডিঙ্গাল গ্রামে কালী পূজা হয়। শতাধিক বৎসরের প্রাচীণ পূজা। মজার বিষয় সেই তবে থেকেই একটা বিশেষ রীতি হল, ডিঙ্গাল গ্রামের মা কালী রথে চড়ে আসেন পাশের একবালপুরে। আটদিন থেকে তারপর আবার ফিরে যান ডিঙ্গালে। কালী পূজা ও রথকে কেন্দ্র করে ডিঙ্গাল বাজারে বিরাট মেলা বসে। আর সেই মেলার সূত্র ধরেই সিনেমাহলের সূচনা। এবার মিলল তো রথ দেখা আর কলা বেচা থুড়ি রথ আর সিনেমার গল্প।
টুইস্ট এখনো বাকি। এই সিনেমাহল শুরুর পিছনে আছে দুই বন্ধু। ওই রমেশ সিপ্পি সাহেবের শোলে সিনেমার জয়-বীরু স্টোরি। যাকে বলে এক্কেবারে মাখামাখি বন্ধুত্ব। একজন একবালপুর গ্রামের রঞ্জিত চক্রবর্তী, অন্যজন পাতলাপুরের কেশবচন্দ্র মন্ডল। দুজনেই ছিলেন গোপালপুর জুনিয়ার হাইস্কুলের ( চন্দ্রকোনা -১ ব্লক) শিক্ষক। আর দুজনেই ছিলেন মারাত্মক সিনেমা পাগল। যুক্তি হল সিনেমাহল করবেন। দেখা ও দেখানো দুই হবে। আয় এবং আমদানি একসাথে। এখানেও সেই রথ দেখা ও কলা বেচা পুনরায় মিলে গেল। ডিঙ্গালে চালু হল 'সিদ্ধেশ্বরী সিনেমাহল'। কালীপূজা উপলক্ষে হলের সূচনা বলে নাম রাখা হল সিদ্ধেশ্বরী। স্থাপনকাল ১৯৯৮। ঝিটেবেড়ার দেয়াল। মাথায় টিনের ছাউনি। বসার আসন মাত্র দু'ণ। কিন্তু বসতে হত মেঝেতে। আরো মজার বিষয় মেলা চলত আট দিন আর সিনেমাহল চলত মেলার দিনগুলো নিয়ে মোট একমাস। যাকে বলে অস্থায়ী সিনেমাহল। হাওড়া থেকে পর্দা, প্রোজেক্টের মেশিন ভাড়ায় আনা হত। সাইকেলে মাইক বেঁধে ওই কদিন প্রচার চলত জোর কদমে। সিদ্ধেশ্বরী হলের টিকিট মূল্য দু'টাকা, তিন টাকা আর পাঁচ টাকা ছিল। কিন্তু অমন প্রত্যন্ত গাঁয়ে সিনেমাহলকে নিয়ে প্রথম দিকে উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সারাবছর সিনেমাহল চালানোর ক্ষেত্রে দুই বন্ধুর আগ্রহ ছিল না তেমনভাবে। তার একটা কারণ নব্বই দশকের শেষের দিকে গাঁয়ে ভিডিও হলের একটা জোয়ার আসে। স্বল্প মূল্যের টিকিটে সেখানে ছবি দেখানো অনেক সহজ ছিল। ফলে ডিঙ্গাল গ্রামের ভিডিও হল দুই বন্ধুর আগ্রহে বাধ সাথে। তবে সিদ্ধেশ্বরী সিনেমাহল চার বছর অস্থায়ী ভাবেই চলতে থাকে। সিনেমাহল মালিক রঞ্জিত চক্রবর্তী জানান,--" 'হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা' ছায়াছবি সিদ্ধেশ্বরী তে রমরমিয়ে চলে বহুদিন। উপচে পড়া দর্শক হতে থাকে পুজোর ওই কটা দিন।"
অবশেষে ২০০২ সালে নতুন রূপে গড়ে ওঠে নতুন সিনেমাহল 'আহেলি '। রঞ্জিত বাবুকে জিগ্যেস করলুম আহেলি নাম রাখলেন কেন? মৃদু হেসে জানালেন, " আহেলি নামটা দুই বন্ধুর খুব পছন্দ ছিল"। মহাশয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আমিও স্মিত হাসি ফিরিয়ে দিলুম। আর মনে মনে বললুম, * এ বাত হজম নেহি হুয়া বাবুমশাই"। কিন্তু থাক সে কথা শিলাইয়ের পলিবালিতে চাপা। আসল ঘটনা হল,'সিদ্ধেশ্বরী' সিনেমাহল ডিঙ্গাল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে 'আহেলি' নামে চলে আসে শিলাই পাড়ের একবালপুরে। আহেলি গড়ে ওঠার মূলে এলাকার মানুষের অনেকটা আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল। এমনকি সিনেমাহল তৈরির জন্য স্বপ্ল মূল্যে জমিও দেন চন্দ্রকান্ত ঘোষ। পাকার দেয়াল ওঠে আর মাথায় বসে টিনের ছাউনি। দর্শকদের জন্য পাতা হয় তিনশ কাঠের চেয়ার। তবে এবারো প্রোজেক্টর মেশিন ভাড়ায় আনা হয়। চিফ অপারেটর হন খড়ার পৌর এলাকার বিশ্বজিৎ কর্মকার। তিনটি স্টলে আসন ভাগ থাকে। দর্শক টানার জন্য টিকিট মূল্য কম-ই রাখা হয় ফার্স্ট ক্লাস দশ টাকা, সেকেন্ড ক্লাস আট টাকা আর ফ্রন্টের টিকিট মূল্য ছিল পাঁচ টাকা। আহেলি সিনেমাহল প্রথম ছবি 'মায়ের আঁচল' দিয়ে তার পথ চলা শুরু করে। প্রথম দিকে বেশ কয়েকটা ছবিতে শো হাউসফুল হতে থাকে। বিশেষ করে পারিবারিক গল্পের সিনেমাগুলিতে দর্শকদের ভিড় থাকত চোখে পড়ার মতো। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সিনেমাহল মালিক রঞ্জিত চক্রবর্তী জানান–" আহেলি বন্ধের প্রধান কারণ গ্রাসে গড়ে ওঠা ভিডিও হল। সেবার 'সাথী' সিনেমা বুক করা হল সিনেমাহলে দেখানো হবে। চালানো শুরুও হল। আর ওই একইসময়ে ভিডিও হলে চলতে থাকল 'সাথী' ! দর্শক আসন খালি পড়ে থাকতে লাগল। লসে রান করতে থাকল হল। বাধ্য হয়ে দুজনে আলোচনা করে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলাম। কষ্ট হচ্ছিল খুব কিন্তু আর কোন উপায় ছিলনা।" অবশেশে আহেলি বন্ধ হয়ে যায় ২০০৩ সালের শেষের দিকে। আজ একবালপুর কিম্বা ডিঙ্গাল গ্রামে গেলে সিনেমাহলের কোন চিহ্ন চোখে পড়বেনা। শুধু একটা প্রজন্মের মানুষদের জিজ্ঞেস করলেই স্মৃতি হাতড়ে সোৎসাহে বলবে সিদ্ধেশ্বরী আর আহেলির গল্প।
কৃতজ্ঞতা :–
রঞ্জিত চক্রবর্তী (একবালপুর,চন্দ্রকোনা -১ ব্লক)
………………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment