Tuesday, 1 August 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা- মহাশ্বেতা দাস // ই-কোরাস ৩০

 


রবীন্দ্রনাথকে, কে না ভালোবাসেন। আমরা সবাই। কেউ তাঁর কবিতা, কেউ তাঁর গল্প, কেউ তাঁর গান। আবার তাঁকে নিয়ে কেউ গবেষণা করে চলেছেন? আসলে মানুষটি আমাদের দেবতা, আমাদের ঈশ্বর, আমাদের প্রেমের মানুষ, আমাদের ভালোবাসার আশ্রয়, আমাদের গর্বের মানুষ। সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ চিরযৌবনের প্রতীক। এই মানুষটির প্রেমে ডুব দেন হাজার হাজার মানুষ। মহাশ্বেতা দাস তাদের মধ্যে একজন। ত্রিশ সপ্তাহ ধরে লিখে চলেছেন রবীন্দ্র পরম্পরা। বোধহয় এর আগে এমনিভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন কাজ হয়নি। রবির জন্ম থেকে শুরু করেছেন তাঁর লেখার পর্ব। একজন রবীন্দ্র পাঠক এমন যে কাজ করতে পারেন যেটা আমাদের জানা ছিল না! আমরা ধন্যবাদ জানাই পাঠক প্রাবন্ধিক মহাশ্বেতা দাস কে। আমরা শুভেচ্ছা জানাই তাঁর কলমকে। আমাদের শুভকামনা তাঁর আগামী পর্বগুলির জন্য। হে সুজন আপনার কলম এগিয়ে নিয়ে চলুক রবীন্দ্র পরম্পরা। আমরা কোরাস আপনার সাথে আছি।

দুঃখানন্দ মণ্ডল


রবীন্দ্র পরম্পরা   

পর্ব - ৩০

হৃদয়- আকাশ

মহাশ্বেতা দাস

 

মৃণালিনী দেবী সোলাপুরে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কাছে পুত্র কন্যাদের নিয়ে বেশকিছুদিন ছিলেন কিন্তু আর ভালোলাগছে না। তাই স্বামীকে চিঠি লিখলেন কলকাতায় ফিরে আসতে চান। যদিও রবি চেয়েছিলেন ওদের সোলাপুরে আরও কিছুদিন রাখতে….. সবাই ফিরে এলো জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ এবার জমিদারি পরিদর্শনের জন্য যাবেন উড়িষ্যা, সঙ্গী হলেন বলেন্দ্রনাথ। 


    বলেন্দ্রনাথ হলেন রবীন্দ্র অগ্রজ বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র। রবির আদরের "বলু" ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একলব্য শিষ্য, সাহিত্যচর্চায় সঙ্গী, জমিদারি পরিভ্রমণে সহযাত্রী। শুধু তাই নয়,  ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ চালে-চলনে ভাবে-ভঙ্গিতে মননে-দর্শনে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের যথার্থ উত্তরসূরি। এককথায় বলতে গেলে রবি-পরিবারের জোড়াসাঁকো-শিলাইদহ জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অনুজ পরিকর। 


    দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ আর বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র বলেন্দ্রনাথ মিলে তৈরী করেছিলেন "সুহৃদ সমিতি"। এই সমিতির উদ্যোগেই জন্ম নিয়েছিল "সাধনা" পত্রিকা। "সাধনা" পত্রিকার ঘোষিত সম্পাদক ও কার্যধ্যক্ষ হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ ও নীতিন্দ্রনাথের নাম থাকলেও প্রকৃত পক্ষে পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথের সাথে কাজ করতেন বলেন্দ্রনাথ। 


     কেবলমাত্র পিরালিত্ব ছাড়া মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ, দুই পরিবারের মধ্যে কোন মিল তো ছিলই না আর রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাবান, সুদর্শন, সুপুরুষের কাছে পাত্রী হিসেবে অতি সাধারণ ভবতারিণী তো বলার  অপেক্ষা রাখেই না! যাইহোক…. এভাবেই অত্যন্ত সাদামাটা ভবতারিণী একদিন ঠাকুর পরিবারের বধূ হয়ে এলেন। কিন্তু "ভবতারিণী" নামটি তো এখানে, ঠাকুরপরিবারে অচল! তাই যেমন করে কাদম্বিনী দেবী হয়েছিলেন কাদম্বরী দেবী…. ভবতারিণীর ও নাম পাল্টে রাখা হলো মৃণালিনী। বাপের বাড়ির নাম না হয় পাল্টে দেওয়া হলো….. তবু ঠাকুর বাড়ির কোন মেয়েকে মৃণালিনী দেবী অন্তরঙ্গতায় পেলেন না। কিন্তু  মৃণালিনীর চেয়ে তিন বছরের বড় রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথের সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর গড়ে উঠেছিল স্নেহ প্রীতি ভালবাসার সহজ সম্পর্ক। ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্র পরিবার যেদিন প্রথম শিলাইদহ যাত্রা করেছিল….. সেদিন মৃণালিনী দেবী, বেলা ও রথী'র সঙ্গ নিয়েছিল বলেন্দ্রনাথও। জমিদারি দেখাশোনা, পড়াশুনা ও সৃষ্টিশীলতায় ব্যস্ত থাকার কারণে রবীন্দ্র সান্নিধ্যের অভাব কিছুটা হলেও প্রলেপ দিত বিদ্যানুরাগী বলেন্দ্রনাথের সান্নিধ্য। একবার বলেন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবী পদ্মাচরে বেড়াতে বেরিয়ে বালির সমুদ্রে পথ হারিয়ে ফেলেন। শেষে এক মাঝির সহায়তায় যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন খোঁজ করে বেধে গেছে হুলুস্থূল কান্ড।

  

     পিতামহ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরাধ্য কাজ সম্পাদন করার উদ্দেশ্যে বলেন্দ্রনাথই শান্তিনিকেতন সাধনা শ্রমের ট্রাস্টডিড অনুসারে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনে তৎপর হয়েছিলেন। কিন্তু ব্রহ্মবিদ্যালয় উদ্বোধনের আগেই ১৮৯৯ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে ঘটে গেল বলেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যু যা মৃণালিনী দেবীর কাছে ছিল অসহনীয় আঘাত। এর চেয়ে বড় মৃত্যুশোক বোধয় মৃণালিনী দেবীর জীবনে ছিল না। ভ্রাতুষ্পুত্রের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যশ্রম স্থাপন করেন। অর্থাৎ বলেন্দ্রনাথ সলতে পাকিয়ে রেখেছিলেন, রবিকা প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের কাজ সম্পন্ন করলেন। পরবর্তী পর্বে বলবো সেসব কথা। 


     ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছি আগের পর্বগুলিতে। আজ তাই রবীন্দ্রনাথের দাম্পত্য জীবন এবং মানস জগৎ নিয়ে কিছু কথা বলবো। 


       একদিকে  দেশ বিদেশে ঘুরে বিভিন্ন শিক্ষিত, ব্যাক্তিত্ব সম্পন্না নারীদের সান্নিধ্য-ধন্য সুদর্শন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ, অন্যদিকে অতি সাধারণ স্ত্রী মৃণালিনী দেবী! স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রপ্রেমীদের মনে এঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কেমন ছিল তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক! শুধুই কি পারস্পরিক কর্তব্যের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল? না কি ভালবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল তাদের মধ্যে? এইসব জটিল প্রশ্নের সহজ সমাধান সম্ভব নয়। তবুও কুড়ি বছরের দাম্পত্য জীবন পর্যালোচনা করলে ১৮৮৩ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল অর্থাৎ প্রথম আট বছরে পাঁচ সন্তানের জননী হয়েছেন মৃণালিনী দেবী। সেক্ষেত্রে মৃণালিনীদেবীকে মানসসঙ্গিনী নয় বরং দাম্পত্য জীবনের জৈবিক চাহিদা পূরণের সঙ্গিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই বেশী মাত্রায় দেখা যায়। 


     মৃণালিনী দেবী যেমন স্বামীর যত্নে, আদর - আপ্যায়নে ত্রুটি রাখেননি…. রবীন্দ্রনাথও তেমনি একাধারে কর্তব্যপরায়ণ স্বামী এবং স্নেহশীল পিতা ছিলেন। কিন্তু দায়িত্ব, কর্তব্য, যত্ন এককথা আর মানসসাম্রাজ্যের গভীরে স্থান পাওয়া অন্যকথা। রবীন্দ্রনাথের মানসসাম্রাজ্যে মৃণালিনী দেবীর স্থান কতখানি!.... এই বিশ্লেষণে যেতে গেলে দেখাযায় ১৮৯০ সালে বিলেত যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ প্রথম স্ত্রীকে চিঠি লেখেন অথচ ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ সালের মধ্যে মৃণালিনী দেবীর সমবয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী  ইন্দিরা দেবী কে লেখা চিঠি যেগুলি পরবর্তী কালে "ছিন্নপত্রাবলী"তে সংকলিত হয়েছিল, সংখ্যা দুইশত বাহান্ন। সুন্দরী, বিলিতি শিক্ষায় শিক্ষিতা নিটোল ব্যাক্তিত্বের অধিকারিণী ঝলমলে ইন্দিরা, অজস্র চিঠিতে যাঁর কাছে নিজেকে উদঘাটিত, উন্মোচিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ অবিরাম ধারায়। 

    

      রবীন্দ্রনাথ বিলেত ভ্রমণ করেছেন। সেখান থেকে স্ত্রী কে চিঠিও লিখেছেন সংসারের, ছেলেমেয়েদের খোঁজ খবর নিতে। যাত্রাপথের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের কথাও লিখেছেন চিঠিতে কিন্তু স্বামীর বিলেত যাত্রার সঙ্গিনী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করা মৃণালিনী দেবীর জীবনে ঘটেনি কোনদিনই। রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীকে প্রায় ছত্রিশটি চিঠি লেখেন, যেগুলি কবিপত্নী  সযত্নে গোপন-সঞ্চয় করে রেখেছিলেন। মৃণালিনী দেবীও প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে চিঠি লিখেছিলেন স্বামী কে অনেক। কিন্তু সেগুলি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়ে পাওয়া যায় নি কোনদিন। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে মৃণালিনী দেবীকে "ভাই ছুটি" সম্বোধন করতেন। 

     "যেখানেতে অগাধ ছুটি 

     মেল সেথা তোর ডানা দুটি"  


আমাদের প্রত্যেকেরই ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর জন্যে একটি হৃদয়-আকাশের দরকার হয়। রবির "ভাই ছুটি" কি স্বামীর হৃদয়-আকাশের ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর সত্যিই স্থান পেয়েছিলেন নাকি একতরফা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন রবির নিত্য দিনের দাম্পত্য শুধু নয় তাঁর সৃষ্টিশীলতায় ও যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিলেন! 


     "তুমি সুখ যদি নাহি পাও

       যাও সুখের সন্ধানে যাও

 আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে

    আর কিছু নাহি চাই গো।" 

                                      …………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - মমতা ঠাকুর

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...