Tuesday 18 July 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ২৮

 


রবীন্দ্র পরম্পরা 

পর্ব - ২৮

ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে

মহাশ্বেতা দাস


"আজি শুভদিনে পিতার ভবনে  অমৃতসদনে চলো যাই,

           চলো চলো, চলো ভাই।

না জানি সেথা কত সুখ মিলিবে, আনন্দের নিকেতনে, 

           চলো চলো, চলো যাই। 

মহোৎসবে ত্রিভুবন মাতিল, কী আনন্দ উথলিল–

          চলো চলো, চলো ভাই।।

দেবলোকে উঠিয়াছে জয়গান, গাহো সবে একতান–

           বলো সবে জয়-জয়।" 

  

         ১২৭০ বঙ্গাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরে স্টেশন থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে রায়পুরের জমিদার ভুবন মোহন সিংহের কাছ থেকে  দুটি ছাতিম গাছসহ ২০ বিঘা জমি  কিনে ছোট একটি একতলা পাকাবাড়ি নির্মাণ করেন এবং বাড়িটির নাম রেখেছিলেন "শান্তিনিকেতন"। পরে ক্রমশ সমগ্র এলাকাটাই শান্তিনিকেতন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।


     উনিশ শতকের মাঝে বোলপুরে একটি ছোট বসতি ছিল এবং শান্তিনিকেতনের বৃদ্ধির ফলে এটিও বৃদ্ধিলাভ করেছিল। বোলপুরের কিছু অংশ রায়পুরের সিংহ পরিবারের জমিদারির অংশ ছিল। ভুবন মোহন সিংহ বোলপুরে একটি গ্রাম তৈরি করেছিলেন এবং তার নাম রাখলেন ভুবনডাঙ্গা। ভুবনডাঙ্গা কুখ্যাত ডাকাতদের ডেরা ছিল, যারা লোকদের মারার জন্য দ্বিতীয়বার ভাবতেন না। এর ফলে লড়াই ও বিতর্কে‌র পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ডাকাতদের নেতা অবশেষে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং এলাকার বিকাশের জন্য তারা তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। সেখানে একটি ছাতিম গাছ ছিল যার তলায় বসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তপস্যা করতেন। এই স্থানটি ছিলো মহর্ষির প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তির জায়গা।  লন্ডনের হাইড পার্কের দ্য ক্রিস্টাল প্যালেসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মউপাসনার জন্য এক উপাসনাগৃহ তৈরি করেছিলেন। ছাদটি টালি এবং মেঝেটি সাদা মার্বেল পাথরের , কিন্তু বাকি ভবনটি কাচের তৈরী। ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত ইচ্ছায় যে টি আনুষ্ঠানিকভাবে  প্রতিষ্ঠিত হল 'ব্রহ্মমন্দির' নামে। যদিও মহর্ষি সেই সময় শান্তিনিকেতনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। মন্দির প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্ব পালন করেন মহর্ষির জৈষ্ঠ্য পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই মহৎ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন করেন। বৃক্ষরোপন, প্রার্থনা গান বিবিধ অনুষ্ঠান….এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মসমাজের। যদিও  রবীন্দ্রনাথ উপাসনাদি বিষয়ে তখনও সেভাবে জড়িত হননি কিন্তু দশ বছর পরে ঐ দিনেই এখানে স্থাপন করেন ''ব্রহ্মচর্যাশ্রম" । পরে একদিন বলবো সেসব কথা। 


    এখন জমিদারি দেখাশোনার যে গুরু দায়িত্ব রবির কাঁধে এসে পড়েছে সেই জন্যেই তাঁকে ফিরতে হলো শিলাইদহে। শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসর প্রভৃতি জায়গায় কবি বাস করছেন কাজের জন্যেই আর সেই সুবাদে পরিচয় ঘটছে পল্লী গ্রামের মানুষজনের সাথে। পল্লীবাংলার সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি কান্নার সঙ্গে কবির পরিচয় ক্রমশঃ নিবিড় থেকে নিবিড়তর হতে লাগলো। একের পর এক লিখে চললেন ছোটগল্প ও বিভিন্ন রচনা। জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে যে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লব্ধ হলো… তার প্রতিফলন ঘটতে দেখা গেল একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টিকর্মে। লেখনিতে যেন বর্ষার বান ডেকে গেল! ফাল্গুন মাসে বসন্তের দিনে কবির হৃদয় রসের গহন বানে ভেসে এলো "সোনার তরী"!  লিখলেন - 

     

 "গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

   কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা ধান-কাটা হল সারা,

 ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা -

কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা।" 


 মানুষের সংস্পর্শেই কর্মের পথ এবং সাহিত্যের পথ পাশাপশি প্রসারিত হয়েছে কবির জীবনে। "সোনার তরী" কবিতাটি ঘন বর্ষায় আচ্ছন্ন একটি নদীচরের নিসর্গ সৌন্দর্যের চিত্র। প্রকৃতি ও মানুষ এখানে একাত্ম হয়ে গেছে। এখানে একমাত্র কান্ডারী কালতরঙ্গ পরাজয়ী সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। যাঁকে বাইরের দৃষ্টি দিয়ে নয় অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয়। 

  

      "সোনার তরী" রবীন্দ্রনাথের সাধন তরী। কবির কাব্য প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে এই কবিতায়। কাব্য চেতনায় জীবন দেবতা তত্ত্বের উন্মেষ ঘটেছে এখানে। পার্থিব যত কিছুর সমষ্টি ওই সোনার ধান। আর সোনার তরীর নেয়ে এখানে কবির অন্তরদেবতা। ইতিহাসের পাতায় মানুষের সৃষ্টিকর্ম সঞ্চিত হয়ে থাকে। জগৎ সংসার তাঁর সৃষ্টিকর্মকে চায় কিন্তু স্রষ্টা কে চায় না- এটাই চিরন্তন সত্য। আর এই চিরন্তন সত্যটিই এই কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে। 

     

     "ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী" - 


  কবি স্বয়ং নির্জনতায় নির্বাসিত। 


   কিন্তু, এমন একটি কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পাই - "কী কুক্ষণে সোনার তরী কবিতাটি লিখলেন! এই একটি কবিতা নিয়ে বাংলা সাময়িক সাহিত্যে যে পরিমাণ অমৃত ও গরল মথিত হয়ে উঠেছিল, তা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের কোন একটি রচনা সম্বন্ধে কী পূর্বে কী পরে কখনো হয় নি।" 


    কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কবিতাটিকে অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য বলে অভিহিত করলেন। কবিতাটি বসন্তকালে রচিত বলে দ্বিজেন্দ্রলালের মতে এটি কবির অন্তর প্রেরণাজাত নয় কৃত্রিম রচনা। 

    

     অন্যান্য সমালোচকদের মতে বাস্তবে মাটিতে না দাঁড়িয়ে কবি শুধু কল্পলোকে বিচরণ করেছেন! শ্রাবণ মাসে ধান কাটা হয় না। চারিদিকে বাঁকা জল পরিবেষ্টিত চরে ধানের চাষ হয় না। ভরাপালে তরী বাওয়ার প্রশ্ন নেই, নৌকা এমনিই চলতে থাকে। 

   

    কিন্তু…. এতো অভিযোগের পরও কবিতাটি পাঠক হৃদয়ে রস সঞ্চার করেছে যথেষ্টই। কবিতাটি অসংখ্য কালোত্তীর্ণ কাব্যের মধ্যে অন্যতম।

 

    ‘শান্তিনিকেতন' গ্রন্থের ‘তরী বোঝাই’ শীর্ষক ভাষণে (৪ চৈত্র ১৩১৫) রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী'র ব্যাখ্যায় বলেছেন— “প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু না কিছু দান করছে, সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করছে, রক্ষা করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না। কিন্তু মানুষ যখন সেইসঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে, তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল অহংটিকে তার খাজনা স্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে—ওটি কোনোমতেই জমাবার জিনিস নয়।”


     আবার ‘সোনার তরী' সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছেন, আমার মনে ‘সোনার তরীর’ যে ইতিহাস সত্য হয়ে গেছে সেটা হচ্ছে সেই শ্রাবণ-দিনের ইতিহাস, সেটা যে কোন্ তারিখে লিখিত হয়েছিল সেইটেই আকস্মিক—সে দিনটা বিশেষ দিন নয়, সে দিনটা আমার স্মৃতিপটে কোনো চিহ্ন দিয়েই যায় নি।” 

              …………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - দেবপর্ণা জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...