তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা
কাটা হাত
আমাদের ট্রেন খুব জোরে ছুটছে,
কোন স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে না,
অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে থেকে শুধু একটা কাটা হাত -
এছাড়া বাইরের কোন দৃশ্য আমরা দেখতে পাচ্ছি না ।
আমরা অনেকেই বহু কালো হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার কথা বলেছি,
আমরা অনেকেই হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে চেয়েছি বহু দূর,
এমনকি কোন কান টানলে কার মাথা নড়ে এবং কার হাত শক্ত হয় -
এতদিনে এসব আমাদের জানা হয়ে গেছে,
কিন্তু আমরা কেউ ট্রেনটা থামাতে পারিনি,
আমরা কেউই কাটা হাতটার থেকে বিচ্ছিন্ন বাকি শরীরটাকে খুঁজতে বেরোতে পারিনি।
ট্রেনটা আসলে খুব জোরে ছুটছে,
কোন স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে না,
এত জোরে যে আমরা কারো চিৎকার শুনতে পাচ্ছি না,
আর বুঝতেও পাচ্ছি না আমাদের আসলে কোন হাত নেই,
হয়তো কোনদিন ছিলই না!
দেবী সিরিজের কবিতা
জাতীয় সড়ক জ্বলছে
জাতীয় সড়ক। দুপাশে অন্ধকারের ঢেউ,
ধানক্ষেত দুলছে, ধানক্ষেত রক্তে ভেসে যাচ্ছে,
টলমল হাঁটছে কেউ, পালাতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে,
মরে যাচ্ছে, মরে যাওয়া যথেষ্ট ছিল না বলে চিতা,
বিনা আয়াসেই দাউদাউ চিতা। এই কি চন্দনকাঠ? কোন গন্ধ নেই তো!
আমি কেবল মাংসের গন্ধ পাচ্ছি, আমার নিজের মাংস, আমার বোনের মাংস,
আমার ক্লাসের সব বন্ধুদের, জঙ্গলজিলাবি গাছের গায়ে হেলান দেওয়া আমাদের সাইকেলের মাংস...
লেডিবার্ড, লেডিবার্ড, এগুলো আবার কোন কিসিমের পাখি?
কাল দেশ জুড়ে ফিমেল ব্ল্যাক আউট, কোন পাখি উড়বে না,
পাখি উড়লেই যেহেতু গুলি করে নামানো হবে,
তাই জাতীয় সড়ক একটি নিখুঁত ভুগোল বইয়ের মতো, পাতাছেঁড়া,
আমরা মাঝে মাঝে দেখেছি ওরকম বই,
যখন আমরা ইস্কুল যেতাম, যেদিন আমরা ইস্কুল যেতাম,
জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে সারি সারি সাইকেল, লেডিবার্ড,
লেডিবার্ড হড়কে ধানক্ষেতে নামে, ঘষটাতে ঘষটাতে ধানক্ষেতে,
রক্ত খুব ভালো সার, হাড়ের টুকরোয় ভরপুর ক্যালসিয়াম,
আমরা জীবনবিজ্ঞান পড়েছিলাম একদিন,
আমার খুব ওইরকম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নারী শিশু,
দাবাখানা, চশমা পরা ডাক্তারনি, করিনা কাপুরের মতো,
ইচ্ছে ছিল, লেডিবার্ড চড়ে, জাতীয় সড়ক ধরে আরও আরও ভেতরের গ্রামে...
কিন্তু হবে না, যেহেতু আমি মরে গেছি, আর ভালো করেও মরি নি,
আর আমাদের মাংস জল-অচল হতে হতে আগুন-অচল ও,
তাই ওখানে কী পুড়ছে? আজীব বাত! সত্যি তো কিচ্ছু পোড়েনি,
জাতীয় সড়ক, তার দুধারে অন্ধকারের ঢেউ, ধানক্ষেত দুলছে,
কোজাগরী দুদিন পর, ধানের দুধ খেতে নামছে লক্ষ্মীপেঁচা,
কিন্তু আমরা কিচ্ছু খাইনি, আমি, আমার বন্ধুরা, আমার বোন,
জিভটা থাকলেও আমরা কাউকে ঞকিচ্ছু বলতাম না,
কিন্তু এত ফালতু আগুন, আমরা ভালো করে পুড়তে পারলাম না,
শুধু পোড়া মাংসের গন্ধ নিয়ে হাঁচড়পাঁচড় উঠে এলাম জাতীয় সড়কে,
প্রতিটি ধানক্ষেত থেকে উঠে এলাম,
আর আমাদের দোমড়ানো লেডিবার্ডের পাশ দিয়ে যে সব গাড়ি ছুটছিল-
তারা দেখল জাতীয় সড়ক জ্বলছে, খামোখা!
ভাষান্তর কবিতা
অনিতা থাম্পি ; প্রতীক
কাস্তে ছোঁয় খ-মধ্য
তারা ফিরে আসে শিশুর চোখে,
একা হাতুড়ি,
অ-রোমান্টিক উৎসের যন্ত্রণাদীর্ণ,
পেরেকের মাথায়
ঘা মারতে শুরু করে,
যে পেরেকের কথা ছিল
ইতিহাসকে ছবি করে টাঙাবার।
একদিন এইসব হবে
পোড়া সিগারেটের টুকরোগুলো
আস্ত হয়ে আবার সেঁটে যাবে ঠোঁটে,
আর আগুন চাইবে,
ঝরে পড়া চুল
আবার ফিরে যাবে
তেল চুকচুকে করবীতে,
দাবি করবে ফুল।
রাতে
স্নায়ু থেকে চুঁইয়ে পড়া স্বপ্নগুলো,
যারা ক্লেদের মতো ছড়িয়ে পড়ে,
ঘেঁষাঘেঁষি শুয়ে জল চাইবে।
সেই দেশে , যেখানে এখনও আগুন আবিস্কৃত হয়নি,
সেই দৃশ্যপট যা কখনো ফুল ফুটতে দেখেনি
সেখানে আমরা ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত খুঁজতে থাকব
সেই একটুকরো লাল,
আমাদের ভাবনায়, চেতনায়-
তোমার কাছে আগুন
আমার কাছে ফুল।
উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে
ভোরবেলা, স্মৃতির উঠোন
কেঁচোর খুঁড়ে রাখা মাটিতে ভরে আছে,
বাড়িটা চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে।
ঝাঁট দিতে দিতে আমার পিঠ টাটিয়ে যায়।
হয়তো কাল রাতে বৃষ্টি হয়ে গেছে,
উঠনের মাটি ভিজিয়ে,
বিনিদ্র চোখে কেঁচোগুলো
মাটি খুলে বানিয়েছে ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়েঘর।
ঝুঁকে পড়া মেয়েটার
শিরদাঁড়া বাঁকানো নাচ শেষ হলে
নারকেল পাতার শির দিয়ে বানানো
ঝাঁটা জল ঝরিয়ে, চিত হয়ে পড়ে থাকে
ঝাঁট শেষ, ভোর হয়, আলো ফোটে
ঘুমচোখ খুলে বাড়িটা দেখে,
পায়ের ছাপছোপ, এমনকি শুকনো পাতাও
পড়ে নেই, উঠোনটা তকতক করছে।
রাতকে ছেঁকে ছেনে দরজায় গোঁত্তা খেয়ে
যেই মাটিতে আছড়ে পড়ে খবরের কাগজ,
জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে, সে পিঠ সোজা করে দাঁড়ায়
বড়ো তেষ্টা, সে এখন তলানিসুদ্ধু কফি পান করে নিতে পারে।
★★★অনিতা থাম্পি- জন্ম ১৯৬৮। মলয়ালম ভাষার কবি। পেশায় বিজ্ঞানী। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- মুত্তামতিক্কুমবোল।
………………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - ভগীরথ সর্দার
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment