রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ২৭
তুলি-কলম
মহাশ্বেতা দাস
জমিদারি দেখাশোনার জন্য প্রায়ই এদিক ওদিক বিশেষত উত্তরবঙ্গ যাতায়াত করতে হয় রবি কে। এবার যেতে হলো উড়িষ্যা। তখনও রেলপথ হয়নি তাই এখনকার মতো এক রাতের সফরে উড়িষ্যা পৌঁছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। জলপথে যাতায়াত করতে হতো যা ছিলো যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ। যাইহোক জমিদারি দেখাশোনার সাথে সাথে লেখনীও চলছে বেশ। পান্ডুয়ার কাছারি বাড়িতে বসে লিখে ফেললেন "চিত্রাঙ্গদা"।
পূজার সময়ে কলকাতায় ফিরে দেখলেন ঠাকুরবাড়ি থেকে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার আয়োজন চলছে। এই ধরণের ঘটনা ঠাকুরবাড়িতে নূতন কিছু নয়। এর আগেও ঠাকুরবাড়িতে এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে তখন উদ্যোগী ছিলেন রবীন্দ্র অগ্রজ দাদা এবং বৌঠানরা। এবারের উদ্যোক্তারা নূতন। এবার রবির ভ্রাতুষ্পুত্রদের আগ্রহে প্রকাশিত হতে চলেছে "সাধনা".... অগ্রণী ভূমিকায় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথ। সে যাইহোক ভাইপো ভাইঝি রা জানে যে পত্রিকার খোরাক যোগাবে তাদের প্রিয় "রবিকা", বাস্তবে ঘটলোও তাই। সম্পত্তি সমর্পণ, কঙ্কাল, জীবিত ও মৃত, স্বর্ণমৃগ, জয়পরাজয়…. এইভাবে একবছরের মধ্যে এগারোটি গল্প, ডায়রি, প্রবন্ধ, পুস্তক সমালোচনা প্রভৃতি রবীন্দ্র লেখনীর একনিষ্ঠ সাধনা স্পর্শে ভরে উঠলো একে একে "সাধনা" পত্রিকার পাতা গুলি।
সাধনা পত্রিকার বিষয়ে তো অনেক কথাই বলা যায়। তবে ভাইপো ভাইঝি দের সাথে তাদের প্রিয় "রবিকা" র যে মেলবন্ধন….. তা কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার কে সমৃদ্ধ করেছে অনেকখানি। রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন স্নেহশীল পিতা, কর্তব্যপরায়ণ স্বামী তেমনি ভাইপো, ভাইঝি এবং পরিবারের অন্যান্য লোকজনের সাথেও তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড় ভালোবাসায় বাঁধা। একে একে সেকথা বলা যাবে। আজ না হয় রবীন্দ্রনাথের প্রিয় "অবন" (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর) সম্পর্কেই কিছু বলা যাক।
ঠাকুর বাড়ির দুই সন্তান, বয়সের ফারাক মোটে দশ বছর হলেও সম্পর্কে কাকা-ভাইপো। সম্পর্ক যাইহোক জীবন সমুদ্রে একাধিক দিক থেকে ছিলেন পরস্পর দোসর।
জীবনের শুরুতে একজনের হাতে কলম আর একজনের হাতে তুলি । কিন্তু যিনি সবসময় অনেক কিছুতেই মেলবন্ধন ঘটিয়ে এসেছেন সেই বিশ্বের বিস্ময় কবিগুরু কী পারেন থেমে থাকতে! 'অবন' কে যে তাঁর চাই-ই-চাই।
১৮৯২সাল, লিখলেন কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। লেখার সময়ই অবনীন্দ্রনাথের উপর নির্দেশ এলো চিত্রনাট্যের উপযোগী ছবি দেওয়ার জন্যে। অবনীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন,- "....এই হল রবিকাকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। তারপর থেকে এতকাল রবিকাকার সঙ্গে বহুবার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁর প্রেরণা।"
কথাশিল্পী অবনীন্দ্রনাথকেও আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর 'রবিকা'। ছোটদের উপযোগী লেখা চাই। প্রিয় অবনকে বললেন- "তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে মুখে গল্প কর তেমনি করেই লেখো।" তাঁর উৎসাহেই অবন লিখলেন- "শকুন্তলা"। রবীন্দ্রনাথ লেখাটির প্রশংসা করলেন। এরপর প্রবল উৎসাহে পর পর লিখে ফেললেন ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা ইত্যাদি । সাহিত্য সমালোচক মহলে যাঁর সম্পর্কে বলা হয় তিনি "ছবি লিখতেন" আর "কথা আঁকতেন"।
তবে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় লেখা শুরু করলেও অবনীন্দ্রনাথের লেখা ছিল সম্পূর্ণভাবে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
শুধুমাত্র লেখা বা ছবি আঁকা নয়, রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধন উৎসব থেকে স্বদেশী আন্দোলন- সবেতেই অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্যতম সঙ্গী ও উদ্যোক্তা। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন সেখানেও ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ ব্যক্তিদের সাথে তাঁর সাহচর্যে ছিলেন প্রিয় "অবন"। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর "রবিকা'র" সেই লড়াই কে তাঁর "ঘরোয়া" গ্রন্থে ব্যক্ত করেছেন -
সেদিন সকাল বেলা পায়ে হেঁটে গঙ্গার জগন্নাথ ঘাটে পৌঁছে গেলেন সবাই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার দু পাশে লোকে লোকারণ্য। মেয়েরা শাঁখ বাজাচ্ছে, ফুল ছড়াচ্ছে... মনিব চাকর সবাই একসাথে স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি বাঁধলেন। সারা বাংলা সেদিন পালন করল অরন্ধন দিবস। হাঁটতে হাঁটতে পাথুরে ঘাটার বীরুমল্লিকের আস্তাবলে সহিসদের হাতে রাখি বাঁধলেন, সহিসরা তো অবাক!! তারপর চিৎপুরের মসজিদে গিয়ে মৌলবীদের হাতে ও রাখি বাঁধা হল। এভাবে সেদিন রাস্তায় যাদেরই দেখা পাওয়া গেছে.... ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কে পরানো হল রাখি আর গাওয়া হয়েছিল সেই গান -
"বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু
বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক পূণ্য হউক হে ভগবান।"
২৫শে জুলাই ১৯৪১ সাল, রবীন্দ্রনাথ চিরতরে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে এলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। মহর্ষি ভবনের দোতলায় 'পাথরের ঘরে' কবির থাকার বন্দোবস্ত হল। ২৬শে জুলাই কাছে এলেন ভাইপো 'অবন'। সেদিন কাকা- ভাইপো আলাপচারিতায় বোধয় স্মরণ করেছিলেন অতীত দিনের সেইসব স্মৃতি।
৭ই আগস্ট অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। ঠাকুরবাড়ির প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমীর দিনই জন্মদিন পালন করা হত। এই উপলক্ষে একবার রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় কলাভবনের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী মিলে পালিত হয়েছিল অবনীন্দ্র জয়ন্তী।
কিন্তু শ্রাবণ গগন ঘিরে চিত্রটা একরকম থাকলো না।
১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট সমস্তই বদলে গেল, চলে গেলেন সব পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে 'রবিকা'। শূন্য নদীর তীরে পড়ে রইলেন প্রাণপ্রিয় 'অবন' একা। ঠাকুরবাড়ির ফটক পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের দেহ নিয়ে যখন নিমতলা শ্মশান ঘাটের দিকে যাত্রা করা হচ্ছে… ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে সেদিন অবন এঁকে চলেছেন সারি সারি হাত আর তার উপর দিয়ে ভেসে চলেছে রবীন্দ্রনাথের দেহ।
এর কিছুদিনের মধ্যেই এতদিন ঠাকুর বাড়ির যে মালাটি একসূত্রে গাঁথা ছিল, তা আর রইল না। ঠাকুরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার কে। অবনের জীবনের বাকি দিনগুলি কেটেছিল বরাহ নগরের গুপ্ত নিবাসে।
প্রকৃতির কী অমোঘ লীলা! এক শ্রাবণে অবনীন্দ্রনাথের জন্ম আর এক শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু। শুধু খামখেয়ালিতে নয়, শুধু সৃষ্টিশীলতাতেও নয়, শ্রাবণ সূত্রেও কাকা-ভাইপো হয়ে রইলেন দোসর।
"ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার
যায় চলে আলোকে ।"
……………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment