রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ২২
সীমার মাঝে অসীম
মহাশ্বেতা দাস
"প্রকৃতির সৌন্দর্য সে কেবল আমারই মনের মরীচিকা নহে। তাহার মধ্যে সে অসীমের আনন্দই প্রকাশ পাইতেছে।"
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসু, প্রকৃতি প্রেমী রবীন্দ্রনাথ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কে আস্বাদন করেছেন খুব নিবিড় ভাবে। প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক কে অনুধাবন করে সীমার মাঝে অসীমের সুর বাজিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিশীলতায়। ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটির "দক্ষিণের বারান্দায় এক কোণে আতার বিচি পুঁতিয়া" রোজ জল দেওয়া বা "পড়ার ঘরের এক কোণে নকল পাহাড় তৈরী করে তার মাঝে ফুল গাছের চারা পোঁতা" দিয়ে যে শিশুমনটি প্রকৃতির সৌন্দর্য অন্বেষণে নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা শুরু করেছিল -- ক্রমাগত সেই ভাবনায় রসদ সরবরাহ করেছেন প্রাথমিক পর্বে পিতা এবং পরে অগ্রজরা বিশেষত জ্যোতিদাদা এবং কাদম্বরী দেবীর সান্নিধ্য।
রবির বয়স যখন ক্রমে বাইশ সেই সময়ে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ কর্ণাটকের কারোয়ার নগরে বদলি হয়ে এলেন। সমুদ্র খাড়িতে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই মনোরম স্থানটির সৌন্দর্য আস্বাদন করতে জ্যোতিদাদা ও নূতন বৌঠানের সঙ্গ নিলেন রবীন্দ্রনাথ।
"নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ"র মধ্যে দিয়ে রবির লেখনীর যে বহির্মুখী প্রবৃত্তি প্রকটিত হয়েছিল তা কেবলমাত্র অস্পষ্ট ভাবের ঘোরের মধ্যে তাঁর বন্ধন স্বীকার করে ক্ষান্ত রইল না। বেদনার ভিতর দিয়ে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে নব নব ভাব প্রকাশের চেষ্টায় সে হল সৃষ্টিশীলতায় মশগুল। কারোয়ার থেকে জাহাজে আসতে আসতে তাই হঠাৎ যে গান সমুদ্রের উপর প্রভাত সূর্যের আলোকে সম্পূর্ন হয়ে দেখাদিল -- "হেদে গো নন্দরানী" তা পরিণতি পেল "প্রকৃতির প্রতিশোধ" নাটকে। গুহাবাসী সন্ন্যাসীর অন্তরের কথা যা প্রকাশিত হয়েছে এই নাটকটিতে তা যেন রবির প্রথম জীবনে ভৃত্য পরিবেষ্টিত বদ্ধ জীবন থেকে ক্রমাগত একটু একটু করে যে মুক্তি এবং বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু দর্শনের মত সীমার মাঝে অসীমের রূপ দর্শনের যে প্রয়াস.... সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
শুধুমাত্র প্রকৃতিকে নয়, প্রকৃতির কোলে বিচরণশীল সমস্ত প্রাণময় সত্তাকেই রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসেছেন, ভালবাসার কথা বলেছেন তাঁর লেখনীতে। তাইতো "প্রকৃতির প্রতিশোধে"র মধ্যে একদিকে যখন গ্রামের নরনারী, পথের লোকজন নিজেদের
ঘরগড়া প্রাত্যহিক তুচ্ছতার মধ্যে অচেতনভাবে দিন কাটাচ্ছে
আর একদিকে সন্ন্যাসী অসীমের মাঝে সমস্তকিছুকে বিলুপ্ত
করার চেষ্টা করছে..... তখন রবীন্দ্রনাথ দুইপক্ষের বিভেদ
ঘুচিয়েছেন প্রেমের সেতুবন্ধনে। একটি বালিকা যখন ইন্দ্রিয়ে
র দ্বার অবরুদ্ধ করে রাখা গুহাবাসী সন্ন্যাসীকে স্নেহপাশে বদ্ধ
করে অনন্তের ধ্যান থেকে সংসারের মধ্যে তাঁকে ফিরিয়ে
আনে.… তখনই সীমার মাঝে অসীমের অনুভবে প্রেমের
আলোয় মনের মুক্তি ঘটে। প্রেমের সেতুতে দুইপক্ষের বিভেদ
ঘুচে যায়। মিলন ঘটে গৃহীর সঙ্গে সন্ন্যাসীর। দূরীভূত হয়
সীমার মিথ্যা তুচ্ছতা এবং অসীমের মিথ্যা শূন্যতা। আরও
পরিণত বয়সে যে ভাবনাটিই কাব্যরূপ ধারণ করে....
"বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।"
............................
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment