রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ২৫
সুদূরের পিয়াসী
মহাশ্বেতা দাস
মুক্ত প্রকৃতির ক্লান্তিহীন পথিক রবীন্দ্রনাথ। তখনও সংসারের জন্য অর্থ উপার্জনের গুরু দায়িত্ব ঠাকুর বাড়ির ছেলেদের কাঁধে সেভাবে ভর করে নি। আপন মনে কবিতা, গান লেখা, বন্ধুদের সাথে সাহিত্যের আড্ডা, মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সম্পাদিত "বালক" পত্রিকায় শিশুদের উপযোগী গল্প, কবিতা, নাটক প্রভৃতি রচনায় ভরিয়ে তোলা এভাবেই রবি যাপন করছেন খামখেয়ালী জীবন। এককথায় সৌন্দর্য্য ও শৌখিনতায় কলকাতা শহরের যুবকদের অনুকরণ ও ঈর্ষার পাত্র রবীন্দ্রনাথ।
পশ্চিম ভারতের রোমান্টিকতা রবির কবিমন কে আকর্ষণ করতো খুব। গাজিপুরের গোলাপ ক্ষেতের সৌন্দর্য্য কবিকে বিশেষ ভাবে টানত। তাই হঠাৎই একদিন একবছরের মেয়ে বেলা আর মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে চলে এলেন গাজিপুর। যদিও যে মোহ নিয়ে এসেছিলেন…. "ব্যবসাদারের গোলাপক্ষেত" দেখে ভেঙে গেল সে মোহ! কঠিন বাস্তবতায় প্রকৃতি পিপাসু কবি অনুভব করলেন এখানের গোলাপ বনে "বুলবুলের আমন্ত্রণ নেই, কবির ও নেই।" তবু কল্পনা প্রবণ স্বভাব কবি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে ফেললেন শিশু কাব্যগ্রন্থের এবং মানসী কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা।
১৮৮৯ সাল….. এখন আর বেলা একা নয়। মৃণালিনী দেবীর কোল আলো করে এসে গেছে রথীন্দ্রনাথ। মহর্ষির ও বয়স হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই জমিদারির দায়ভার গ্রহণের সময় এসে হাজির। জমিদারি দেখাশোনার জন্যই এবার রবিকে কলকাতা ছেড়ে যেতে হলো শিলাইদহ। উত্তর বঙ্গের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আস্বাদন করার বড়ো সুযোগ পেয়ে গেলেন রবি। জমিদারি দেখাশোনার পাশাপশি এখানকার প্রকৃতি, সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য রবির সাহিত্য রচনার সহায় হলো।
"তোরই হাতে বাঁধা খাতা
তারই শ-খানেক পাতা
অক্ষরেতে ফেলিয়াছি ঢেকে।"
ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ কে উৎসর্গ করলেন সাজাদপুরের নির্জন কুঠিতে বসে লেখা "বিসর্জন" নাটক। এরপর বোলপুরের প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছুদিন কাটিয়ে সোলাপুরে মেজদাদার কাছে গিয়ে যেই শুনলেন বন্ধু লোকেন পালিত আর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত যাচ্ছেন!.... "সুদূরের পিয়াসী" কবি চঞ্চল হয়ে উঠলেন, তাদের সঙ্গী হলেন।
১৮৯০ সালের ২২শে আগস্ট "শ্যাম" জাহাজে চড়ে তিনজনে পাড়ি দিলেন বিলেতের উদ্দ্যেশ্যে। এডেন বন্দরে যেদিন পৌঁছলেন… জ্যোৎস্না রাতের নিস্তরঙ্গ সমুদ্র শোভা মোহিত করলো কবিকে। আইওনিয়া দ্বীপের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে আর বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আস্বাদন করতে করতে ১০ই সেপ্টেম্বর লন্ডনে এসে কবির ইচ্ছে হলো কৈশোরের পরিচিত লন্ডন কে ফিরে পেতে।
"দূরে বহুদূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রা নদীপারে
মোর পূর্বজনমের প্রথম প্রিয়ারে।"
প্রায় এক যুগ পরে এসে রবি খোঁজ করলেন সেই বাড়ি… সেই স্কট পরিবারের। কিন্তু তখন আর কে কোথায়! সে বাড়িতে থাকে তখন অন্য ভাড়াটিয়া।
কৈশরে দেখেছিলেন লন্ডন শহর কে কিশোরের উদ্দীপ্ত চোখ দিয়ে। এবার যুবক রবি যৌবনের উদ্দীপনায় লন্ডন শহর এবং সেখানকার পরিবেশ, রীতিনীতি কে আস্বাদন ও অনুধাবন করলেন নব রূপে। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনও নিজস্ব পোশাক ত্যাগ করে বিলিতি পোশাক পরেন নি। এখনকার ঐশ্বর্য্য ও বিলাস বহুল জীবন চর্যায় রবির অভিজাত মন যেমন মুগ্ধ হয়েছিল তেমনই এই বিলাস বহুলতার পিছনে যে গভীর দুঃখ লোক চক্ষুর অন্তরালে আপাত অদৃশ্য ছিলো… সেটিও রবির অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে নি।
দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্যে যতখানি ব্যস্ততা…. খামখেয়ালী কবিমন ঘরে ফেরার জন্যে ঠিক ততটাই ব্যাকুল। তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ঠিক করলেন দেশে ফিরে আসবেন একাই। ৭ই অক্টোবর "টেমস" জাহাজে চড়ে মলাট দ্বীপ, বিখ্যাত catacomb প্রভৃতি দেখতে দেখতে ৩রা নভেম্বর দেশের মাটিতে ফিরে এলেন। আর এই দ্বিতীয়বার বিলেত সফরের দরুণ বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ হলো "য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরি" র মতো মূল্যবান সাহিত্য সম্পদে।
……………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪