রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১৯
একাকীত্ব
মহাশ্বেতা দাস
"অচেনা এই ভুবন মাঝে
কত সুরেই হৃদয় বাজে।"
সবদিন কারও জীবনেই একরকমভাবে থাকে না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারও তাই এই নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু নয়। এতদিন পত্র পত্রিকা নিয়ে উন্মাদনা, লেখালেখি, সাহিত্যের আড্ডা, গান বাজনা, নাট্যাভিনয় - সব মিলিয়ে বাড়ির সদস্য এবং বন্ধু সমাগমে যে জমজমাট এক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিনগুলি কাটছিল..... তা ক্রমে অনেকটাই শিথিল হয়ে এলো। বিলেত থেকে কিছুই না করে বা কিছু না হয়ে ফিরে এসে আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হওয়া রবির একমাত্র সান্ত্বনার জায়গা ছিল জ্যোতিদাদা ও নূতন বৌঠান। মহর্ষি তো কলকাতা থেকে প্রায়ই দূরে দূরে থাকেন। এদিকে বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ নিজের সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন। মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর পরিবার নিয়ে বোম্বাই বাসী। হেমেন্দ্রনাথ কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে থাকলেও রবির সাথে সেভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি কোনদিনই। তাহলে যাদের কাছে স্নেহ আবদার খাটত তারা হলেন জ্যোতিদাদা ও বৌঠান। এঁদের স্নেহ-ভালোবাসা রবির জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতোই মঙ্গলপ্রদ ছিল। কিন্তু এই বৌঠান কাদম্বরী দেবীই আবার ছিলেন প্রচন্ড অভিমানিনি। এই সময়ে অর্থাৎ শেষ জীবনাহুতি দেওয়ার আগেও একবার তিনি কোন এক অজানা কারণে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে তাঁকে সুস্থ করে তোলার জন্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কলকাতার বাইরে দূরে নিয়ে যান। রবি হয়ে পড়লেন একাকী, নিঃসঙ্গ.... অসহায় বোধ করতে লাগলেন।
"যেখানেতে অগাধ ছুটি
মেল সেথা তোর ডানা দুটি
সবার মাঝে পাবি ছাড়া।"
তেতালার ছাদ ও শূন্য ঘর গুলিতে একাকী নির্জনে দিন কাটাতে কাটাতে কবির মনে এলো এক অভাবনীয় পরিবর্তন যার প্রভাব পরিলক্ষিত হলো পরবর্তী কাব্য রচনায়। এতদিন কাব্য কবিতা রচনার ক্ষেত্রে রবির কবিমন অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার বা জবাবদিহি করার এক অনির্বচনীয় সংস্কারের মধ্যে কবিমন আবদ্ধ ছিল সেই অবস্থা থেকে যেন মুক্তি ঘটলো - একথা জীবনস্মৃতি গ্রন্থে তিনি নিজেই বলেছেন।
এই মুক্তি..... এই বাঁধন ছাড়া অগাধ ছুটির দিনগুলি কবিমনে যে নূতন অনুভূতির সঞ্চার করলো তার ফল স্বরূপ রবির কাব্য - জীবনে এলো বৈপ্লবিক পরিবর্তন.... সৃষ্টি হল কাব্য কবিতার নূতন ধারা।
"না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠিছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠিছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।"
রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায় আমরা পাই - "এতদিন পরে বিহারীলালের অনুকৃতি হইতে রবীন্দ্রনাথের মুক্তি হইল।"
কবির লেখনীতে সৃষ্টি হল - সন্ধ্যাসঙ্গীত, প্রভাত সঙ্গীত, শৈশব সঙ্গীত, ছবি ও গান এবং কড়ি ও কোমল এর মতো অসাধারণ কাব্য গুলি যা বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে অতুলনীয় সম্পদ।
…………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment