সুনন্দা
রোহন নাম্বিয়ার
নিজের কাঁধ থেকে সৌরভের হাত সরিয়ে দিল সুনন্দা। কেন যে হঠাৎ করে সুনন্দার মুখ বিষণ্ণসন্ধে কিছুতেই বুঝতে পারছে না সৌরভ।
কেন? তুই আমাকে ভালবাসিস না? – সৌরভ বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে!
চারশো মিটার দূরে ব্রিজের ওপর ঘড় ঘড় করে ট্রেন যাচ্ছে। নীচে নদী। বামদিকে নদীর উঁচু পাড়ে ওরা পাশাপাশি বসে আছে। চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়েই সুনন্দা বলে– বাসি তো।
-তাহলে যে বিয়ে করবি না বললি? আমি তো আর এখনই করতে বলছি না!
সৌরভের ফাইনাল ইয়ার শেষের মুখে। আর পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই তাই ইতিমধ্যেই সে একটি সেলসের কাজ জুটিয়ে ফেলেছে। সেলসের কাজ সৌরভের জন্য উপযুক্ত। কারন সারাদিন খাওয়া দাওয়া ভুলে ঘোরার সাথে সাথে ও বকতেও পারে খুব। এক এক সময় সুনন্দাও বিরক্ত হয়ে বলে দেয় একটু শান্তি দিবি? কিছুক্ষণ চুপ তারপর সব ভুলে আবার যেই কে সেই, শুরু হয়ে যায় তার বকবক। সুনন্দার সেকেন্ড ইয়ার। পলিটিক্যাল সায়েন্স। সে অ্যাকাডেমিক লাইনেই এগোতে চায়। প্রফেসার হওয়ার ইচ্ছে। একটু চুপচাপ, একটু একা থাকতেই যে সে পছন্দ করে তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। কলেজেও তার মাত্র তিনজন বান্ধবী। সৌরভের সাথে পরিচয় হওয়ার পর অবশ্য সৌরভের বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে এবং মাঝেমাঝে আড্ডাও মারে ইদানীং।
সুনন্দা নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বিকেলের রোদ এখন গায়ে লাগছে না। একটা ডিঙ্গিতে দুজন লোক ভেসে যাচ্ছে। সৌরভ ডাকে – কি রে, কি হয়েছে?
সুনন্দা এমনভাবে তাকাল যেন এই ঘুম থেকে উঠল – না কিছু না।
সুনন্দা প্রথমদিন কলেজে গিয়েই দেখেছিল সৌরভকে। ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চেনা যায় । ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়া নিয়ে স্লোগান তুলছিল। পরেরদিন দশ পনেরো জন ছেলেমেয়ের সাথে তাদের ক্লাসে এসে বক্তব্য দিয়েছে। বক্তৃতার মূল কথা ছিল তাদের যেকোনো অসুবিধায় সৌরভরা পাশে আছে। তার কয়েকদিন পর সুনন্দা জাস্ট বাস থেকে নেমেছে আর কয়েকজন ছেলে হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠে কনট্রাক্টরকে কলার ধরে টেনে নামাচ্ছে। তারপরই মারধর, রাস্তা আটকানো। এসবের কারন হল বাস না কি স্টুডেন্টদের কন্সেশন দিচ্ছে না। আরও মাস খানেক পর সে লক্ষ্য করেছে সৌরভ কাছে না এলেও একটু দূর থেকে ছায়ার মত লেগে আছে। বাসস্টপের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সৌরভ সিগারেট খাচ্ছে। ক্যান্টিনে সুনন্দারা খাচ্ছে, চায়ের কাপ হাতে কারো সাথে কথা বলতে বলতে তাকাচ্ছে। সুনন্দা ক্লাস করছে ক্লাসের বাইরে ঘুরঘুর করছে। এইরকম কাণ্ড তার একদমই ভালো লাগত না। সে খুব একটা পছন্দও করত না সৌরভকে। একা, একটু গোপনে থাকতেই তার স্বস্তি।
সুনন্দাদের জন্য মানে ফার্স্ট ইয়ারের জন্য ফ্রেশার্স ওয়েলকামের আয়োজন করেছে সিনিয়ররা। সুনন্দা যেত না কিন্তু যেতে হল বান্ধবীদের চাপে পড়ে। কলেজের স্যাররা বক্তৃতা দিলেন, ফার্স্ট ইয়ারদের চন্দনের ফোঁটা ও কলম দিয়ে বরণ করা হল। স্টুডেন্টরা কেউ গান গাইছে, কেউ আবৃত্তি, কেউ নাচ। সব শেষে সৌরভ কাঁধে একটা গিটার নিয়ে শুরু করল– “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ"। গোটা হল হৈ হৈ করে উঠেছে। হৈ হৈ করার প্রথম কারন ভালো গান গাইছে। দ্বিতীয় সৌরভ গাইছে। এই প্রথম সৌরভকে তার অতটা খারাপ লাগে নি। মনে হয়েছিল ছেলেটি তাহলে শুধুই ইউনিয়নবাজী করে বেড়ায় না ।
একদিন কলেজের মাঠে ওরা বসে আছে। সেদিন সৌরভ একাই এসেছিল। এসেই সুনন্দাকে জিজ্ঞেস করল–কেমন আছো? সুনন্দা হঠাৎ এইরকম প্রশ্ন শুনে অবাকভাবে উত্তর দিয়েছিল–ভালো। সে নিজেই সুনন্দার বান্ধবীদের নাম জিজ্ঞেস করল। এরপর ধীরে ধীরে পরিচয় গভীর হয়। একসাথে আড্ডা। সৌরভের সঙ্গ ভালো লাগতে শুরু করে। একবছর পর প্রেম।
এই একবছরে সৌরভের অনেক পরিবর্তন দেখেছে সুনন্দা। সে ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে। কারন জিজ্ঞেস করলে সৌরভ তাকে বলেছে ভালো লাগে না আর ওইসব। পরে সুনন্দা খোঁজ নিয়ে জেনেছে-একই সাথে যারা কলেজে ভর্তি হয়েছে, একই সাথে যারা দল করত, এক সাথে খেত, ঘুরত তারা এখন একে ওপরের শত্রু। একদল আরেক দলকে মারছে অথচ তারা সবাই একই পতাকা ধরে ইউনিয়ন করে। এর পেছনে আছে শহরেরই দুই বড় নেতা। তাদের ইশারাতেই ছাত্রদের মধ্যে এই দলাদলি। আর সব থেকে বড় কারন হল ফান্ডের টাকা ছাত্র ইউনিয়নের কাজে না লাগিয়ে সেগুলো নিয়ে ফুর্তি। সুনন্দা এই নিয়ে সৌরভকে আর কিছু বলে নি। এই নোংরামি থেকে সৌরভ সরে যাওয়ায় সে মনে মনে খুশি হয়েছে। দেখতে দেখতে দুবছর হয়ে গেল এই কলেজে। ক্লাসের পরে তারা এখন নিভৃতেই সময় কাটায় বেশি।
সৌরভ আবার বলে-তাহলে বিয়ে করবি না বললি যে…
-মামনিকে কেউ মেনে নেবে না।
কেন ?
বুঝবি না, ছাড় !
কেন বুঝব না? তুই বল।
মামনি শরীর বিক্রি করে।
সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে। দূরে নদী জীবনের মত বেঁকে বেঁকে গেছে। সুনন্দা বাড়িতে থাকে না । একাই থাকে মেসে। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে সবসময়ই এড়িয়ে গেছে। প্রথমদিন থেকেই সৌরভের মনে হয়েছে একটা চাপা দুঃখ মেয়েটা বুকে নিয়ে ঘুরছে।
তুই যে বলেছিলি তোর মা বাবা নেই!
আছেন। বাবা এক কথার মানুষ। ক্লাস নাইনে পড়তাম, তিনি বলে দিয়েছিলেন তাদের কোন মেয়ে নেই।
কেন?
বয়স কম ছিল। একদমই কিছু বুঝতাম না, পাগল ছিলাম। তখন ওই আমার কাছে সবকিছু ছিল। মনে হত ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। বাবা মা বোঝালেন। শুনি নি। একদিন খুব মারলেন। ব্যস, আমার মাথায় আরও জেদ চেপে বসল। বেরিয়ে পড়ি ওর হাত ধরে।
তাহলে মামনি ?
মামনি আমার শাশুড়ি। বিয়ের একমাস যেতে না যেতেই আসল রুপ বেরোল। বিভিন্ন মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়ানো, জুয়া-মদ কোন কিছুই বাদ ছিল না। একদিন আমাকে এই মারে সেই মারে অবস্থা। মামনি এসে তার ছেলেকে টেনে একটা চড় মারল। তারপর থেকে মামনি আমাকে আগলে আগলে রাখত। কয়েকদিন পর ছেলে কেটে পড়ল। সেই ক্লাস নাইন থেকে উনিই আমাকে মানুষ করছেন। মামনিকে কেউ মেনে নেবে না। আমি উনাকে হারাতে চাই না। আমি শুধু একবার নিজের পায়ে …
সুনন্দা যেন হাহাকার করা কান্না গিলে ফেলল। সে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে, মুখ থমথমে। সদ্য ওঠা গোল চাঁদ ভেসে আছে আকাশে। সৌরভ সুনন্দার থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রাখে। শিশির ভেজা শান্ত চোখ। খুব আসতে করে শুধু বলে – পাগলী। তারপর জড়িয়ে ধরে লিপ টু লিপ চুমু খায় অনেকক্ষণ …
………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment