রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১৫
বিলেতের দিনগুলি
মহাশ্বেতা দাস
"বসন্তের প্রাণভরা চুম্বন পরশে
সর্ব অঙ্গ শিহরিয়া পুলকে আকুল হিয়া
মৃত্যুশয্যা হতে ধরা জাগেনি হরষে।
একদিন দুইদিন ফুরাইলো শেষে,
আবার উঠিতে হল, চলিনু বিদেশে।"
সদ্য যৌবনে পা রাখা ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটিকে নিয়ে "পুনা স্টিমার" যখন রওনা দিল বিলেতের পথে.... যখন একটু একটু করে চোখের সামনে থেকে সরে যেতে থাকল ভারতবর্ষের তটরেখা.... এক অদ্ভুত মন কেমনের আবেশ জড়িয়ে ধরলো রবির মন প্রাণ জুড়ে, ফল স্বরূপ জর্জরিত হলেন সমুদ্র-পীড়ায়। এরই মাঝে জীবনের স্বরূপ কে যেন নূতন করে আবিষ্কার করলেন রবীন্দ্রনাথ।
প্রথমে ব্রিটেনের Public School এ ভর্তি করে দেওয়া হল রবি কে। সুদর্শন যুবকের খুব বেশী সময় লাগলো না শহরবাসীর সাথে পরিচয়, নাচের সভা বা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক মহলে ডাক পেতে। মেজ বৌঠানের আদর যত্ন, ভাইঝি ইন্দিরা ও ভাইপো সুরেন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে বেশ আনন্দেই কাটছিল দিনগুলি কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু তারকনাথ পালিত সে সময় বিলেতে এলেন তাঁর ছেলে লোকেন কে লন্ডন ইউনিভার্সিটি অব কলেজে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে। স্বজন সান্নিধ্যে আরামে রবিকে এভাবে দিন কাটাতে দেখে তিনি বন্ধুকে বললেন.... এভাবে বিলাতের কোন শিক্ষাই অর্জন করতে পারবে না রবি। তাই তাঁরই আগ্রহে রবীন্দ্রনাথ কে ভর্তি করা হল লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে। সেখানেই প্রথম পরিচয় ঘটল তারকনাথের পুত্র লোকেনের সাথে... জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যিনি ছিলেন রবির অকৃত্রিম বন্ধু। শুধু তাই নয় রবীন্দ্র সাহিত্যের এমন সমঝদার ও সুহৃদ বিলাত ফেরত ঐ শ্রেণীর মধ্যে সে যুগে আর তেমন কাউকে পাওয়া যায় নি।
রবীন্দ্রনাথ বহুবার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছেন কিন্তু জীবনের প্রথমবার বিলেত যাত্রা রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছিল বিস্তর। বিলেত যাত্রার আগের রবীন্দ্রনাথ আর বিলেত যাত্রার পরের রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানকার পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট থেকে যা লাভ করেছিলেন নিঃসন্দেহে তা পরবর্তী সাহিত্য-জীবনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছিল।
এখনকার কলেজে অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছিলেন হেনরী মর্লি কে। যাঁর পড়ানোর পদ্ধতি, স্নেহ ও শাসন মুগ্ধতায় আবিষ্ট করেছিল রবিকে। মাত্র মাস তিনেকের মধ্যেই মনে ছাপ ফেলেছিল মর্লির অধ্যাপনার পদ্ধতি....
"এই অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পড়া হয়ে গেছে। সেই পড়া ক্লাসের পড়া নয়। সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনের মিলন।"
লন্ডনে রবি বোর্ডার হলেন এক ইংরেজ গৃহস্থ স্কট-পরিবারের। ইংরেজি কথাবার্তা এবং আদব কায়দায় বেশ খানিকটা সড়গড় হয়ে উঠেছেন তখন রবি। চপল স্বভাব, ঝলমলে আন্না তড়খড়ের সৌজন্যে প্রাথমিক আড়মোড়া ও ভেঙেছে। তাই অল্পদিনের মধ্যেই স্কট পরিবারের বড় আপন হয়েগেলেন তিনি।
"দূরে বহুদূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জ্বয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রা নদী পারে
মোর পূর্ব জনমের প্রথম প্রিয়ারে।"
ডক্টর স্কটের চার মেয়ে। মিস কে, মিস জে, মিস এ, মিস এল। এদের মধ্যে মিস এ এবং মিস এল... দু-বোনেই রবির প্রেমে পড়েগেলেন। যদিও সেদিনের প্রেম কে স্বীকার করার মতো সৎ সাহস ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটির ছিল না। তবু রবির মন বেছে নিয়েছিলেন মিস এল ওরফে লুসি কে।
স্বভাব-কবি রবীন্দ্রনাথ কবিতা লেখেন তাঁর এই লীলাসঙ্গিনীর জন্য, গান ও লেখেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুরে। মিস লুসি পিয়ানো বাজান.... সেই সুরে রবি কণ্ঠে গান আসে অবিরাম ধারায়। এইভাবে প্রতিভার অলীক মায়াজালে বাংলা শব্দ মিলেমিশে যায় বিলিতি সুরের সাথে। সুরের বাঁধনে রচিত হয় দুই ভূখণ্ডের দুটি প্রাণের বন্ধনহীন গ্রন্থি।
"ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদুবায়
তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়।
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে কুহু কুহু কুহু গায়
কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়।"
এভাবেই মিস লুসির মনে প্রাণে সুরের আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যে আগুনের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে দুই মনের আকাশে। আঁধারের সব তারাদের অবাক করে প্রেমের যে পাগল হাওয়া নিশীথের বুকে স্বর্ণকমল ফুটিয়েছিল.... এবার সময় এলো তার ঝরে পড়ার....
"আরম্ভিছে শীতকাল পরিছে নীহার জাল
শীর্ণ বৃক্ষশাখা যত ফুল পত্রহীন।"
ফিরে আসতে হবে রবিকে নিজের দেশে। লুসির ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বরে তখন... " You are really going, aren't you."
প্রায় এক যুগ পরে রবীন্দ্রনাথ আর একবার গেলেন বিলেতে। খোঁজ করলেন সেই বাড়ি, সেই স্কট পরিবারের। কিন্তু তখন কে কোথায়!!!
…………………
বাঙালিয়ানা মানে পয়লা বৈশাখ। ই-কোরাস সাজিয়েছে ঠিক তেমনিভাবেই। সকাল, দুপুর বিকেল, সন্ধ্যায় প্রকাশিত হবে বৈশাখের কিছু কথা।
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment