রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১৪
প্রথম বিলাত যাত্রা
মহাশ্বেতা দাস
"বাহির হতে বহিয়া আনি
সুখের উপাদান
আপনা মাঝে আনন্দের
আপনি সমাধান।"
আন্না আচমকা একদিন রবিকে বললেন.... কোন মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে, তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার।
... যেই বলা সেই কাজ! খানিক বাদেই আরাম কেদারায় আন্না নেতিয়ে পড়লেন কপট ঘুমের ভান করে। কিন্তু...!! এ ছেলে যে অন্য কেউ নয়, রবি।-
"সে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়
যায় না তারে বাঁধা
সে যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে
লাগায় চোখে ধাঁধা ।"
তাইতো আন্না চোখ মেলে দস্তানার দিকে তাকিয়ে দেখেন...একটিও কেউ চুরি করে নি!!! অসাধারন সুন্দরী এক যুবতী চুমো খাওয়ার লোভ দেখিয়ে ও তাঁর দস্তানা চুরি করাতে পারলেন না সতের বছরের যে ছেলে কে দিয়ে....তাঁকে কি কোন বাঁধনে বেঁধে রাখা যায়! স্বাভাবিক ভাবেই একদিন খুলে দিতে হলো মনের বাহুডোর। রবি মেজদাদার সাথে পা বাড়ালেন বিলেতের পথে।
নলিনি! চলিনু আমি ভ্রমিতে পৃথিবী।
আর একবার বালা, কাশ্মীরের বনে বনে
যাই গো শুনিতে আমি পাখির কবিতা।
রুশিয়ার হিমক্ষেত্রে আফ্রিকার মরুভূমে
আর একবার আমি করিগো ভ্রমণ।
এখানে থাক তুমি, ফিরিয়া আসিব পুনঃ
ওই মধুমুখখানি করিব চুম্বন।
এরপর সবরমতী নদী দিয়ে বয়ে গেল বহু জল। রবি তখন বিশ্বসাথে যোগের আকাঙ্খায় মেজদাদার হাত ধরে আরব সাগরে পুনা স্টিমারের যাত্রী।
বহুকাল পরে নলিনির কাছে যখন এলেন.... সে তখন চিরনিদ্রায় মগ্ন।
বোম্বাই থেকে ছয়দিন জাহাজে চড়ে এসে পৌঁছলেন এডেন বন্দরে। রবীন্দ্র জীবনে এটাই ছিলো প্রথম সমুদ্র যাত্রা। স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম কয়েক দিন সমুদ্র পীড়া দেখা দিল। জাহাজের জনৈক "স্টুঅর্ড" পরম যত্নে সুস্থ করে তুলেন রবি কে।
দেশের মাটি ছেড়ে শুধু বিদেশের পথেই পা বাড়ানো নয়.... এ ছিল তাঁর জীবনে প্রথম আরও অনেক কিছুর ই সম্মুখীন হওয়া। তাই ঠাকুরবাড়ির স্কুল পালানো, মুখচোরা ছোট ছেলেটা অনেক ভালো মন্দ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করতে করতে এগিয়ে চললেন আর সেসব অভিজ্ঞতার কথা ধারাবাহিকভাবে "ভারতী" পত্রিকায় "য়ুরোপযাত্রী কোন বঙ্গীয় যুবকের পত্র" নামে প্রকাশিত হতে থাকল। পরে যেগুলি "য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র" নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
"ফেনিয়ে উঠে সাগর হাসে,
হাসে সাগর - বেলা।
ভীষন ঢেউ শিশুর কানে
রচিছে গাথা তরল তানে,
দোলনা ধরি যেমন গানে,
জননী দেয় ঠেলা।
সাগর খেলে শিশুর সাথে,
হাসে সাগর - বেলা।"
এবার পাড়ি দিতে হল লোহিত সাগরের লাল স্রোতে। এডেন থেকে সুয়েজ বন্দরে পৌঁছতে লেগে গেল আরও পাঁচ দিন। এই কদিনেই রবি বুঝে গেছেন.... কল্পনায় আর বাস্তবে বিস্তর ফারাক... "কল্পনায় সমুদ্র কে যা মনে করতেম সমুদ্রে এসে দেখি তার সঙ্গে অনেক বিষয় মেলে না।" কিন্তু "ডাঙা পেরোনো যাত্রীদের " এবার মন চাইলো over land journey করতে। তাই রেলপথে মিশরের মধ্য দিয়ে গিয়ে পৌঁছলেন ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর আলেকজন্দ্রিয়া তে। প্রকান্ড বন্দর আলেকজন্দ্রিয়াতে এসে বঙ্গীয় যুবক আর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করলেন.....
"য়ুরোপীয়, মুসলমান সকল প্রকার জাতিরই জাহাজ এ বন্দরে আছে, কেবল হিন্দুদের জাহাজ নেই।"
"মঙ্গোলিয়া" স্টিমারে করে চার পাঁচ দিন যাত্রা করে ইতালি বন্দর ব্রিন্দিস। খুব অল্প সময় হলেও এই বন্দরে পৌঁছে প্রথম দর্শনে ইতালির শোভা প্রকৃতি প্রেমিক ছেলেটির চোখ এড়িয়ে যায় নি। ইতালি থেকে রেলপথের যাত্রায় নদী, ঝরনা, পর্বত, হ্রদ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শোভা ভুলিয়ে দিল ঘর ছাড়া ছেলেটির পথের কষ্ট। আল্পস পর্বতমালার অন্যতম সুড়ঙ্গ মাউন্ট সেনিস ভেদ করে ফ্রান্সে এবং পরদিন সকালে পৌঁছলেন প্যারিস। প্যারিসের বিখ্যাত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল রবির। এরপর লন্ডন মাত্র মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যে। তারপর মাইল পঞ্চাশ দূরে সাসেক্স জেলার সমুদ্র তীরস্থ শহর ব্রাইটন বা ব্রিটেন যেখানে ইন্দিরা আর সুরেন্দ্রনাথ কে নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন মেজবৌঠান।
…………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment