Saturday, 15 April 2023

আমার পয়লা বৈশাখ : ড. গীতিকা পণ্ডা // ই-কোরাস ১২১

 



আমি,আর আমার পয়লা বৈশাখ

ড. গীতিকা পণ্ডা

  


প্রথম শব্দটির মধ‍্যে একটা ম‍্যাজিক আছে। এক ধরণের ভাললাগাও। রোমাঞ্চ, সফলতার আনন্দ, সৃষ্টির আবেগ সবকিছু মিশে আছে শব্দটির মধ‍্যে। পয়লা বৈশাখ হল বৈশাখের প্রথম দিন, বছরের প্রথম দিন, মাসের প্রথম দিন, একেবারে শুরুর শুরু। তাই তার এত খাতির। বরণ, পালন, উদযাপন। ফুলে, মাল‍ায়, আলপনায়, কথায়,গানে।


              আমার কাছে কিন্তু দিনটির তাৎপর্য একটু অন‍্যরকম। দিন পনের আগে থেকে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি। ঠিক যেমন বিশেষ কোনো অতিথি আসবে খবর পেলে হয়। সে যে আসছে এই ভাবনাটাই আমাকে অদ্ভুত একটা তৃপ্তি দিত। সে আসা মানেই আবার একটা নতুন বছর।  নতুন কিছু ভাববার, নতুন কিছু করবার আবার একটা সদর্থকতার ক্ষেত্র।


          চিরাচরিত রীতিতে যেভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বর্ষবরণ হয়, আমাদের বর্ষবরণ ছিল একেবারে ভিন্ন ধাঁচের। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়তাম সকলে। যেখানে যত আবর্জনা সব জড়ো করে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হত। আর তার সাথে সাথে আঞ্চলিক ভাষায় সুর করে করে একটা ছড়াও বলা হত। দিনের সূচনায় সম্মিলিত সে সুর, সে কথাগুলি ছিল একেবারে অন‍্যরকম। তারপর সূর্য উঠত। আমরা নতুন দিনের, নতুন বছরের সূর্যকে প্রনাম করে বলতাম "আলো দাও, ভালো কর"।কথাগুলির সবটুকু মানে হয়তো তখন বুঝতাম না।কিন্তু উচ্চারণ করে ভারি একটা তৃপ্তি হত।


      পয়লা বৈশাখের সাথে আর একটা ভাবনা খুব মিশে থাকত। সে হল কালবৈশাখী। পৃথিবী নাড়িয়ে দেওয়া এক প্রচণ্ডতম বেগের আবেগ। যা কিছু আবর্জনা, যা কিছু জঞ্জাল সবকিছুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেবার এক বন‍্যতা। জীর্ণতাকে মোহমুক্ত ভঙ্গিতে, এমন করে একনিমেষে আর কে-ই বা পারে ছুঁড়ে ফেলতে? কালবৈশাখীর সেই প্রলয়ের মধ‍্যে যেন প্রলয়ের দেবতার নাচ দেখতে পেতাম। ভাবতাম সকালে আমরা জঞ্জাল পুড়িয়ে নতুন দিনকে স্বাগত জানিয়েছি, আর বিকেলে তাকে উড়িয়ে দিয়ে স্বাগত জানাল প্রকৃতি। মানুষ আর প্রকৃতি যেন এ কাজে হাত ধরাধরি করেছে।


           প্রতিবছরই পয়লা বৈশাখের বিকেলে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হত। সব নাড়িয়ে উড়িয়ে শেষে সব ধুয়ে মুছে একেবারে ঝকঝকে তকতকে। তখন গাছের তলায় বসত আসর। কেউ নাচত, কেউ গাইত, কেউ আবৃত্তি করত। শেষে একটা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হত। তারপর লাড্ডু বিলি হত। কিন্তু সব কিছুই হত আলো-আঁধারির এক রহস‍্যময়তায়।কেননা গ্রামে ঝড় বৃষ্টি হলেই কারেণ্ট চলে যেত।তখন হ‍্যারিকেন-ই ভরসা। অনেক ক'টা হ‍্যারিকেনের আলোয় বেশ একটা গা ছমছমে মজা। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টা ছিল খুব-ই উপভোগ‍্য। বড়দের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়া, আর সমবয়সীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে অনুষ্ঠান শেষ হত। এরপর গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরা। তার মধ‍্যেই বুঝতে পারতাম ভেতরে কুলকুল এক খুশি, যেন নাচছে। মনে মনে বলতাম আহা! বেশ কাটল দিনটা।


           সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। শুধু আমার ঘুম আসত না। রাত গভীর হলে ঠাকুমার খাট থেকে নেমে এসে বসতাম দক্ষিনের বারান্দায়। মনটা হঠাৎই কেমন বিষণ্ণ হয়ে যেত। মনে হত কিছু যেন ছেড়ে গেল, হারিয়ে গেল জীবন থেকে। কিন্তু কি ঠিক বুঝতে পারতাম না। দূরের দিকে তাকাতে গিয়ে দৃষ্টি আটকে যেত সপেদা আর জামরুল গাছের মাথায়, সেখানে আটকে গেছে ঘোলাটে চাঁদ। তার চারদিকে বিষণ্ণ এক ধোঁয়াটে বলয়। আমার সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠত কি ভেবে। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হত ধোঁয়াশা কেটে গিয়ে ফুটফুট জ‍্যোৎস্না জেগেছে। সেই আলোয় অপূর্ব এক আলো -আঁধারি খেলায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আমি চোখ মুছে উঠে দাঁড়াতাম। ওদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস বলতাম, কাল আবার সূর্য উঠবে। আবার একটা নতুন ভোর হবে…

                ……………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অর্থিতা মণ্ডল

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


1 comment:

  1. শুভ ১লা বৈশাখ। শুভকামনার শুভারম্ভ সূচিত হোক শুভ লগনে। প্রণাম। শুভ নববর্ষ।

    ReplyDelete

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...