আমার পয়লা বৈশাখ
শ্রাবণী বিশ্বাস
ছোটবেলায়, 'পয়লা বৈশাখ'এ ভালো জামাটামা কিছু পেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। মা কখনো চৈত্র সেল থেকে নয়তো, 'রাধাকৃষ্ণ বস্ত্রালয়' থেকে পাতলা সুতি-কাপড়ের, 'টেপফ্রক' কিনে দিত। আর পেতাম ইলাস্টিক দেওয়া একরঙা একজোড়া ঢোলা হাফপ্যান্ট। সাদা টেপফ্রকে কাঁথাস্টিচ করা হাঁস, হরিণ বা ঘাসফুলের সামান্য কারুকাজ থাকত। এ'দিন স্নানের পরে ওই নতুন টেপজামাটাই পরাতো মা। মুখে-গলায় ট্যালকম পাউডারের পাফ হালকা করে বুলিয়ে দিত। পন্ডস পাউডার! দেশলাই কাঠি দিয়ে কপালে কাজলের ছোট্ট একটা বিন্দু আঁকতো। ব্যাস এটুকুই নববর্ষের সাজগোজ!
বোশেখের পয়লা দিনে, 'পান্তা ইলিশ' খাওয়ার স্মৃতি নেই। মধ্যবিত্তের মেনুতে আলাদা করে তেমন ভালোমন্দ থাকতো না। তবে পয়লা বৈশাখের বড় আকর্ষণ ছিলো হালখাতার। ব্যবসায়ীমহল ক্রেতাদের হালখাতার নেমন্তন্ন করতো। আমাদের ছোট্ট শহরের অধিকাংশ দোকানেই এদিন, 'গনেশ' পূজো হত। লাল শালুতে মোড়া নতুন খাতার, 'শুভ মহরত' উপলক্ষে এই আয়োজন! সাদা শোলার কদম ও সবুজ আমপাতা দিয়ে সাজাতেন দোকান বা গদি। প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা কলার গাছে ঝুলতো ফুলের মালা। মঙ্গলঘটে জবজবে সিঁদুর, কচি আম্রপল্লব। খুব সামান্য আয়োজন! তবু তা নিয়ে উৎসাহ, আগ্রহের অন্ত ছিল না।
কয়েকরকমের মিষ্টি ও নোনতা দিয়ে তৈরি হত হালখাতার প্যাকেট। সেসব এমনকিছু আহামরি বা নামীদামী মণ্ডামিঠাই নয়। প্যাকেটে সাধারণত কিটকিটে মিষ্টি গোপালভোগ, কমলা রঙের অমৃতি, লম্বা জিভেগজা, কুচো নিমকি, রসকদম, লবঙ্গলতিকা, শুকনো কালোজাম, মোতিচুরের লাড্ডু আর কিছুটা বোঁদে থাকতো। কখনো শুধু্ কাগজের ঠোঙাতে করেও অতিথিদের ফল, মিষ্টি তুলে দিত। মিঠেদ্রব্যে বরাবরই আমার লোভ বেশি। এরমধ্যে বোঁদের প্রতি আগ্রহ ছিলো সর্বাধিক। তখন বিশেষ কোন অনুষ্ঠানেই শুধু বোঁদে তৈরি হতো। দোকানে হররোজ এর বিক্রিবাট্টা ছিলো না। তাই হালখাতায় কাগজের বাকসে পাওয়া এই সুস্বাদের মিষ্টিটুকু আয়েস করে খেতাম।
কোন কোন ব্যবসায়ীরা প্যাকেটের সঙ্গে একটা ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার দিতো। ক'টা ক্যালেন্ডার পাওয়া যেতে পারে এবং সেসবে কেমন ছবি থাকবে, তা নিয়ে ভাইবোনেদের জল্পনাকল্পনা চলতো। দিনকয়েক আগে থেকেই এ'দিনের অপেক্ষা করতাম।
আমার তখন ক্লাস ফোর। দুপুরের রোদ একটু নরম হতেই দাদু বেরুচ্ছিলো হালখাতা করতে। অনেকগুলো দোকানে আমন্ত্রণ ছিলো। হঠাৎ,'তোমার সঙ্গে যাবো' বলে চিল্লিয়ে বায়না জুড়লাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শৈশবে বেজায় বায়নাবাজ ছিঁচ-কাঁদুনে ছিলাম। নাছোড়বান্দা নাতনিকে নিরস্ত করার বিস্তর চেষ্টা চালিয়ে সে ব্যর্থ হলো। তখন দিদা তেল দেওয়া চুল আঁচড়ে পাটপাট করলো। সেইসঙ্গে জুলিহাতা জামা ও বেল্ট দেওয়া বাটার জুতো পরিয়ে দিলো (কেন জানিনা, ছোটবেলায় সবসময় কালো রঙের বেল্ট দেওয়া জুতো পরতে হত। ঘোরতর অপছন্দ সত্বেও বাবা, প্রত্যেকবছর ওই একই ডিজাইনের জুতো কিনে দিত)। দাদুর সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে হাসিমুখে হালখাতার নেমন্তন্নে চললাম। রাত অব্দি অনেকগুলো দোকান ঘুরলাম। প্রত্যেক দোকানে পাওয়া একটা প্যাকেট ও ক্যালেন্ডার খুব উৎসাহ ভরে দাদুর হাত থেকে নিয়ে, সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝোলানো বড় ব্যাগে রেখেছিলাম।
সব দোকানের শেষে, 'নাগদের মস্ত মুদিখানায়' এসে পৌঁছালাম। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে... রাস্তার লাইট জ্বলে উঠেছে... নাগেদের বুড়োকর্তা গদিতে বসে চশমা এঁটে হিসেবের খাতা দেখছিলেন। সামনের চাতালে দাঁড়িয়ে দু'তিনজন কর্মচারী কয়েকরকমের মিষ্টি ও নিমকি ঝুড়ি থেকে তুলে প্যাকেটে পুরছিল। বড় একটা ডেকচিভর্তি রসে টইটুম্বুর বোঁদে। তা দেখে নিমেষে মনচঞ্চল! একজন ডেকচি থেকে একহাতা করে বোঁদে নিয়ে প্যাকেটে চালান করছিলো। নাগবাবু'চোখ তুলে দাদুকে দেখে বললেন, 'তা সরকার মশাই, সঙ্গে নাতিন নাকি! হেসে ঘাড় নাড়লো দাদু। নাগবাবু একজন কর্মচারীকে উচ্চকন্ঠে বললেন, 'এর জন্যে একটা আলাদা প্যাকেট...কিন্তু আলাদা প্যাকেট ট্যাকেট নয়, চাতালের ব্যস্তসমস্ত একজন তাড়াহুড়োয় শুধু তিন চার হাতা বোঁদে একটা আলাদা ঠোঙায় তুলে হাতে দিয়েছিলো। আর তাতেই দিল খুশিতে ডগমগ! স্পষ্ট মনে আছে বাকি রাস্তাটুকু ক্যারিয়ারে বসে, একহাতে সিটের নিচের রিঙ ধরেছিলাম। অন্যহাতে ছিল বোঁদেভর্তি কাগজের ঠোঙা যা কিছুতেই কাছছাড়া করি নি।
…………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - দেবশ্রী দে
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment