নতুন বছর নতুন দিন
সুমন বিশ্বাস
বসন্ত বিদায় নিলো, কালের নিয়মে তার বিদায় নেওয়ারই কথা। কচি পাতাদের একটু বয়স হলো, ফুলের রাশি পাপড়ি খসিয়ে ফল হয়ে শোভা পাচ্ছে গাছে গাছে। আম্র কুঞ্জে আর মৌমাছিদের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে না। আম পাকার অপেক্ষায় রয়েছে পাখিপক্ষের দল। বসন্তের বিদায় লগ্নে নববর্ষের আগমনী বার্তা নিয়ে কালবৈশাখী ঝড় মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিচ্ছে নববর্ষ আসছে। আসবো আসবো করে চলেই এলো পহেলা বৈশাখ।
গ্রামের বাড়িতে ছোটবেলায় এই বিশেষ দিনটিতে গোয়াল ঘরে ভগবতীর পুজো হতো। ঘটে আমের পল্লব দিয়ে তাতে সিঁদুর লেপে দেওয়া হতো। মাটির সরাতে দুধ উথলানো হতো, আরও নানা রকম ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম পালন করা হতো বাড়িতে। নববর্ষের আগে এক সপ্তাহ ধরে চলতো গাজন পরব। বাড়ির পাশেই গাজনতলা ছিল, সেখানে সকাল বিকাল ঢুঁ মারতাম। গাজনের সন্ন্যাসীদের সাথে বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম আর সন্ন্যাসীদের গান আর ঢাকের তালে তাঁদের নাচ আজও স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। চড়কের পরের দিনই পহেলা বৈশাখ, সেদিন গাজন সন্ন্যাসীরা তাঁদের পাতানো গুরু বাবার বাড়িতে অন্ন গ্রহণ করার জন্যে আসতো। আমাদেরও একজন গুরু দাদা আছে, সে এখনও আসে গুরু বাবার পায়ে জল দেওয়ার জন্য। এই রীতি আজও আমাদের গ্রামে চালু আছে। পহেলা বৈশাখে আমাদের গ্রামে সকলের বাড়িতে পাঁঠার মাংস খাওয়ার চল আছে। ঐদিন পাড়ায় পাড়ায় খাসি কাটার রেওয়াজ আজও আছে। অন্য দিন সবাই বাজার থেকে মাংস কিনলেও এই বিশেষ দিনগুলোতে সবাই পাড়ার থেকেই মাংস কেনে। আমাদের অনেক উৎসবেই পেটপুজোর রীতি আছে। পেটুক হওয়ার সুবাদে এই সব উৎসবগুলো আমার খুব ভাল লাগে। ভাল লাগার উৎসবগুলির মধ্যে পয়লা নাম্বারে রয়েছে পহেলা বৈশাখ।
পহেলা বৈশাখ আরও একটা কারণে আমার খুব প্রিয় সেটা হল হালখাতা। বাংলায় এই হালখাতার প্রচলন মুর্শিদকুলি খাঁর হাত ধরে, ইতিহাস পড়ে এটা জানার পর এই ভদ্রলোকের প্রতি আমার সম্মান বেড়ে গিয়েছিল। আসলে নবাবী আমলে এই দিন প্রজারা বকেয়া খাজনা দিতে রাজদরবারে আসতো, সবার জন্য ভরপেট খাওয়া দাওয়া থাকতো আর নতুন খাতা চালু হতো খাজনার। তবে যারা হালখাতার চিঠি পেয়ে (পড়ুন বকেয়া খাজনার নোটিশ) যে রাজদরবারে হাজির না হতো তাদের সাথে কী হতো সে আমি জানিনা। হালখাতার চিঠি পাওনাদাররা বাড়িতে দিতে এলে মাঝে মাঝে তাদের মুর্শিদকুলি খাঁ মনে হতো। তবে আমাদের চারপাশের এই সব ব্যবসায়ীরা আর যাই হোক এরকম নয়। প্রাইভেট ব্যাঙ্ক বা মাইক্রো ফিনান্স সংস্থার সাথে যদিও জমিদারী আর নবাবী বন্দোবস্তের কিছুটা মিল আছে। যাকগে সেসব কথা, পহেলা বৈশাখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ আজ। পহেলা বৈশাখে পাওয়া হালখাতার ক্যালেন্ডারের কথা কেউ কী ভুলতে পারবে? পহেলা বৈশাখের পর পুরানো ক্যালেন্ডারগুলো বইয়ের মলাট হয়ে যেতো আর নতুন ক্যালেন্ডারের ছবিগুলো কতবার যে ঘুরে ঘুরে দেখতাম সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের ছোটবেলাটা ক্যালেন্ডারের পাতার মতই রঙিন ছিল। একবার পহেলা বৈশাখে আমাদের পাড়ার সুনীল মাষ্টার ক্যালেন্ডারের আবিষ্কারের গল্প শুনিয়েছিলেন। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় নীল নদে একটি বন্যা আসার সময় একজন ঘরের দেওয়ালে দাগ কাটা শুরু করেন। পরের বন্যা আসা অবধি ৩৬৫ টি দাগ তিনি কাটতে পেরেছিলেন। এইভাবে আরও কয়েক বছর উনি দাগ কেটে নিশ্চিত হন যে ৩৬৫ দিনে এক বছর হয়।
পহেলা বৈশাখ আরও একটা কারণে আমার প্রিয় সেটা হচ্ছে চৈত্র সেল। প্রতি বছর এই সেলের জামা কাপড় দিয়েই আমাদের গোটা পরিবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতো। বাবার লুঙি, মায়ের কাপড়,আমাদের জামা এমনকি বিছানার চাদর, গামছা সবই কেনা হতো সেলের বাজার থেকে। ছোটবেলার পহেলা বৈশাখে এই সেলে কেনা নতুন জামার গন্ধও লেগে ছিল।
আজও এইভাবে বসন্ত বিদায়ের পর নতুন বছর আসে। গ্রাম, শহর, পাড়া, মহল্লাতে এইভাবেই কচিকাঁচারা আনন্দে মেতে ওঠে। উন্নয়নের গতির সাথে হয়ত পহেলা বৈশাখের আনন্দ কিছুটা ম্লান হয়েছে তবুও বাঙালী জাতি যত দিন থাকবে ততদিন এই দিনটি স্বমহিমায় পালিত হবে বিশ্বজুড়ে।
………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - লিপি সেনগুপ্ত
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment