Saturday, 1 April 2023

রোহন নাম্বিয়ার এর গল্প // ই-কোরাস ১০৩

 



একটি গল্প হওয়ার আকাঙ্ক্ষা 

রোহন নাম্বিয়ার    


সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই কেমন যেন লাগছিল। ভালো লাগছিল না কোনকিছুই। বারবার মনে পড়ছিল সরকারী কর্মচারীদের খিটখিটে মুখ। আজ আধার কার্ডের বায়োমেট্রিক চেঞ্জ করতে যেতে হবে। মনে বিষণ্ণতার মেঘ। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই, যেতে হবেই। কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার চা দোকানে এক কাপ চায়ের পর দুটো সিগারেট শেষ করে আরো একটা সিগারেট এখন ঠোঁটে। ধুর! একদম যেতে ইচ্ছে করছে না। এই না যাওয়ার ইচ্ছের জন্যই চা দোকানে প্রায় একঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তাই বেশি না ভেবে গাড়ি স্টার্ট দিলাম ।  

      ব্যাঙ্কের সিঁড়িতে উঠতে উঠেতেও মনটা একেবারে তেতো হয়ে আছে। ওপরে উঠেই সিঁড়ির এক কোনায় আধার কার্ড সংক্রান্ত কাউন্টার। কাউন্টারে একটি মেয়ে বসে আছে। এ কি ! সেই অভদ্রলোক কোথায়? যাক ভালোই হয়েছে। যেখানেই বিদায় হোক ভালোই হয়েছে। কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ম্যাম না দিদি কি বলে ডাকব ভাবছি ঠিক তখনই ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে দুটো সুন্দর ঘন আঁখিপল্লব ঢাকা বাদামী জিজ্ঞাসু চোখ আমার মুখে স্থির। আমিও তাকিয়ে আছি চোখ দুটোর দিকে। জিজ্ঞাসু চোখের উত্তর দিতে ভুলে গেছি ঠিক তখনই মেয়েটির চোখ দুটো হেসে উঠল। নিজের সম্বিৎ ফিরিয়ে বললাম – বায়োমেট্রিক চেঞ্জ করার জন্য কি ফর্ম ফিলাপ করতে হবে ? 

ঠোঁটে হাসি রেখেই মেয়েটি উত্তর দিল-হ্যাঁ সব কিছুর জন্যই ফর্ম লাগবে।

-আচ্ছা। একটা ফর্ম দিন।

পাশের জেরক্স দোকানে পেয়ে যাবেন বলাতে যেই আমি পেছন ফিরেছি ঠিক তখনই মেয়েটি আবার বলল – আচ্ছা দাঁড়ান আমি প্রিন্ট দিয়ে দিচ্ছি। 

আমি ফর্ম নিয়ে একটু দূরে ফিলাপ করছি। না চাইতেও চোখ চলে যাচ্ছে কাউন্টারের দিকে। মেয়েটি তাকিয়ে আছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। লোকজন বারবার এসে তাকে জিজ্ঞেস করছে কীভাবে ফর্ম ফিলাপ করতে হবে, কত দেরী লাগবে এই রকম নানা প্রশ্ন। অথচ তার ঠোঁটে হাসি বজায় আছে, বিরক্ত হচ্ছে না একটুও, মাঝে মাঝে শুধু মাথাটা একটু এদিক-ওদিক, একটু ওপর নীচ করছে। ঘাড় কি ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে?  হওয়াই স্বাভাবিক। আমার ফর্ম ফিলাপ তখনো হয় নি। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি । সে ঘাড় ঘোরাতেই আমার চোখে চোখ, আমি সত্যিই একটু ঘাবড়ে যেতাম সে যদি ওইরকম মুগ্ধভাবে না হাসত। এসি টা কি হটাৎ একটু বেশি জোরে চলছে? নিজের মনেই হেসে ফর্মে চোখ রাখলাম । 

           ফর্ম ফিলাপ হয়ে যেতে কাউন্টারের পাশে এসে বসেছি। মেয়েটির চোখ স্ক্রিনে। কালো রঙের শালোয়ার আর নীল জিন্স পরে আছে। ঢেউয়ের মত চুল পিঠে। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক একটানা বকবক করে যাচ্ছে, আমার পিছনের ভদ্রমহিলা অস্থির হচ্ছেন, উনার ভীষণ তাড়া। খাওয়ারের দোকান, ব্যাঙ্ক, কোন সরকারী অফিসে গেলে সবারই কেন যে এত তাড়া থাকে বুঝি না । আমার খুব বিরক্ত লাগছিল। এদের কারনে যদি মেয়েটি বিরক্ত হয়! যদি তার মুখে লেগে থাকা স্বপ্নের মত হাসিটা উড়ে যায়! আমি ভদ্রমহিলাকে বললাম আমার জায়গায় আপনি করে নেবেন। উনি গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকালেন। খুশি হলেন নাকি অবাক বুঝতে পারি নি । তবে অস্থির ভাবটা আর নেই। মনে মনে ভাবছি এই মেয়েটির জায়গায় যদি সেই অভদ্রলোকটা থাকত তাহলে কি লাইন ছাড়তাম এই মহিলাকে?  না ছাড়তাম না। আগের সেই অভদ্রলোকের মত কর্মচারীদের জন্যই সরকারী কাজে যেতে ভয় লাগে। অমানুষের মত ব্যবহার করে। কিন্তু এই মেয়েটি ব্যতিক্রমী। প্রায় আধঘণ্টা বসে আছি। অজান্তেই বারবার চোখ চলে যাচ্ছে মেয়েটির দিকে। কাউন্টারের সামনে ভিড় বাড়ছে, বাড়ছে প্রশ্নের সংখ্যা তবু সে বিরক্ত হচ্ছে না। ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড এসে কিছু একটা বলল কাউন্টারে। মেয়েটি উঠে দাঁড়াল – আপনারা একটু বাইরে অপেক্ষা করুন। আমি আপনাদের এক এক করে ডেকে নেব। অনেক ভিড় হয়ে যাচ্ছে। 

অনেকে চলে গেল বাইরে, যারা যায়নি তাদের উদ্দেশ্যে শান্তভাবে আবার বলল–দয়া করে আপনারা একটু বাইরে অপেক্ষা করুন। 

   আমার যে কি হল আমি তবুও বাইরে গেলাম না। ক্যাবলার মত তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। সে শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বসল কম্পিউটারে। আমি দেখছি তার সুন্দর লম্বা লম্বা আঙ্গুলগুলো খেলছে কিবোর্ডের ওপর । কিবোর্ডটা যদি পিয়ানো হত ! মেয়েটি পিয়ানোতে হাত রাখলে নিশ্চয় মায়াবী সুরে ছেয়ে যাবে চারিদিক! জ্যোৎস্নায় স্নান করবে শহর। এইরকম সন্ধেবেলা আমি কোথায় থাকব? হয়ত শহরের কোন নিরিবিলি রাস্তায় জ্যোৎস্না মেখে হাঁটছি। মনে হচ্ছে সত্যিই যেন হাঁটছি। আচমকা শান্ত একটা গলা শুনলাম -আপনি আসুন ফর্মটা নিয়ে। 

আমি গেলাম না। বললাম-ওই ভদ্রমহিলারটা করে দিন।

  মেয়েটি অবাক চোখে তাকাল। অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। এভাবে কেউ লাইন ছাড়ে না। পাগল ভাবে নি তো? সে ডাকল ভদ্রমহিলাকে। ভদ্রমহিলাও কাউন্টারের সামনে যাওয়ার সময় একবার তাকালেন আমার দিকে। মহিলার হয়ে যাওয়ার পর মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি রেখে বলল–আধার কার্ড নিয়ে এদিকে আসুন।

   আমি গেলাম কিন্তু মুখ দিয়ে কে যেন বলিয়ে নিল আধার কার্ড তো নেই। অথচ আধার কার্ড আমার পার্সেই ছিল। 

-এবাবা । তাহলে কীভাবে হবে! কার্ড লাগবে যে। আপনি নিয়ে আসুন…

    বাইরে গেলাম। দশ মিনিট পর এসে ভেতরে ঢুকতে যাবো সবাই প্রায় চিৎকার করে বলল লাইন দিন। চিৎকার শুনে মেয়েটি দরজার কাছে এসে বলল – উনাকে আসতে দিন। অনেকক্ষণ আগে এসেছেন উনি। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কাউন্টারের দিকে এগোতে এগোতেই বলল- সামনেই বাড়ি? এত তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে এলেন !

-না না। ফোন করলাম। একটা বন্ধু আনছে। 

  মেয়েটি আমার চোখে চোখ রেখে হাসল। আমি সামনে গিয়ে বসলাম আর সে স্ক্রিনে চোখ রাখল। এক এক করে সে ডেকে নিচ্ছে লোকেদের । আমি বসে আছি। তাকিয়ে আছি ঘন অরন্যের মত চোখে। পথ হারাচ্ছি, আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে খরগোশ, হালকা হাওয়া যেন আমার শরীর ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হটাৎ অরন্য আমার দিকে তাকাল – বন্ধু কি আপনাকে ভুলে গেছে ! 

-না, কাজে আছে তো তাই একটু দেরী হচ্ছে। 

     কখন তিনঘণ্টা হয়ে গেছে বুঝতে পারি নি। মেয়েটি অনবরত কাজ করে যাচ্ছে, মুখে সেই হাসি, বিরক্তিহীন মুখ। সে উঠে দাঁড়াল। দেখল আর চারজন আছে। তারপর বলল–আপনারা একটু দাঁড়ান আমি খেয়ে আসছি। কাউন্টারের ভেতরে গিয়ে ব্যাগ থেকে টিফিন বের করে খেতে বসল। বাইরে আবার চ্যাঁচামেচি। এদের একটুও ধৈর্য নেই।  ম্যাডাম হল ? ম্যাডাম আর কতক্ষণ ? - বলে বাইরে থেকে চিৎকার করছে। মেয়েটি আর খেল না। ব্যাগে টিফিনটা রেখে হাত ধুয়ে এসে বসল। ডেকে নিল পরেরজনকে। মুখেও কি জল দিয়ে এসেছে? বৃষ্টির পর গাছের মত ফ্রেশ লাগছে। সকালের নদী পাড়ে সুন্দর সতেজ সবুজ গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে আর চুলে কম্পিটিশন করে আদর মাখাচ্ছে মিষ্টি রোদ ও ফুরফুরে হাওয়া। আমি অনেক দূরে কোথাও থেকে শুধু দেখে যাচ্ছি। সে একবার তাকাল আমার দিকে, আমিও তাকিয়ে আছি। তার ঠোঁটে মন ভালো করা হাসিটা লেগে আছে । কীভাবে এমন শান্ত আছে? যে মানুষগুলো শান্তিতে একটু খেতেও দিল না তাদের সাথে কীভাবে এমন সুন্দর ব্যবহার করছে! এই মানুষগুলোর ওপর আমার খুব রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল গিয়ে টেনে একটা চড় মারি। কিন্তু কেন জানি না রাগটা কমে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাচ্ছে মন। ঠিক করলাম আর বসব না,দেখব না এই মানুষগুলোর মুখ। উঠে বাইরে গেলাম। আবার ভেতরে এসে সোজা কাউন্টারে এসেছি। মেয়েটি হাত বাড়াল - দিন আপনার কার্ড।

    কার্ডটা নিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকাল , মুখে হাসি ঝুলছে। আপনার তো খুব ধৈর্য! এতক্ষণ বসে রইলেন চুপকরে। দেখুন না সবার কেমন তাড়া বলেই ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। গলায় একটা অভিমান টের পেলাম । এত মন দিয়ে কাজ করছে। ভালো ব্যবহার করছে। তাও মানুষ যে কেন এমন করে! 

আমিও তো অবাক। আপনি মাথা ঠাণ্ডা রাখছেন কীভাবে ? 

   উল্টো দিক থেকে পাহাড়ি ঝরনার মত হাসি শেষ হবার আগেই হটাৎ কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম – কি হল ?

-মেশিন হ্যাং করছে। আপনাকে আবার অপেক্ষা করতে হবে।

-আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আপনি আরামে করুন।

     আমার কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। শুধু আঙ্গুল আর চোখের ছবি নেওয়া বাকি। সে দু হাত দিয়ে নিজের চোখ ঘোষতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম – কিছু হয়েছে?

-না না সেরকম কিছু না। চোখটা একটু ব্যথা আরকি।

-আপনি blue block arc glass এর চশমা ব্যবহার করে দেখতে পারেন ।

বলছেন? তাহলে তাই করব-বলতে বলতে স্ক্যানারে রাখা আমার আঙ্গুলের ওপর আলতো চাপ দিল। আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁতেই স্কুলবেলার বিকেল, প্রথম প্রেম , প্রথম হাত ধরার মত অনুভূতি হল। বাইরে থেকে চিৎকার এলো – ম্যাডাম পরে গল্প করবেন । উনার তো দেখছি হচ্ছেই না। আমি কটমট করে বাইরে তাকিয়েছি। আর একটু…হয়ে এসেছে – বলেই সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। এ কি আমার রাগ কমে যাচ্ছে  কেন ? 

           ব্যাঙ্কের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দরজার সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে বাঁকা চোখে দেখলাম। কি আশ্চর্য আমার রাগ হচ্ছে না। এই সিঁড়ি দিয়েই আসার সময় মনটা তেতো ছিল। এখন তো নেই-ই বরং একটা ফুরফুরে ভাব আছে। চোখের সামনে ভাসছে একটা হাসি হাসি মুখ। এই মুখটিই পোট্রেটের মত যত্ন করে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।         

                       ……………….........                 


                                      

সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614

2 comments:

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...