পয়লা বৈশাখের ইংরেজি তারিখ হয় না
বর্ণালী কোলে
“এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো...”
বৈশাখকে আহ্বান করা এই সংগীত বাজত স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হয়তো এখনও বাজে। মুছে যায় গ্লানি। মুছে যায় জরা।
তপ্ত দিন। দ্বিপ্রহর। চাঁপা ফুলের সৌরভ। কৃষ্ণচূড়া। জারুল। মাধবীলতায় ভরে উঠেছে দরজা। কাঁচা আমের গন্ধ। নতুন পাতায় সতেজ রোদ্দুর।
ওরাও পয়লা বৈশাখ।
লাল রঙের পঞ্জিকা। বেণীমাধব শীল। বড় বড় করে লেখা বাংলা সন। পয়লা বৈশাখ এলেই আলো করে থাকত বইয়ের দোকান। ট্রেনেও ফেরি হত এই বই। শিশুদের বই, ভূতের গল্পের মাঝে উঁকি দিত। খবরের কাগজ বিক্রি করেন যিনি, তার সাইকেলের সামনে প্লাকার্ড বাঁধা,
“এখানে পঞ্জিকা পাওয়া যায়।” গৃহস্থের ঘরে অনেকেই রাখতেন। অনেকেই শৈশবে উল্টেপাল্টে দেখতেন এই গ্রন্থ। দেখতেন সময়। সূর্যোদয়। সূর্যাস্ত। আরো কত স্মৃতি । কত মানব -মানবীর আনাগোনা।
বাড়িতে বাড়িতে তখনও কেবল্ লাইনের চল হয় নি। আ্যন্টেনা টিভি। ভোর হলেই ডি ডি বাংলার সামনে বসে পড়ত গ্রাম বাংলা । পয়লা বৈশাখের বৈঠকী আড্ডা। ওই তো বসে আছেন জয় গোস্বামী। নবনীতা দেবসেন। ওখানেই আরও অনেক শিল্পীকে দেখা। বিস্ময়।
ঘরদোর পরিস্কার। জলে ধোয়া উঠোন। নতুন জামা। বাঙালি পয়লা বৈশাখের এই অভ্যাস আজও বজায় রেখেছে। ইংরেজি নিউ ইয়ার অনেক জাঁকজমকের সঙ্গে পালন হলেও এই ঐতিহ্য সেখানে নেই। এই আবেগ। ইংরেজি নববর্ষে উচ্ছ্বাস আছে, বাংলা নববর্ষে প্রাণ। পয়লা বৈশাখের নতুন পোশাক কেনা ও উপহার দেওয়ার চল আছে। ইংরেজি নিউ ইয়ার বাঙালির আপন উৎসব নয়।মপয়লা বৈশাখ বাঙালির হৃদয়ের সুর। বিশাখা নক্ষত্রের মতো নিজ শৌর্যে পূর্ণ।
বাঙালিরা যতই ইংরেজি তারিখে স্বচ্ছন্দ বোধ করুক না কেন, পয়লা বৈশাখের দিন অন্তত ইংরেজি তারিখ পরাজিত। এই দিন ইংরেজি তারিখ বাঙালি বিস্মৃতমহয়। সেদিন সবাই নিখাদ বাঙালি।
গৃহে গৃহে নানারকমের বাঙালি ব্যঞ্জন রান্না। মোচার ঘণ্ট।মশুক্তো। স্মৃতিমেদুর আল্পনায় সেজে ওঠে বারান্দা। রঙিন পাঞ্জাবি, নতুন শাড়ি।
তরুণ মজুমদার,“দাদার কীর্তি।”
দোকানে গনেশপুজো। দু’ধারে কলাগাছের পবিত্রতা। আম্রপল্লব। মঙ্গলবার্তা।মঘট। শঙ্খধ্বনি। মা, কাকিমা। লক্ষ্মীর আরাধনা। নতুনখাতার চিঠি। সেইসবন হারানো দিনে বাবা, জ্যেঠুরা বিকেল বিকেল সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। সন্ধেয়মযখন ফিরতেন,সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে উপচে পড়ত হালখাতা। বাড়িতে ব্যাগ রাখা মাত্রই মা, বড়মারা বড় ডেকচিতে খাবার ঢেলে রাখতেন। ছোটরা বিস্ময়ের সঙ্গে এক একটি ক্যালেণ্ডার খুলে ছবি দেখত। দেবদেবীদের সৌন্দর্যের দিকে অবাক তাকিয়ে থাকা। কী সুন্দর মুখ! সব দেবীর কোঁকড়ানো চুল! বাচ্চা গোপাল মাখন চুরি করছে। কত যে সুন্দর! কোলে নিতে ইচ্ছে মতখনও হত কত কিশোরীর । হয়তো এখনও হয়। লক্ষ্মী-নারায়নের শান্তমছবি। বড়দের মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম। পয়লা বৈশাখের মিষ্টি। মিহিদানা,লাড্ডু ।একান্নবর্তী পরিবার।কত শত শুভ প্রতিজ্ঞা। শুভ কাজ। স্বস্তিক চিহ্ন।
আবার একটি পয়লা বৈশাখ আগত। এখন পয়লা বৈশাখ হোয়াটসঅ্যাপ মনে রাখে। প্রীতিহীন ভার্চুয়াল শুভেচ্ছায় ভরে ওঠে সকাল। ফেসবুকে পয়লা বৈশাখ দেখা যায়। মানুষের সুখ। কোথাও হয়তো মেলা হয়। শিশুরা এখনও নতুন পোশাক পরে। অনেকের কপালে হোমের চিহ্ন। দোকানে দোকানে পুজো । কলাগাছ, আম্রপল্লব। পবিত্রতা। হালখাতার চিঠি আসে কম। ক্যালেণ্ডার এখন আধুনিকতার পরিপন্থী।
পয়লা বৈশাখের দিন ভরে উঠুক মন্ত্রোচ্চারণে । প্রতিটি শিশু যেন বাংলা ভাষা বলতে ও লিখতে পারে। অভিভাবকরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোক। শিশুরা আবোলতাবোল পড়ুক। বাংলার চিরায়ত শিশু ও কিশোর সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটুক সব শিশুর, সব কিশোর কিশোরীদের পয়লা বৈশাখে। মঙ্গল ঘটক ভরে যাক। ইংরেজির সঙ্গে বাংলা তারিখ খবর কাগজ রোজ মনে করিয়ে দেয়। মনে রাখার অভ্যাস শুরু হোক।রসিদে বাংলা তারিখ লেখার প্রচলন শুরু হোক। বাংলা লিট্ল ম্যাগাজিন
এখনও বাঙালিয়ানা ধরে রেখেছে। গ্রীষ্ম সংখ্যা, বর্ষা সংখ্যা, বসন্ত সংখ্যা হয়। নতুন গ্রন্থের
উদ্বোধন হয় পয়লা বৈশাখ। কত আবেগ, কত প্রত্যাশা, কত উজ্জ্বলতায় পূর্ণ বৈশাখের এই শুভ নক্ষত্র নাম। এটা খুবই আনন্দের ও আশার, বাঙালিদের এখনও রেনি সিজনের থেকে বর্ষাকাল বলতে ভালো লাগে।স্প্রিং এর থেকে বসন্ত। উইন্টারের থেকে শীতকাল-ই প্রিয়।
পয়লা বৈশাখে বাঙালির তার নিজের কাছে ফিরুক। নিজের সত্তাকে চিনুক, জানুক। বাঙালি নিজের মতো হোক। এমন একদিন আসবেই
যেদিন বাঙালি তার স্বকীয়তার জন্য বিশ্বের কাছে হয়ে উঠবে পথ প্রদর্শক।
…………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সুকান্ত সিংহ
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment