ফেলে আসা পয়লা বৈশাখ- তবু মায়া রহিয়া গেল
তৃষ্ণা বসাক
পয়লা বৈশাখ বলতেই বুদ্ধদেব গুহের গল্পের একটি চরিত্রকে মনে পড়ে। মানুষটি আপাদমস্তক সাহেবি, তাঁর বউও মেমসাহেব। পোশাক আশাক তো বটেই খাওয়াদাওয়াতেও সাহেবি ধরনধারণ একটু এদিক ওদিক হবার উপায় নেই, হলেই যেন সমাজে মান থাকবে না। সেই মানুষটিই সবার অলক্ষ্যে সাহেবি ধড়াচুড়ো ছেড়ে লুঙ্গি পরেন, লুকিয়ে লুকিয়ে পান্তা খান, তাতে ডলে দেন টবে বেড়ে ওঠা লেবুপাতা। এই লেবু,লুঙ্গি আর পান্তার অনুষঙ্গে আমরা বুঝতে পারি কেমন করে আমরা গোপনে গোপনে বাঁচিয়ে রাখি নিখাদ বাঙ্গালিয়ানা।
বিশ্বায়নের পর, বাজার ধরতে মরিয়া পণ্যনির্মাতাদের কাছে আঞ্চলিক সংস্কৃতির কদর আগের থেকে বেড়েছে। যেমন খবরের কাগজের আঞ্চলিক সাপ্পলিমেন্ট বের হচ্ছে সেই বাজার ধরার জন্য, তেমনি বিহু, পোঙ্গল, বৈশাখী বা বাঙালির নববর্ষও আর ব্রাত্য নেই। এই সময় বাজার ছেয়ে যায় হরেক অফারে। পাঁচতারা হোটেলে মোচার ঘন্ট শুক্তো খেয়ে সারাবছরের অপরাধ ক্ষালন করে বাঙালি।
সে বেশ কথা। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা, ঔপচারিকতার বাইরে ছোট ছোট নিয়মনিষ্ঠা, ব্রত পার্বণে যে প্রাণের স্পন্দন বেজে উঠত, সেটা আর নাগরিক জীবনে কই? চৈত্রের শেষ দিনে ছাতু খাওয়া , বিশেষ করে বাঙ্গাল বাড়িতে আবশ্যিক ছিল। পয়লা বৈশাখের সকালে নিম হলুদ বাটা মেখে স্নান করাও তেমনি। আমাদের বাড়িতে একটা ঘটির জলে পাঁচটা ফুল আর সোনা রুপোর কোন গয়না, সাধারণত আংটি ডোবানো থাকত। স্নান করে সেই জল গায়ে ছিটিয়ে দিতেন মা। মনে করা হত, এতে সারা বছরের সব কাজেই শুভ ছোঁয়াটুকু থাকল।
বাঙালি মেয়েরা যে শুধু নিজের স্বামী সন্তানের মঙ্গলটুকু চেয়েই খুশি থাকতেন, তা কিন্তু নয়। তার প্রমাণ রয়েছে নানা মেয়েলি ব্রতে। যেমন পৃথিবী পূজা ব্রত। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে সারা বৈশাখ মাস এই ব্রত পালন করা হয়। ব্রতের ফল হিসেবে বলা আছে- আমরা সবাই পৃথিবীর ওপর বাস করি। মা যেমন সন্তানের অত্যাচার বুক পেতে নেন, পৃথিবীদেবীও তেমনি আমাদের শত অত্যাচারেও বিচলিত হন না। যে পৃথিবীমাতা আমাদের জন্যে এত করেন, তাঁকে সন্তষ্ট রাখিলে সংসারের মঙ্গল সাধিত হয়ে থাকে’ মাটিতে পিটুলি দিয়ে পদ্মপাতা এঁকে সেখানে আবাহন করা হয় পৃথিবীমাতাকে।
ভাবতে অবাক লাগে ইকোলজির তত্ত্ব চালু হওয়ার কত আগে বাংলার নিরক্ষর মা বোনেরা প্রকৃতিকে বাঁচানোর কথা ভেবেছেন আর তার শুভ সূচনা হচ্ছে এই পয়লাতেই। এই দিনই তুলসী গাছটির ওপর মাটির ঝারা বাঁধা হয়, যাতে রৌদ্রদগ্ধ তুলসী গাছটি জীবনরস পায়, খর রোদে শুকিয়ে না যায়। আমাদের পয়লা বৈশাখ এইভাবেই জড়িয়ে রাখে সারা পৃথিবীর মঙ্গলকামনাকে। শুধু মানুষ নয়, সমস্ত জীব এবং গাছপালা সবাই ভালো থাকলেই তবে আমরাও ভালো থাকব- এমন শুভবোধ আর সুবিবেচনার কথা বলে। এ জীবন শুধু মানুষের নয়, শালিখের, চড়াইয়ের, দোয়েলের, গাছের, নদীর, পুকুরের। তাই তো ব্রতের নাম অশ্বত্থপাতার ব্রত কিংবা পুণ্যিপুকুর। আর এখানেই ইংরেজি নিউ ইয়ার থেকে গেছে আমাদের বৈঠকখানায়, অন্দরমহলে প্রবেশ করেনি। ইংরেজি নিউ ইয়ারে আমরা ফূরতি করি, পার্ক স্ট্রিটে যাই, কিন্তু সে যেন বহিরঙ্গের বাঙালি, অন্তরঙ্গে সে তো নববর্ষের শুভচেতনা আর শুদ্ধতাকে জড়িয়েই বাঁচতে চায়। যেন বাড়ির খানিকটা বাউন্ডুলে অবাধ্য ছেলেটির মতো, মা জানেন, যেখানেই যাক, বচ্ছরকার দিনে সে বাড়ি ফিরে আসবেই। পয়লা বৈশাখ বাঙালির সেই ঘরে ফেরা, শেকড়ে ফেরা। সেই বাঙালি নিম হলুদ মাখুক বা না মাখুক, হালখাতা ক্রুক বা না-ই ক্রুক, লুকিয়ে পান্তা খাক বা হোটেলে শুক্তো খেতে ছুটুক, সে বাঙ্গালিই।
…………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সুকান্ত সিংহ
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
পয়লা বৈশাখ মানে মা আনকোরা নতুন জামা পরিয়ে দিলেন । চুল পরিপাটি আঁচড়ে আমি দৌড়লাম হারুদা আর তিনকড়ি দার দোকানে । দৌড়লাম শঙ্করদার কয়লা গোলায় । ক্যালেন্ডার আর লোভনীয় মিস্টির বাক্স নিয়ে খাতার ধারবাকিও মেটানো হল,দুপুরে মাংসভাত।বিকেলে মা এর হাত ধরে দয়াময়ী বস্ত্রালয় যাওয়া ,সেখানে ঘোলের শরবত আর সন্দেশ এর হাতছানি । এমন কিছুটা ছিলো আমার পয়লা বৈশাখ
ReplyDelete