রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১৩
প্রথম প্রেম
মহাশ্বেতা দাস
ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটিকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য বহুরকম চেষ্টা করা হলেও প্রায় সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে ছেলের বয়স যে প্রায় সতেরো!! ঠাকুরবাড়ির লোকজনের তাই রবিকে নিয়ে মহা উদ্বেগ..... কেবলমাত্র কবিতা, গান,
গদ্য লিখেই কাটিয়ে দেবে!
এমন সময় মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর কয়েকদিনের জন্যে কলকাতায় এলেন। কিছুদিন আগে তিনি তাঁর স্ত্রী - পুত্র - কন্যাকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। এবার তিনিও বিলেত যাবেন -- যাবার আগে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় এলেন। সে যুগে বড়লোক বাড়ির ছেলে লেখাপড়া না করলে তাকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত পাঠানো হতো। সত্যেন্দ্রনাথ ও তাই পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানালেন.... ছোট ভাই রবিকে বিলেত নিয়ে যেতে চান। মহর্ষি এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। বিলেত যাত্রার জন্য রবির নতুন জোব্বা - চাপকান - পেন্টুলেন তৈরী করানো হল। কিন্তু রবি বিলেতে গিয়ে করবেন কী?!! বিলেত যাত্রার আবশ্যক ইংরেজি ভাষাও তেমন আয়ত্ত হয় নি। তাই ঠিক হল কয়েকমাস আমেদাবাদে মেজদাদার বাড়িতে থেকে ইংরেজিটা সড়গড় করিয়ে নেওয়া হবে।
আমেদাবাদ শাহিবাগে মেজদাদা যে বাড়িতে থাকেন, মোগল আমলের ছোটখাট প্রাসাদ সেটা। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সবরমতি নদী। সত্যেন্দ্রনাথ আদালতে চলে গেলে এতবড় নির্জন বাড়িতে রবি বেশিরভাগ সময় কাটান মেজদাদার লাইব্রেরীতে। বিভিন্ন ইংরেজি বই পড়ে রপ্ত করতে চেষ্টা করেন বিলিতি ভাষা। তার সাথে নির্জন পরিবেশে সবরমতী নদীর বহমানতায় রবির মনে জেগে উঠে কত কল্পনা। দূর থেকে ভেসে আসে মনে গানের সুর -- স্বভাব কবি ছেলেটি সেই সুরে ভাষা দেন। "ভারতী" দ্বিতীয় বছরে.... তাই পত্রিকার জন্যেও লেখা পাঠান। এভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু মেজদাদা অনুভব করলেন একা একা এখানে ছোট ভাইটির ইংরেজি বলা - কওয়া অভ্যেস হচ্ছে না। তাই রবিকে পাঠিয়ে দিলেন বোম্বাইয়ে বন্ধু আত্মারাম পান্ডুরঙ্গের বাড়িতে।
"প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি,
প্রতিদিন গান গাহি --
প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান
ধীরে ধীরে উঠ চাহি।
আজিও এসেছি, চেয়ে দেখ দেখি
আর তো রজনী নাহি।
সখি শিশিরে মুখানি মাজি
সখি লোহিত বসনে সাজি,
দেখ বিমল সরসী - আরশির' পরে
অপরূপ রূপ রাশি।"
এখানেই অপেক্ষা করেছিল রবির জীবনে প্রথম প্রেম -- প্রথম ভালোবাসা। পান্ডুরামের মেয়ে আন্না তড়খড় তাঁর শিক্ষা বিলেত থেকে ঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন। আন্নার উপরই ভার পড়লো রবিকে ইংরেজি শেখানোর জন্য। আন্নার কাছে ইংরেজিয়ানার মকস করার ফাঁকে ভাবে ভঙ্গিতে রবিও জানিয়ে দিলেন তিনি স্বভাব কবি। রবির মুখে কবি কাহিনীর তর্জমা শুনতে শুনতে অনেক কবিতাই মুখস্থ হয়ে যায় আন্নার। ধীরে ধীরে সদ্য যৌবনে পা রাখা ঠাকুরবাড়ির সুদর্শন ছোট ছেলেটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন মারাঠি মেয়েটি। মেয়েটির অনুরোধে কবি তাঁর নাম দিলেন "নলিনী"। কাব্য ভাবনার সুতোয় নামটিকে গেঁথে দিলেন একটি কবিতায়.....
" শুন নলিনী, খোল গো আঁখি --
ঘুম এখনও ভাঙিল নাকি!
দেখ, তোমারি দুয়ার - 'পরে
সখী, এসেছে তোমারি রবি।"
তরুণ কবির কণ্ঠে কবিতা শুনতে শুনতে আন্না একদিন বললেন -
"তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় মরণ দিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।"
কবির পরবর্তী জীবনে নানা অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে, বিধাতা ঘটিয়েছেন কতইনা অঘটন তবু এই মেয়েটিকে কবি ভুলতে পারেন নি। বিভিন্ন কবিতায় তাই এসেছে মেয়েটির প্রসঙ্গ। একসময় কবি লিখছেন --
"জীবন যাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন মানুষের দ্যুতি, হৃদয় দখলের সীমানা বড় করে দিয়ে যায়। না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর পাওয়া যায় না।"
……………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সম্পাদক
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment