Saturday, 11 March 2023

সুকান্ত সিংহ -র গদ্য // ই-কোরাস ১০০

 




হারানো দিন, পুরানো বই 

সুকান্ত সিংহ 

যখন পড়ার বইয়ের বাইরের পড়ার দিকে টান জন্ম নিল, তখন থেকেই লুকিয়ে পড়ার কায়দা-কৌশল শেখার শুরু। ইস্কুলের বই ছাড়াও আমাদের জন্য যে আরো অনেক বই আছে, যার পৃষ্ঠার আড়ালে গভীর জঙ্গল, খরস্রোতা নদী, আর ধূসর রঙের পাহাড় লুকিয়ে আছে, এসব জানতে সময় লেগেছিল বইকী! জানার পর কী যে এক অমোঘ টানে সেদিক পানে ছুট লাগিয়ে ছিলুম, আজও সে দৌড় থামেনি। 

      আমাদের ছোটবেলায় সবকিছুই তো আর আজকের মতন এমন হাতের কাছে ছিল না, খুঁজে পেতে আনতে হত সেসব। বইও তাই। আর ওই খোঁজাখুঁজির মধ্যেই ছিল ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি। তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হত কার ঘরের কোন আলমারিতে কী কী বই আছে! কখনও ব্যোমকেশের মতো কোনো প্রিয় অজিতকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হত কোনো পুরাতন বাক্স খুলে দেখতে সেখানে শুকতারা বা চাঁদমামা রাখা আছে কি না! তারপর সুযোগ বুঝে সেই বই বার করে দ্রুত পড়ে আবার ঠিকঠাক জায়গায় রেখে দেওয়া। অনেকে টেরই পেত না যে আলমারি থেকে বই বেরিয়ে আবার আলমারিতেই কবে ফিরে এল!

       আগেভাগেই বলে রাখি আমার বই পড়ার অভ্যাসের জন্য যদি কেউ দায়ি থাকে, তা হল বাংলাভাষার শিশু-কিশোর সাহিত্যের অসাধারণ সম্ভার। আর এই জন্যই আমি চিরকাল এই ভাষার কাছে ঋণী। মাতৃভাষা বাংলা, শুধু এই জন্যই এই ভাষার এত কদর তা কিন্ত নয়, যে-ভাষা এমনতর সাহিত্যের সম্ভার নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকে, তার কাছে ঋণ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।

       সেই যে পড়ার বইয়ের বাইরে এত বই, এর কথাই বলি। পাঠ্য বইয়ে গল্প কবিতা থাকে সীমিত। সিলেবাস অনুসারে সেসব রাখা। তাতে তো আর মন ভরে না। মন চাইল আরো পড়তে। শুরু হল খোঁজ। কে জন্মদিনে বই উপহার পেয়েছে, কার দাদা বা দিদি গোয়েন্দা কাহিনীর বই কিনে রেখেছে -- এসব খবর রাখতে হত। তখনকার দিনে বিয়েবাড়িতে বই উপহার দেওয়ার চল ছিল। একটি বিয়েবাড়ি মানেই অন্তত তিন চারটি বই পাওরা যেত। সেসব বইয়ের বেশিরভাগই দেখা যেত শরৎচন্দ্রের লেখা কোনো উপন্যাস। এখন বিয়ে বাড়িতে বই  উপহার দেওয়ার চল নেই বললেই চলে, বদলে চায়ের কাপ বা নন-স্টিকের কড়াই! বলিহারি এমন বদলে।

       যাই হোক, আমরা খোঁজ করতুম কার কাছে কী বই এল। তারপর সেগুলো ভাগাভাগি করে পড়া হত। তখন  ইস্কুলের লাইব্রেরিতে খুব বেশি বই থাকত না। থাকত সরকারি লাইব্রেরিতে। সেখানে সদস্য হলেই বই আনা যেত বাড়িতে। যিনি লাইব্রেরিয়ান থাকতেন, তিনি পইপই করে বলে দিতেন পাতা মুড়লে বা ছিঁড়লেই আর কখনো বই বাড়িতে আনতে দেবেন না। বইয়ের ভেতরেও স্টাম্প ছাপ দেওয়া থাকত 'পাতা মুড়িবেন না'। দেখা যেত, ঠিক সেই পাতাইটাই কেউ মুড়ে রেখেছে! লোকের অভ্যাস ছিল মনে রাখার জন্য পৃষ্ঠার কোণ মুড়ে রাখা। কেউ কেউ পাতার মাঝে পাখির পালক গুঁজে রাখত। কেই বাসের টিকিট। একজন তো চন্দনকাঠের ক্লিপ ব্যবহার করত। তার উপর নকশা কাটা। এখন তো কত রকমের পেজ-মার্ক পাওয়া যায়।

       বই কিন্তু পেলেই হবে না, সব বই সবার জন্য নয় এটাও মনে রাখতে হত। লাইব্রেরি থেকে বাড়ি সর্বত্র একটা অলিখিত নিয়ম ছিল -- ছোটরা সব বই পড়তে পাবে না। কিছু বই ছিল কেবল বয়সে বড়দের জন্যই। আরেকটা ব্যাপার ছিল, তখন বড়রা মনে করতেন এডভেঞ্চার বা গোয়েন্দা কাহিনী বেশি পড়লে ছোটরা গোল্লায় যাবে। সত্যি বলতে, আমাদের আবার ওইসব পড়তেই বেশি ভালো লাগত। ফলে বড়দের চোখের আড়ালে আমরা পড়তুম স্বপনকুমার, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা রোমাঞ্চকর সব বই। ইস্কুলের বইয়ের মাঝে লুকিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে কত সন্ধ্যায় যে ওইসব বইয়ের সাথে কত কত রোমাঞ্চকর অভিযানে গেছি, আজ তার লেখাজোকা নেই!

       বাইরের পড়ার ধরতাই কিন্ত ইস্কুলের পড়া দিয়েই। যার মধ্যমণি ছিল রবীন্দ্রনাথের 'সহজ পাঠ'। ভক্তরামের শক্ত কাঠের নৌকা হোক বা কাঠুরে সর্দারের গল্প, ইস্কুলের পড়ার মাঝে মুক্তির স্বাদ পেতুম সহজ পাঠের পাতায়। সেখানে নন্দলাল বসুর আঁকা চমৎকার সব ছবিতে নিজেদের মতো করে রঙ বুলিয়ে দিতুম। বাইরের পড়া বইয়ের একেবারে প্রথমেই থাকবেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তাঁর লেখা গুপিগাইন-বাঘাবাইন, টুনটুনির বই হৈ হৈ করে পড়া হত। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের 'ঠাকুরমার ঝুলি'। আমরা কেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বইয়ের গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলেন।

       আগেই বলেছি আমাদের ছোটবেলায় সবকিছুই আজকের মতো এমন সহজেই পাওয়া যেত না। সেটা যাই হোক না কেন। আমাদের বিনোদন বলতে ছিল খেলাধুলা আর বই। বই খুব সহজলভ্য ছিল না। ইস্কুলের বা গ্রামের সরকারি লাইব্রেরিতে অনেক অনেক বই কেনা হত এমনটা নয়। তখন সবকিছু টেনেটুনেই চলত। বইও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে এক বই বহুবার পড়া হয়ে যেত। কিছু বই আবার এমন ছিল, যেগুলো হাজারবার পড়লেও পুরোনো হবার নয়। যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চাঁদের পাহাড়'। এ বই কতবার যে পড়েছি, পড়তে পড়তে শঙ্করের সাথে আফ্রিকার সেই গহীন জঙ্গলে চলে গেছি কতবার! বাঙালি কিশোর-জগতকে আফ্রিকায় নিয়ে গেছে তো এই বই। বাস্তব উদাহরণ যতই থাকুক, বাঙালি যে বিপদসঙ্কুল পথে বেরিয়ে পড়তে পারে, তার সাহিত্যগত উদাহরণ বুঝি এই 'চাঁদের পাহাড়'।

       আরেক বাঙালি চরিত্রের কথা বলতেই হয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা। ঘনাদা পৃথিবীর কোন দিকটাতে যে যায়নি, গিয়ে রহস্যের গোড়া সহ উপড়ে ফেলেনি, সেটা বলা মুশকিল। ষষ্ঠিপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্তু-কাকাবাবু বা সত্যজিতের ফেলুদা-তোপসে-লালমোহনবাবু পড়ে আমাদেও ইচ্ছে হত ওইরকম গোয়েন্দা হই। নিদেনপক্ষে গোয়েন্দার সহকারী হতেই হবে।    

       অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বুড়ো আংলা' রিদয়ের সাথে আমতলি- জামতলি পেরিয়ে যেতে যেতে কত ঘটনা যে ঘটত মনের ভেতর! লীলা মজুমদারের লেখা একটু পরে পড়েছি। তাঁর পদি পিসির বর্মি বাক্স বা দিন দুপুরে পড়ে সে কী ভীষণ মজা। আর একটি উপন্যাস 'হলদে পাখির পালক', বাংলা সাহিত্য তো দূর, পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় এমন উপন্যাস আর আছে কি না জানি না। এই একটাই আমাদের কৈশোরের অনেক কিছু না-পাওয়ার দুঃখ ভুলিয়ে দিত। আর এইটিই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া।

       আমাদের কবিতার জগত জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জসিমউদ্দিন, বন্দে আলি মিঞা, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। এঁদের লেখা কবিতা যেমন আমরা যেকোনো অনুষ্ঠান আবৃত্তি করতুম, তেমনই একা একা হাঁটতে হাঁটতে এঁদের কবিতার পঙক্তি কণ্ঠে উঠে এসে আমাদের পথের সঙ্গী হত। ছিলেন সুকুমার রায়। তাঁর লেখা ছড়া আজো তো বিস্ময়ে ভরিয়ে রাখে, সেই যে কাতুকুতু বুড়ো কিংবা খাচ্ছে কিন্ত গিলছে না! মজার ছলে বাস্তব বা অসঙ্গতি দেখিয়ে দিতে পারতেন তো সুকুমার রায়-ই।

       অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে বিখ্যাত ছিল শার্লক হোমস, জুলে ভার্ন, জিম করবেট -- এসব। ছিল ব্রাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলা। সেই বইয়ের প্রচ্ছদে আঁকা থাকত ড্রাকুলার রক্ত মাখা দাঁতের ছবি। উফ্, কী যে ভয়ানক। এই সব বই পড়ে ঘুমের ঘোরে আঁতকে উঠলে কোন অভিভাবক না রেগে যাবেন! অথচ এইসব বই নিয়েই বেশি কাড়াকাড়ি হত। মারামারি যে হত না, এমনটা হলফ করে বলতে পারি না। বই দেওয়া-নেওয়া নিয়ে বন্ধুদের সাথে মন কষাকষি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আবার বইয়ের জন্যই বন্ধুর সব দোষ মাফ করে দেওয়া যেত। বইয়ের জন্য আমরা অনেকিছুই করতে পারতুম।

       বই নিয়ে কথা বলতে গেলে তার মলাট নিয়ে কথা বলতেই হয়। পাঠ্য বই হোক বা গল্পের বই, মলাট দেবার চল ছিল খুব। মলাট হিসেবে খবরের কাগজ ব্যবহার করা হত, ব্যবহার করা হত পুরাতন ক্যালেন্ডার। আবার খয়েরি রঙের মলাট কাগজ কিনে আনত। অনেক পরে সেই কাগজের উপর লাগল প্লাস্টিকের পরত। যদিও আমরা কৈশোরে এমন কাগজ কমই পেয়েছি। কেউ কেউ, একটু সৌখিন যারা, তারা কোনো দামি বই কাপড় আর পিচবোর্ড দিয়ে বাঁধাই করে রাখত। তার খোলা দিকের পাতায় সোনালী রঙের সমাবেশ। মলাটে সোনালী রঙে বইয়ের নাম জ্বলজ্বল করছে। সেসব বইয়ের গা দিয়ে একটা চাপা আভিজাত্য যেন ফুটে বেরোতো সবসময়। বড় হয়ে ঠিক ওই রকম করে একটা বই বাঁধাই করাবার ইচ্ছে করেছিলুম। পরে যখন বড় হলুম, টিউশন পড়িয়ে টাকা পেলুম, ওই রকম বাঁধাই করিয়ে ছিলুম একটা বই। যদিও সোনালী রঙ দিয়ে নামটা লেখা যায়নি, তবু মনের ভেতরে থাকা ছবিটার কাছাকাছি ছিল সেই বাঁধাই। সেই বইটার নাম ? -- সঞ্চয়িতা। আজও সে আমার জীর্ণ ঘরে রয়ে গেছে কোনো অভিযোগ ছাড়াই!

       বই হল সেই লাইট হাউস, যে আমাদের জীবনতরীকে ঝড়ঝাপটার রাতে আলো দেখায়। সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়। ইদানিং শুনি পড়ার বাইরে বই পড়ার আগ্রহ নাকি কমেছে। অনেকে বলে বইয়ের বিকল্পে নাকি আরো অনেক কিছু এসে গেছে! এগুলো আমি মোটেই মানি না। হ্যাঁ, আমাদের ছোটবেলার মতো হয়তো আজকের ছোটরা তেমন করে বই টেনে নেয় না, তাহলেও, বইয়ের বিকল্প হতে পারে শুধু আরেকটা বই। অন্য কিচ্ছু নয়। 

         ছোটবেলার সেই দিনগুলোর হারিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্ত স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই সব বই, যারা ছিল বলে এখনো হোঁচট খেলে উঠে দাঁড়ানোর সাহস পাই। বইয়ের ভুবন অসাধারণ এক ভুবন, যেখানে সারাক্ষণ ভোরের আলোয় ভরে থাকে। আর মানুষের যাত্রা তো সেই আলোর দিকেই!

                         ............................ 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - সন্দীপ দত্ত

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...