রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১১
কবিতারম্ভ ও মাতৃ বিয়োগ
মহাশ্বেতা দাস
শান্তিনিকেতনের শান্ত মুক্ত পরিবেশে বালক রবি প্রথম অনুভব করেছিলেন কবিতা সাধারণ কলম দিয়ে সাধারণ মানুষই লিখে থাকে। তারপর প্রবল উৎসাহে ভাঙা ছন্দে উল্কা বৃষ্টির মতো যে কাব্য লেখার পালা শুরু হয়েছিল তা ক্রমশঃ এগিয়ে চললো। হিমালয় থেকে ফিরে ইস্কুলে যেতে যে মন চায় না.... সেসব ভাবনা প্রকাশ পেল অভিলাষ কবিতায়..... যে কবিতা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বটে তবে বিনা নামে।
ঠাকুর বাড়ির অন্যান্য ছেলেরা সেজেগুজে ঘোড়ার গাড়ি চেপে ইস্কুলে গেলেও বালক রবির প্রতিদিনই কিছু না কিছু কারণ ঘটতে থাকে ইস্কুলে না যাওয়ার জন্য। শেষে ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে ঘরে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হল। গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। যিনি গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে এই বালকের জন্য অভিনব পদ্ধতিতে পড়াতে শুরু করলেন কালিদাসের "কুমার সম্ভব" আর শেক্সপিয়রের "ম্যাকবেথ" নাটক... যেগুলি বালকের মনের মাঝে রচনা করেছিল অপূর্ব দুটো জগৎ। জ্ঞানচন্দ্র মহাশয়ের শিক্ষকতায় পঠিত বিষয় গুলিকে বাংলা কবিতায় তর্জমা না করা পর্যন্ত রেহাই মিলত না। ম্যাকবেথ নাটকের কিছু অংশের তর্জমা ভারতী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল.... যদিও এবারেও বিনা নামেই।
এইভাবে বালক রবির অনেক কবিতাই বিনা নামেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। জ্যোতিদাদার" সরোজিনী" নাটকে "জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ" কবিতাটি ও তাই।
ছাপার অক্ষরে " হিন্দু মেলার উপহার" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম স্বনামে প্রকাশিত কবিতা। এরপর একে একে "প্রকৃতির খেদ", "বনফুল" ইত্যাদি।
"বিষ্টি পড়ে টুপুর টুপুর,
মেঘ করেছে আকাশে,
ঊষার রাঙা মুখখানি আজ
কেমন যেন ফ্যাকাশে!
বাড়িতে যে কেউ কোথা নেই,
দুয়োর গুলো ভেজানো --
ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াই
ঘরে আছে কে যেন।"
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে বহুবার। জীবনের বিভিন্ন ধাপে এক একটি মৃত্যু এক এক ধরনের শোক গেঁথে দিয়েছিল কবির মনে যা বিভিন্ন কাব্যে লেখনীতে প্রকাশিত। একেবারে শৈশবে হারিয়েছিলেন ছোট ভাই বুধেন্দ্রনাথ কে। যদিও সেদিন মৃত্যুকে উপলব্ধি করার মত বয়স হয়নি -- তাই সে মৃত্যু তেমন ভাবে ছাপ ফেলতে পারে নি। কিন্তু কৈশোরে মাত্র তেরো বছর বয়সেই হারালেন মা সারদা দেবী কে। রাতে সারদা দেবীর মৃত্যু হলেও রবি মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেলেন সকালে ঘুম থেকে উঠে। বাইরের বারান্দায় এসে যখন দেখলেন সুসজ্জিত খাটের উপরে সারদা দেবী শায়িত.... তখনও মৃত্যুর ভয়ঙ্কর রূপ উপলব্ধিতে আসে নি। কিন্তু শ্মশান যাত্রার সময় যখন মৃতদেহ সদর দরজার বাইরে নিয়ে যাওয়া হল.... তখনই সমস্ত শোক যেন ঝড়ের দমকা হাওয়ার মতো এসে মনের ভিতর হাহাকার তুলে দিল। উপলব্ধি করলেন.... মা আর কোনদিন এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আসন পেতে বসবেন না। শ্মশান থেকে ফিরে এসে দেখলেন..... পিতা দেবেন্দ্রনাথ তখনও তাঁর তেতালা ঘরের সামনের বারান্দায় স্তব্ধ হয়ে উপাসনায় বসে আছেন।
"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে।
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা মিটিয়ে দেব গো,
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে।"
……………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সম্পাদক
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment