রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১০
পুনরাগমন
মহাশ্বেতা দাস
"মা গো আমায় ছুটি দিতে বল
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।
এখন আমি তোমার ঘরে বসে
করবো শুধু পড়া পড়া খেলা।"
ছোট থেকে চাকর বাকরদের শাসনের বেড়াজালে যে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল, বাড়ির অন্দর মহলের সমস্ত রূপ রস গন্ধ থেকে ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটিকে যে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল.... পিতার সাথে হিমালয় ভ্রমণে গিয়ে সেই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথম স্বাধীনতার আস্বাদ তো উপভোগ করেছিলেনই এমনকি বাড়ি ফিরে ও দেখলেন অন্দর মহলে প্রবেশের এতদিনের বাধা সম্পূর্ণ রূপে ঘুচে গেল। চাকর বাকরদের ঘরের বদলে ছোট ছেলেটির স্থান হল মায়ের ঘরে। শুধু তাই নয়, ঠাকুর বাড়ির সেই সময়কার নতুন বধূ পঞ্চম দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর কাছ থেকেও প্রচুর স্নেহ ও আদর লাভ করলেন। এ বোধয় টানা কয়েকমাস রাশভারী পিতা দেবেন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভের দুর্লভ সুযোগের কারণে ঠাকুর পরিবারে ছোট ছেলেটির সম্মান বেড়ে উঠেছিল। যাইহোক, প্রত্যেক শিশুর জীবনে যা আবশ্যক.... মেয়েদের স্নেহ - যত্ন - আদর থেকে বঞ্চিত থাকতে থাকতে যে কাঙাল হয়ে উঠেছিলেন সেই স্নেহরসের অঢেল প্রাপ্তি ঘটল এই সময়ে।
প্রথম বেশ কয়েকদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর গল্প ঘরে ঘরে বলে কেটে গেল। কিন্তু একই গল্পে বারবার যতই কল্পনার রঙ মেশানো হোক না কেন.... এক সময়ে তা ফিকে হয়ে এলো। কিন্তু এ জগতে মায়ের কাছে ছেলে তো সর্বদাই চাঁদের কণা! .....
" লিখতে গিয়ে হাতে মুখে
মেখেছ সব কালি।
নোংরা বলে
তাই দিয়েছে গালি।
ছিঃ ছিঃ উচিৎ এ কি!
পূর্ণ শশী মাখে মশী
নোংরা বলুক দেখি।"
তাই মায়ের সন্ধ্যেবেলার আসরে প্রধান বক্তা হয়ে ওঠার পথে এসব কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারে নি। আবার সারদা দেবী যখন শুনলেন মহর্ষির কাছে রবি বাল্মীকির লেখা অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়ে এসেছেন.... তখন পুত্র গর্বে গরবিনী মায়ের আনন্দের সীমা রইল না।
এসব তো গেল ঘরের কথা। কিন্তু ইস্কুল!! আবার বেঙ্গল একাডেমি ইস্কুলে যাবার পালা। কিন্তু....
" কত দিন ভাবে ফুল
উড়ে যাব কবে
যেথা খুশী সেথা যাব
ভারি মজা হবে।
তাই ফুল একদিন
মেলি দিল ডানা।
প্রজাপতি হল তারে
কে করিবে মানা?"
যে শিশুর মন প্রথম থেকেই স্বাধীনচেতা, ইস্কুলের চারদেওয়ালের গণ্ডি যার কাছে কারাগারের তুল্য.... সেই ছেলে পিতার সাথে হিমালয় ভ্রমণে গিয়ে যে স্বাধীনতার আস্বাদ পেয়েছে তার পক্ষে এবার ইস্কুলের গণ্ডি যে আরও দুঃসহ মনে হবে... একথা বলার অপেক্ষা রাখে কি!! ফল যা হবার তাই হল...… নানা ছলে বেঙ্গল একাডেমি থেকে পালাতে শুরু করলেন। এরপর বেঙ্গল একাডেমি থেকে তুলে এনে ভর্তি করা হল সেন্ট জেবিয়ার্স স্কুলে। কিন্তু বিশেষ কোন উপকারে এলো না তা। ফুলের মতো রবির মন একদিন প্রজাপতি হয়ে প্রকৃতির পাঠশালায় ডানা মেলে দিল স্বচ্ছন্দে।
বড় দাদারা মাঝে মধ্যে চেষ্টার অন্ত রাখেন নি ছোট ভাইটিকে ইস্কুল মুখী করার জন্যে। কিন্তু বহু চেষ্টার পরও গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় সামিল করার কাজে বারে বারে ব্যর্থ হয়ে একসময় হাল ছেড়ে দিলেন। একদিন বড়দি সৌদামিনী দেবী দুঃখ করে বললেন....
" আমরা সকলেই আশা করিয়াছিলাম, বড়ো হইলে রবি মানুষের মতো হইবে, কিন্তু তাহার সকল আশাই সকলের চেয়ে নষ্ট হইয়া গেল।"
কিশোর রবি এসব যে বুঝতেন না তা নয়। তবু জেলখানা বা হাসপাতাল তুল্য চারদেয়ালে বদ্ধ এই ইস্কুল জীবন যা চারিদিকের প্রাকৃতিক জীবন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন.... সেই নির্মম বিভীষিকার নিত্য ঘূর্ণায়মান ঘানির কক্ষপথে কিছুতেই নিজেকে জুড়তে পারলেন না।
আবার এসবের মধ্যে ও এই কিশোরটিরই মন ছুঁয়ে গেলেন কোন এক শিক্ষক মহাশয়। স্পেনীয় অধ্যাপক ফাদার ডি পেনেরণ্ডার যেদিন ক্লাসে পায়চারি করতে করতে দেখলেন রবির কলম সরছে না... শাসন পীড়নের কথা না ভেবে সস্নেহে পিঠে হাত রেখে বললেন.... " টেগোর তোমায় কি শরীর ভালো নাই।" বিশেষ কিছুই নয় তবু এই ঘটনার আবেশ ছড়িয়ে গেল কিশোরটির মনে প্রাণে এবং আজীবন তিনি ভুলতে পারেন নি.....
" আজও তাহা স্মরণ করিলে আমি যেন নিভৃত নিস্তব্ধ দেব মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবার অধিকার পাই।"
…………………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment