Tuesday, 7 February 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা //ই-কোরাস ৬

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৬ 

কবে আমি বাহির হলেম

মহাশ্বেতা দাস


বিশ্বকবির বহুবার বিশ্বভ্রমণের কথা কম বেশী সবাই জানি অথচ শিশু রবির ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ানো তো দূরের কথা চলা ফেরার ভৌগলিক পরিধিও ছিল খুব সীমিত। বাড়ির বাইরে যাওয়া তো বারণ ছিলই এমনকি বাড়ির ভিতরেও যখন তখন যাওয়ার অনুমতি ছিল না। তাই অধিকাংশ সময় কাটত ভৃত্যদের হেপাজতে- জীবনস্মৃতি গ্রন্থে জীবনের এই পর্ব কে তিনি তাই "ভৃত্যরাজক তন্ত্র" আখ্যা দিয়েছেন। 


কলকাতায় যেদিন ডেঙ্গু জ্বরের তাড়নায় ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্যকেই ছোট্ট রবিকে সঙ্গে নিয়ে পেনেটি বা পানিহাটিতে ছাতুবাবুর বাগান বাড়িতে মাসিক ১২৫ টাকা ভাড়ায় মাস দেড়েকের জন্য আশ্রয় নিতে হলো- সেদিনটি ছিল রবির জীবনে এক স্মরণীয় দিন কারণ শিশুমন এই প্রথম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অবরুদ্ধ গতানুগতিক জীবনের একঘেঁয়ে অভ্যস্ত ধারা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ির বাইরে পা রেখেছিল। তাই পরিণত বয়সে বহুবার বিশ্বভ্রমণে গেলেও বাইরের জগতের সাথে প্রথম পরিচয়ের এই তীব্র আনন্দ- অনুভূতি তিনি কখনও ভুলতে পারেন নি। জীবনস্মৃতি গ্রন্থে তাই লিখেছেন-"গঙ্গার তীরভূমি যেন কোন পূর্ব জন্মের পরিচয়ে আমাকে কোলে করিয়া লইল।" 


 তবে পেনেটির বাগানবাড়ি তে এসেও চলাফেরার নিষেধ বা চাকর বাকরদের শাসন শিথিল হল না। বাগানবাড়ির খুব কাছেই বাংলার পল্লিগ্রাম... কিন্তু সেখানেও যাওয়া বারণ ছিল।

  

"আমরা বাহিরে আসিয়াছি কিন্তু স্বাধীনতা পাই নাই।" 


চাকরদের ঘরের সামনে কতকগুলি পেয়ারা গাছ ছিল। সেই পেয়ারা গাছের আড়াল থেকে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দিন কাটত ঠাকুর পরিবারের ছোট ছেলেটির। গঙ্গার মুক্তধারা শিশুমনের সমস্ত বন্ধন যেন হরণ করে নিয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হত যেন আজকের দিনটি একখানি সোনালী পাড় দেওয়া নূতন চিঠি!.... খাম খুললেই অনেক অপূর্ব খবর পাওয়া যাবে! গঙ্গা নদীর কত রূপ যে এই চোখে ধরা পড়ত সেদিন....!! জোয়ার ভাটার আসা যাওয়া, গঙ্গার জলে পেয়ারা গাছের ছায়া গুলির পশিম থেকে পূব দিকে সরে সরে যাওয়া, সূর্য ডুবার পালা এলে অর্চিষ্মানের রক্তিম আভায় গঙ্গার অপরূপ শোভা শিশুমন কে কল্পনার রাজ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। 


   "কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার

        নেই মানা মনে মনে..." 


গঙ্গার বুকে পালতোলা নৌকা যায়... ছোট রবির মন- "বিনা ভাড়ায় সওয়ারি হইয়া বসিত এবং যেসব দেশে যাত্রা করিয়া বাহির হইত, ভূগোলে আজ পর্যন্ত তাহাদের কোন পরিচয় পাওয়া যায় নাই।" --- 


          " সাধ যেত যাই ভেসে

           কত রাজ্য কত দেশে।" 


কোন কোন দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। নদীর ওপারে গাছ গুলি কালো... নদীর জলে তাদের কালো ছায়া পড়ে। বৃষ্টি নামে... ঝাপসা হয়ে যায় চারিদিক। প্রকৃতিকে এই রূপে দেখতে দেখতে শিশু রবির মন যেন নবজন্ম লাভ করে। অভ্যাসের তুচ্ছতার আবরণ একেবারে ঘুচে গেল যেদিন সকালবেলা এখো গুড় দিয়ে বাসি লুচি খেতে দেওয়া হল। জীবনস্মৃতি তে তিনি বলেছেন ---


"স্বর্গলোকে ইন্দ্র যে অমৃত খাইয়া থাকেন তাহার সঙ্গে স্বাদের বিশেষ কিছু পার্থক্য নাই। কারণ, অমৃত জিনিসটা রসের মধ্যে নাই, রসবোধের মধ্যেই আছে- এই জন্য যাহারা সেটাকে খোঁজে তাহারা সেটাকে পায়ই না।" 


বাগান বাড়ির পিছনের দিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ঘাট বাঁধানো একটি পুকুর ছিল আর পাশেই একটা ঝাকড়া জামরুল গাছ। এছাড়াও পুকুরের চারদিকেই নানারকম ফলের গাছ ছিল। এই গাছ-গাছালিতে ঘেরা পুকুরটিকে মনে হত যেন ঘোমটার আড়ালে থাকা গৃহবধূ!  


মাস দেড়েক পরেই আবার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গতানুগতিক একঘেঁয়ে বদ্ধ গণ্ডির মধ্যে ফিরে আসতে হল। তারপর আর একদিনের জন্যে ও এই বাগান বাড়িতে যাওয়া হয় নি। প্রায় চল্লিশ বছর পরে কবির উপলব্ধি --- 


"সেই গাছপালা, সেই বাড়িঘর নিশ্চয়ই এখনো আছে, কিন্তু জানি সে বাগান আর নাই; কেন না, বাগান তো গাছপালা দিয়া তৈরি নয়, একটি বালকের নব বিস্ময়ের আনন্দ দিয়া সে গড়া-- সেই নব বিস্ময়টি এখন কোথায় পাওয়া যাইবে?" 

                   ………………........



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614





No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...