নক্ষত্র পতন
ভবেশ বসু
আজ সারারাত আমার ঘুম হল না।ভিতরে ভিতরে কান্না ছিল।তোমাকে মনে পড়ছিল।ভোর রাতে তুমিই যেন উঠে এলে।কলম ধরিয়ে দিলে।কি লিখবো তোমায় নিয়ে।বাঁশবনে ডোম কানা।কাকে রাখি।কাকে খাই।খড়্গপুরে এসেছিলাম চুয়ান্ন বছর আগে।আর এই ছয় দশকের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম।খড়্গপুরের একটি নাম।নামের সঙ্গে।তার নাম নন্দদুলাল রায় চৌধুরী।"প্রতীকচক্র" টুকরো।অতীতের খড়্গপুরে সাহিত্য বলতে এইটুকুই ছিল।কয়লার শহরে সাদা খাতা।সেই খাতার বড় অভাব।অক্ষর লিখতে লিখতে দুজনের মুখোমুখি হয়ে যাওযা।আমার বীজতলা তৈরি ছিল।চারা গাছও।নন্দদারও একই অবস্থা।শুধু দরকার ছিল জমি।সেই জমির সন্ধানে কত সৃষ্টি।কত পাঠচক্র।একসাথে হাঁটা।কত শব্দ ব্যয় করেছি।কত যোগ বিয়োগ।ভাবি,এই পথ চলায় কতজন সঙ্গী ছিল।তাদের নাম অন্য সময় বলা যাবে।কত স্থান।এভাবে আমি ছড়িয়ে পড়েছি।নন্দদাও চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।পত্র,প্রবন্ধে তার বিচরণ।কবিতা লেখাতেও।আর বিশেষ গুণ ছিল আঁকা।কত লেখকের প্রচ্ছদ তৈরি করে দিয়েছেন।কত ছবি এঁকেছেন।এক আশ্চর্য গুণ ছিল নন্দদার।কথার গুণে মধ্যমণি হয়ে যেতেন।একের পর এক সাহিত্য প্রতিষ্ঠান গড়েছি।ভেঙে গেছে।আবার ভিন্ন নামে গড়লাম।নন্দদা বলেছেন,ভাঙাগড়া না কি আমার হাতেই সাজে।কারণ ভাঙলেই গড়ে নেওয়া যায়।এই গড়ে নেওয়ার একটা পিলার ছিলেন নন্দদা। সবচেয়ে শক্ত পিলার।আমার সাহিত্য রচনায় এই পিলারের ভূমিকা নেই ঠিকই।তবে সংগঠন তৈরিতে পরোক্ষে বালি সিমেণ্ট ছিল।তার নাম নন্দদা।নিশ্চুপে সমর্থন ছিল।হাসি মুখ ছিল।শব্দ,বাক্য ছিল।ব্যকরণ ছিল।আর এই ব্যকরণ দিয়েই খড়্গপুর সাহিত্যের শহর হয়ে গেল।আজ সকলে খড়্গপুর নিয়ে গর্ব করেন খুব।কিন্তু এই গর্বের ভূমিকা লিখেছিল নন্দদুলাল রায় চৌধুরী।নন্দদা বলেছে, ভবেশ তুমি লিখেছ।আমি বলেছি তুমি।এই নিয়ে এত বছর আমাদের হাসাহাসি।এত বছরের ফসল, সংসার,সন্ন্যাস,ধ্যান আমাদের।একদিনও দাম্পত্যে কলহ হয় নি।ভেতরের ভাঙনের গল্প কেউ কাউকে দেখাই নি।দূরে থাকলেও এক অমোঘ টান ছিল তার।দেখা হলেই এক কথা,সকলেই আসে।আমি কেন বারবার যাই না !
এই তো এলাম।দেখ তোমার কাছে এসেছি।বল এবার কি বলবে।চল না আর একবার রাস্তায় হাঁটি।কত কাজ বাকি।কে লড়বে দূষণের বিরুদ্ধে।আমি দেখতে পাচ্ছি,আমার দেওয়া মালাটা গলায় নিয়ে আবার হেসে ফেললে।হাসি দিয়ে বললে কিছু।খড়্গপুর এখন সাহিত্যের এক পিঠ।তীর্থ।তীর্থের পুরোহিতের আসনটি খালি হয়ে গেল।দেখ কেমন খালি করে গেলাম।তুমি যেন নিজেই বললে সে কথা।যখন খড়্গপুরে আসি,তখন আমার বয়স আঠারো।তোমার আঠাশ।দুজনেই যুবক।বাঁশি কিন্তু একটাই ছিল।কখনো তুমি বাজালে।কখনো আমি।কখনো কখনো আবার এক বাঁশি,একসঙ্গে দুজনেই বাজালাম।আজ অজস্র কাঠ টুকরোর উপর তুমি একাই ঘুমালে।আগুন জানে না,কাকে সে ভক্ষণ করছে।মূর্খ আগুন।
জানো নন্দদা,আমার কিন্তু মনে হল এই কাঠ সমগ্ৰ আর কেউ নয়।এই কাঠ সমগ্ৰ আমি নিজে।আঠারো বছরের সেই আমি।চুয়ান্ন বছরের সম্পর্কের সেই আমি।তুমি আমার উপর প্রথম ধ্যানে বসে রাগারাগি করলে।দাপাদাপি।এই প্রথম।এই প্রথম আমরা পরস্পর তর্ক করছি।আজ সারাদিন।সারাদিন আগুন মুখে তুমি তর্ক করলে।
……………......
নন্দদা চলে গেলেন
সুনীল মাজি
নন্দদা চলে গেলেন।
আমার শেষ কথা ছিল পয়লা জানুয়ারি।
প্রতিবছর যেমন যাই নতুন বছরে প্রণাম করতে বিজয়া বা বাংলা নববর্ষে বা ইংরেজি নববর্ষে। এবারেও তাই।
আমার প্রণাম মানে দৃষ্টিতে পা ধুয়ে দিয়ে নিজের জীবন দর্শনের কাছে ফিরে যাওয়া, ঐতিহ্যের কাছে ফিরে যাওয়া।
নন্দদা বলেছিলেন: জানি আজকের দিনে তুমি আসবে।
বৌদি বললেন তাই। বৌদি ছিলেন রয়াল এয়ার ভেটেরানের কন্যা। নবদ্বীপ কন্যা। আমি প্রাক্তন বৈমানিক তথা এয়ারফোর্স সৈনিক বলে ভাতৃস্নেহ ছিল ও আছে বেশি।
আমার সঙ্গে নন্দদার ঘনিষ্ঠতা একুশ বছর আগে। প্রথম প্রথম স্যার বলতাম। পরে দাদা।
সেই দাদার আশ্রয়ে অনেকটাই সৃজনশীল হয়ে ওঠার চেষ্টাও করেছি।
অ্যাকাডেমিক ভাবনা আর ক্রিয়েটিভ ভাবনার আশ্চর্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
কলমের ভাষা আর জিহ্বার ভাষা কেমন হবে নন্দদার কাছে শেখা। অনিলদার বুকের আবেগ আর নন্দদার মেধাকে আমি নেওয়ার চেষ্টাও করেছি।
সেই দুই মানুষ চলে যেতে এ শহরকে মরুভূমি ভাবা স্বাভাবিক।
তবে আমি এই শহরকে মৃত ভাবছিলাম নিষ্ঠুর ভাবছিলাম অকৃতজ্ঞ ও কৃত্রিম ভাবছিলাম।
নন্দদা চলে গেলেন রাত দশটা চল্লিশের পরে পরেই। তারিখ দশ জানুয়ারি দু হাজার তেইশ।
নন্দদার শেষ বাহন চলেছে মন্দির তলার দিকে।
সামনে বারো জন। পেছনে ষোলো জন। নন্দদা আর ড্রাইভার সহ শেষ যাত্রায় ত্রিশ জন।
হায় রে খড়্গপুর শহর।
ভেবেছিলাম কমসেকম তিনশ থেকে হাজার লোক হবে। তার বদলে পদব্রজে শ্মশান যাত্রী তিরিশজন। সব মিলিয়ে ষাটের কাছাকাছি।
সেই ভয়ংকর শূন্য দৃশ্য। একটা শহরে কেন মানুষ নেই? কেন মানুষ কম পড়ে গেল? আজীবন বামপন্থী ভাবনার মানুষটা এত নিঃসঙ্গ হলেন? হাঁটছেন খড়্গপুর বই মেলার সম্পাদক দেবাশিস চৌধুরী। কার্যকরী সম্পাদক অধ্যাপক তপন কুমার পাল। কবি কথা-সাহিত্যিক ভবেশ বসু। কবি ও প্রাবন্ধিক কামরুজ্জামান। সম্পাদক সুভাষ বসু। অধ্যাপক অভিষেক রায়চৌধুরী। রিপোর্টার সমরদা ও অংশুমান ছিলেন।
আমার চোখ বারবার ঝাপসা হচ্ছে। গলায় মালা পরিয়ে দিলেন কবি রাখহরি পাল কবি জাহির চৌধুরী কবিও প্রাবন্ধিক তাপস কুমার মুখোপাধ্যায় কবি বৈশাখী সিংহরায় পণ্ডা কবি লোপামুদ্রা লেখক বিভু কানুনগো।
ভীমদা এলেন। জয়া ছিলেন। সমীর শঙ্কর শেখরদা ছিলেন। প্রতিবেশিরা ছিলেন। বাম ঘরানার কয়েকজন আদর্শবাদী মানুষ আর ব ইমেলার কয়েকজন কর্মীযুবক।
মনে হল শশ্মানে দাঁড়িয়ে আছি।
বিদ্যুৎ চুল্লি বন্ধ। অতঃপর কাঠ। চন্দন। সূর্য আগুন। খোলা আকাশের বুকে একজন দাউ দাউ মানুষ চলে গেলেন।
অবশ্য যারা শারীরিক ভাবে থাকতে পারেননি তাঁরা স্পিরিচুয়ালী ছিলেন নন্দদার সাথেই। ইন্দ্রনীল কুলাভীর মতো অনেকেই কেঁদেছেন। এই কান্নাই মনে করিয়ে দেয় আমরা বটবৃক্ষ এবং ক্রৌঞ্চ দুটোই হারালাম এই ব্যাধ সময়ে।
এই শিকারী সময় একটা মানুষকে শরীরে নিয়ে চলে গেলেও আমাদের ক্রৌঞ্চির কান্নাকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
হে নতুন প্রজন্ম যদি হাঁটু গেড়ে বসে এই মানুষটির কাছে বসতেন তবে বৌদ্ধ শিখা পেতেন।
উনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত শ পাঁচেক কবিতা লিখেছিলেন। সেই আট নয় খানি কবিতার ডায়েরি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন।
তাঁর জীবনের একমাত্র কবিতা গ্রন্থটি আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন।
যাই হোক, পিতার মতো এক মানুষকে হারিয়েছি। আমার পরম সৌভাগ্য সেই কাটোয়াবাসী ভাগীরথী-অজয় পারের মানুষটির সঙ্গে দুটো দশেকের আত্মজৈবনিক অধ্যায় ছিল আমার।
নন্দদা আপনার আগুনে জল দিলাম।জল আগুন নিলাম। সূর্য সাক্ষী থাকল। আকাশ সাক্ষী থাকল।
……………….........
নটদা চরিত্র: হাসি ও ব্যঙ্গের মিশেল
অভিষেক রায়চৌধুরী
প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার মতই নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর সৃষ্ট একটি কৌতুকচরিত্র নটদা। নটদাকে কেন্দ্র করে লেখক বিভিন্ন কাহিনী পরিবেশন করেছেন যেগুলির মধ্যে হাস্যরস প্রধান। ঘরে ও বাইরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা আমাদের হাসির খোরাক যোগায়। এইসব ঘটনাগুলি তাৎক্ষণিক হলেও তার থেকে সৃষ্ট হাস্যরস আমাদের মনকে অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দেয়। প্রতিদিনের চাপে কর্মক্লান্ত আমরা এইসব হাসির উপাদান গুলোকে হয়তো ততটা গুরুত্ব দিই না। কিন্তু একজন লেখকের কাছে এইসব উপাদানের গুরুত্ব বেশি। নন্দদুলাল রায়চৌধুরী তাঁর জীবনে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় যেসব হাসির ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেগুলিকে যথাসম্ভব একত্র করে 'নটদা বৃত্তান্ত ও অন্যান্য' বইতে তুলে ধরেছেন। এই নটদা একাধারে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা, রান্নার রেসিপি ইত্যাদি লেখেন। পত্রিকার নামকরণের সঙ্গে কবিতার বিষয় নির্বাচনেও লেখক নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর হাস্যরস সৃষ্টির মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন 'বিজলী হানো' পত্রিকায় আজকালকার নতুন বৌমাদের শ্বশুরঘর ভাঙা নিয়ে লেখা 'গায়ে কাঁটা দেওয়া কবিতা'--"নতুন বৌমা যবে জ্বালে সন্ধ্যাদীপ/তখনই ভাঙলো ঘর/হুড়মুড় ধরাধধর/ঘটনা বিপ্রতীপ।" আবার 'হাঁড়ির খবর' পত্রিকায় নটদা রেসিপি লেখেন–'বাসি রুইয়ের ঝাল কোর্মা'। যেহেতু রুই বাসি, তাই এক কিলো মাছে পাঁচশো গ্রাম লঙ্কা দেওয়ার নিদান দেন নটদা। আবার 'ঝরা কেশ' পত্রিকায় নটদার 'কুন্তল চূর্ণ' কবিতা প্রকাশিত হলে কবি তরুণ বোস আবিষ্কার করেন যে, তাঁরই একটি কবিতা থেকে নটদা দশলাইন নিজের নামে বেমালুম চালিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে তরুণ বোস নটদাকে অভিযোগ জানান। এই অংশের কথোপকথন পাঠকের মনে যেমন হাসির উদ্রেক করে, তেমনি আধুনিক কবি-লেখকদের কুম্ভীলকবৃত্তির মাধ্যমে সস্তায় খ্যাতি পাওয়ার বিষয়টিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—
"ঝরা কেশ' পত্রিকায় তোমার 'কুন্তল চুর্ণ' কবিতাটা নাকি আমারই একটা কবিতা থেকে…
–আমি দশটা লাইন অধিগ্রহণ করেছি। কারণ, আপনি ১২ লাইনের ঐ কবিতাটার দশটা লাইনই আবার কেলু চরণ দাসের 'কেশমঞ্জরী' কাব্য থেকে গ্রহণ করেছেন।
—কিন্তু ওটা তো দশ লাইনেরই কবিতা ছিল। বারো হলো কি করে?
—আজ্ঞে, প্ৰথম দু'টো লাইন আপনার অরিজিনাল। এক, কবিতাটার নাম আর দুই, আপনার নাম।
—প্রথম প্রথম ওরকম একটু পূর্বসূরীদের অনুসরণ করতে হয়।
—আজ্ঞে, অপরাধ নেবেন না তরুণদা, এটা অনুসরণ না কুম্ভীলক বৃত্তি তা কে বলবে দাদা।
—যাই বল, এখন তো আমি জানামানা কবি। কম করে বারোশ' কবিতা ছাপা হয়ে গেছে।
—হ্যাঁ, তাইতো, কে যেন বলেছেন, 'When you steal a few lines from a piece it is plagiarism, but when you steal the whole of a work it is research!'
আর কথা না বাড়িয়ে 'নট, তোমার জয় হোক' বলে তরুণ বোস রাস্তা মাপলেন।"
এহেন স্বভাববিশিষ্ট নটদা অবলীলায় বিভিন্ন পুরনো পত্রপত্রিকা থেকে লেখা সংগ্রহ করে নিজের নামে চালিয়ে দেন আর খুব সহজেই খ্যাতি পেয়ে যান। চাঁদা তুলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অবলীলায় নটদা চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করে তাঁর কুম্ভীলকবৃত্তির কথা স্বীকার করে নেন–"বন্ধুগণ নাম কামিয়ে আজ আপনাদের এই মঞ্চে উঠেছি–এটাই বড় আর শেষ কথা। কি করে উঠেছি সে প্রশ্ন করে কোন আহাম্মক? নট আপনাদের সেবা করে যাবে। কোন কোন ডাকাত যেমন বড়লোকের টাকা মেরে গরিবের হাতে বিলিয়ে দেয় এই নট হল সেই ডাকাত। বেচারা বড়লোকরা তো চেল্লাবেই। তারা যখন অন্যের মাল হড়প করে তখন খেয়াল থাকে না। ওসব চিল্লানিতে কান দিলে কি ডাকাতের চলে?"
এইরকম বক্তব্যের মাধ্যমে লেখক নন্দদুলাল রায়চৌধুরী আমাদের সমাজের
কিছু সুবিধাবাদী কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি ব্যঙ্গের কশাঘাত হেনেছেন যাঁরা কোনোরকম গুণের অধিকারী না হয়েও সামাজিক খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভের জন্য অন্যের লেখা অবলীলায় চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেন। আপাত হাস্যরসের আড়ালে লেখকের সমাজ সচেতনতার এই ভূমিকাটি অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।
…………………........
স্মরণঃ নন্দদুলাল রায় চৌধুরী
ভবেশ বসু
দুটি ঝড় আছে।প্রকৃতির ঝড়।একটি নিম্নচাপের ঝড়।অন্যটি বৈশাখী ঝড়ের মতো।দুটি ঝড়েই ঝরে যায় বৃক্ষের পাতা।বৃক্ষ নিজে লুটায়।প্রথম ঝড়ে সকলে দরজা বন্ধ করে।জানালা খোলা রাখে না।কখন কি হয়!দ্বিতীয় ঝড়ে মানুষ সকল বাহিরে আসে।পিলপিল করে বাহিরে আসে।কারণ এই ঝড়ে ফুল ঝরে।ফল ঝরে।টাটকা ফুল লুটিয়ে পড়েছে।যে ফুল ফুটেছিল আপনার জন্য।একদিন প্রতিদিন ফুটে আছে।সকালে উঠলে।ফুল দেখলে না,এমন কোন জন আছে !সকলের বাড়িতেই সাজি আছে।সাজিতে ফুল আছে।সেই ফুলের পাঠক আমি।পাঠক তুমি।তাই ফুল ঝরলে সকলে বাহিরে আসে।সাজি ভরে।কান্না কুড়িয়ে নেয়। ইদানিং তার ব্যতিক্রম ঘটছে।ফুল ঝরে পড়ে আছে।সাজি পেল না।আঁধার ছিল।আলোর জন্য সংগ্ৰাম ছিল।কবে বন্ধ হয়েছে লাশ কাটা ঘর। তবে খড়্গপুর কি আবার ফিরছে "আঁধারের পাতা"য় ?
কবি ও লেখকরা এক একটি ফুল।আপনার বাড়িতে ফুলের গন্ধ।মানে কবিতার গন্ধ।আপনার বাগান হাসছে।মানে কবি আছে বাগানে।কবি এক বৃক্ষের নাম।কবি এক ফুলের নাম।ফলের নাম।কলম হাতে দাঁড়িয়ে আছে কলমের মালি।তাই প্রকৃতি সবুজ।রঙিন।সে রঙে রঙিন আকাশ।এরই নাম আলো।আগুনের ভিতর থেকেও সে আলো দেখা যায়।আগুন থমকে যায়।আগুন কাঁদে।মানুষ তোমার কান্না নেই !ঘর ছাড়া হলে না।
আবার একটি গোলাপ ঝরে গেল।নন্দদুলাল রায় চৌধুরী।এর আগেও ঝরেছে গোলাপ ফুল।বীরেন হালদার মনে আছে?খড়্গপুরের ইতিহাস লিখছিলেন।হাঁটা পথে।দু পা সম্বল করে।ঝরে গেছেন কবি কালীপদ কোঙার।সুগন্ধ বাজীরাও সেন।সম্পাদক লেখক শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য,দূরদর্শী,কালীসাধন ফৌজদার,দিব্যেন্দু গাঙ্গলী,কমলা রায় সরকার,অপর্ণা বেজ।এমন এক এক কত রকমের ফুল।একদিন বৃক্ষ সমেত লুটিয়ে পড়েছে আর একজন।সব বাগানে ফুটে থাকতো অনিল ঘড়াই।আমাদের সাজি ভরা হয় নি।খড়্গপুর সাজি ভরলে না।কি দিয়ে পুজো হচ্ছে তোমাদের ঘর ? মানুষের জন্যই তো সাদা ফুল।লাল ফুল।কবি।কবিতা।কালি কলম মন।
প্রায় নীরবেই চলে গেলেন নন্দদুলাল।শেষ যাত্রায় আমরা মাত্র কয়েকজন।সাজি হাতে হাহাকার কুড়িয়ে নিল না কেউ।ফুলের সঙ্গী ছিল কত ফুল।তারাও কান্না নেয় নি।আমরা ক্রমশ এগিয়ে চলেছি।ফুলের উপর ফুল বৃষ্টি হল না।ধুলা নেই।চোখের জল নেই।স্তব্দ হৃদয়।বৈশাখী ঝড়ে বাহিরে আসে সকলে।এই ঝড়েও দরজা বন্ধ।বড় দুঃসময়।কবি ও কবিতা বাদ দিয়ে খড়্গপুর আবার আগুনে পুড়ছে।ঝলসে যাচ্ছে।আমরা সকলে পুড়ছি। ধূপের মতো পুড়ে যাব।
……………………...
আমার চোখে নন্দদুলাল রায়চৌধুরী
প্রিয়াঙ্কা মজুমদার
নন্দদুলাল রায়চৌধুরী এককথায় খড়গপুর রেল শহরের সাহিত্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।ওনার সম্পর্কে বলতে গেলে শ্রদ্ধায় মাথানত হয়।উনি ছিলেন বিচিত্র মুখীন প্রতিভার অধিকারী।শুধু লেখক হিসেবেই নয়,তিনি অসম্ভব ভালো ছবি আঁকতেন।খুব ভালো ঔষধ দিতেন। শিষ্ট স্বভাব এবং খুবি মার্জিত ব্যাবহার ছিল ছোটোদের প্রতি।
বহু আগে যে খড়গপুর শহরে সাহিত্য সভা হতো সেই সভায় তিনি নিয়মিত উপস্থিত হতেন এবং সাহিত্য বাসরের চিঠি পাঠাতেন কবি লেখকদের।
সেই রকম অনেক চিঠি
পড়ে মুগ্ধ হতাম ছোটবেলায়।
বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অজস্র লেখা লিখেছেন। প্রত্যহিকী থেকে পেয়েছেন অনন্য সম্মান। মোটের ওপর উনি ছিলেন এই শহরের সাহিত্যের ভিত্তি প্রস্তর।খড়গপুর বইমেলার সাথে ছিলেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই লেখক কবি চিরদিন আমার হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।ওনার আশীর্বাদ প্রার্থনা করি জীবনে।
বেঁচে থাক ওনার সৃষ্টিসাহিত্য চর্চা সকলের হৃদয়ে ও মননে।আমরা গর্বিত এমন একজন মানুষ কে নিয়ে।
…………………….....
আমাদের নন্দ দা
মৌমিতা দাস
প্রথম পরিচয় টা হয়েছিল সুভাষ দা ( দুষ্টু ) র মাধ্যমে। কোনো একটি কবিতা পাঠের আসরে আমাকে সপাটে একটি প্রশ্ন করেছিলেন তুমি কি সেই মৌমিতা যে খবরের কাগজে ঝোগড়া করে। এমন দীর্ঘাঙ্গী, ব্যক্তিত্ববান, রাশভারী মানুষটির প্রশ্নের উত্তরে শুধু হেসেছিলাম। তারপর থেকে সমস্ত অনুষ্ঠানে নিজেই ডেকে নিতেন। বাইরে কোথাও গেলে আলাদা করে যত্ন। একদিন সন্ধায় গোটা পনেরো বাইক আমার ঘরের বাইরে। বাড়ির লোক নিশ্চিত বাইরে কোনো কান্ড করে এসেছি। ছাত্র ছাত্রী দের সরিয়ে বেরিয়ে এসে জানতে পারলাম আমাদের নন্দ দা পাঠিয়েছেন আমি মুনমুন চৌধুরী। চৌবে মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এর বার্ষিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে আপনি আমন্ত্রিত। তারপর সেই একই মানুষের হাত ধরে বইমেলা কমিটির সদস্য। প্রশ্রয় আর শাসন একসাথে উপভোগ করতাম। নিজের হাতের আঁকা ছবি উপহার দিয়েছিলেন শহরের বর্ষসেরা কবি হিসেবে আমাকে নির্বাচন করে। একবার বললেন কেউ তো নিমন্ত্রণ করছে না সাহিত্য বাসর কি তবে বন্ধ হয়ে যাবে? আমি বললাম না স্যার যেই মাসে কেউ ডাকবে না সেই মাসে নন্দনে বাসর হবে। অর্থাৎ আমার বাড়ি। সুনীল দা, অনিল দা আর নন্দ জেঠু এই তিন অভিভাবক সঙ্গে থাকলে বাড়ির লোক নিশ্চিত হত। পূর্ব পশ্চিম মেদিনীপুরের কত প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেছি কবিতা পড়তে শুনতে। বিয়েতে মত দিয়েছি শুনে বলেছিলেন ঠিক আছে করে ফেল, সবাইকে তো বিয়ে করতেই হয় আমরাও তো করেছি। কত অজস্র স্মৃতি ভিড় করে আসছে মানুষটাকে কেন্দ্র করে।অসুস্থ ছিলেন বহুদিন। অনিল দা চলে যাওয়ার পর যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল শহরের বুকে সেটা আরো দীর্ঘ হল। সুনীল দা, ভবেশ দা, তপন স্যার দের হাতে দায়িত্ব দিয়ে আগেই অন্তরালে চলে গেছেন। এবার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তবে শহরের সাহিত্য চর্চার সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছে তারা সারাজীবন মনে রাখবে মানুষটার অবদান।
.................................
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ছবি - ভবেশ বসু
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment