ভালোবাসি ভাষা
শাহীন কামাল
পৃথিবীতে মানুষই হলো একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা আছে, এই ভাষার কারণে আমরা অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা হয়েছি। যেখানে মানুষ আছে সেখানেই ভাষা আছে। অবশ্য প্রাণীর অস্তিত্ব শুরু থেকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভাষা ব্যবহার করছে বলেই মনে করা হয়। পৃথিবীতে ভাষার আবির্ভাব কবে হয়েছিল তা নিয়ে ব্যপক গবেষণা হয়েছে সত্য কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্তের অভাবে গবেষকরা ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি। ধারণা করা হয়, আজ থেকে প্রায় ৮০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার জঙ্গলে এপ জাতীয় প্রাণী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ভাষা ব্যবহার করে। অবশ্য এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞানীরা স্পষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তা অবশ্য সম্ভবও নয়। তবে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য ভাষা যে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে তা সংগত কারণেই প্রতীয়মান।
অতি সম্প্রতি ভাষার উৎপত্তি নিয়ে নৃবিজ্ঞানী, জিনবিজ্ঞানী, প্রাইমেটবিজ্ঞানী ও স্নায়ুজীববিজ্ঞানীদের আহরিত তথ্য ভাষাবিজ্ঞানীগণ খতিয়ে দেখে একটা স্থায়ী সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছেন। ভাষার উৎস সম্পর্কে ধর্মীয় বিশ্বাসও আলোচনার দাবী রাখে। বিশ্বের অধিকাংশ ধর্মমতে প্রথম মানুষ আদমকে বিশ্বের যাবতীয় পশু-পাখীর উপর কর্তৃত্ব দেয়া হয় এবং তাকে এই সব পশু-পাখির একটি করে নাম দেন; এটি ছিল আদমের ভাষাজ্ঞানের প্রথম বড় প্রয়োগ। পৃথিবীতে যতো ভাষা আছে সেগুলোর চরিত্র আলাদা আলাদা হলেও "এটাও সম্ভব যে বর্তমানে সব ভাষাই একজন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এসেছে," বলেন অধ্যাপক ফোলি।
বিশ্বের সর্বত্র প্রচলিত মনুষ্য ভাষাগুলির মধ্যে গাঠনিক সাদৃশ্য থেকে অনুমান করা হয় ভাষার উৎপত্তির ঘটনা ইতিহাসে একবারই ঘটেছিল। প্রাণীকুলের মধ্যে একমাত্র মানব জাতি যারা ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে সক্ষম। যদিও অন্যান্য প্রাণীর কথা বলার ক্ষমতা নাই এরপরও বেশকিছু প্রাণী তাদের নিজেদের মধ্যে মনের ভাব ও আবেগ প্রকাশ করার জন্য অভিনব কায়দায় অঙ্গভঙ্গিমার সাহায্যে ও শব্দ প্রয়োগ করে মনের আকুতি ও আকাঙ্খা ব্যক্ত করতে পারে। যেমন ডলফিন গোত্রের দুইটি প্রজাতি তথ্য আদান প্রদান করার জন্য একই ভাষা ব্যবহার করে। এমন কী হাতি, ঘোড়া, শিম্পাঞ্জি নিজেদের মতো ভাষা ব্যবহার করে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করে।
বাংলাদেশের একটা মোবাইল কোম্পানি কয়েকবছর আগে টেলিভিশনে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কেমন নিষ্ঠুর সে দৃশ্য! জেলখানায় কয়েদিদের মধ্যে কথা না বলার শাস্তিটা অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের " মনপুরা" নামক সিনেমায় খুনের মামলায় নির্বাসিত নায়কের কথা না বলতে পারার আকুতি ফুটে ওঠে সুনিপুণভাবে। বাকহারা মানুষরা তাই ইশারার মাধ্যমে কথা বলে যা " ইশারা ভাষা" হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মুখের ভাষার আগেই ইশারা ভাষার উদ্ভব ঘটে। মুখের বিকৃত ভঙ্গিমা, কাঁধের ওঠানামা কিংবা আঙুল তাক করে মূক ও বধির লোকজন নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে।
সময় ও স্রোতের মতো ভাষা প্রতিনিয়ত তার গতি পাল্টাচ্ছে। অস্তিত্ব রক্ষায় অনেক ভাষা অন্যের সঙ্গে মিশে খর্ব করছে ভাষার স্বাতন্ত্র্যতা। চলমানতায় পুরাতন ভাষা মরে গিয়ে নতুন ভাষা জন্ম নেয় প্রতিনিয়ত। এক ভাষার মধ্যে জম্ম নিচ্ছে আরেক ভাষা। এভাবেই তৈরি হয় আঞ্চলিক ভাষাগুলো।পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৭১১১ টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। কিন্তু তা স্বত্তেও বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ কথা বলে মাত্র ২৩ টি ভাষায়। ভাষার আঁতুড়ঘর হিসেবে খ্যাত দুটি দেশ হলো পাপুয়া নিউগিনি ও ইন্দোনেশিয়া। পাপুয়া নিউগিনিতে ৮৫০টিরও বেশি ভাষা রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় ৬৭০টি ভাষা লোকমুখে ফেরে। প্রতি ১৫ দিনের একটি করে ভাষা মুছে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে।
এই যে আপনি নিজ মাতৃভাষায় লেখাটি পড়ছেন এটা আপনার সৌভাগ্য। ভাষাভাষীর সংখ্যার হিসাবে আপনার ভাষা সপ্তম স্থান দখল করে আছে। আপনার ভাষা রক্ষায় রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনা যা ভাষার প্রতি ভালোবাসার ইতিহাসে বিরল। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আপনার মুখের ভাষার মান রক্ষা করেছিল বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির সে ভাষাপ্রীতির আন্দোলন বিশ্বের সকল ভাষাভাষী মানুষকে আলোড়িত করেছে। ইউনেস্কো তাই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বজুড়ে প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। সঠিক সংখ্যায় বললে সারাবিশ্বে ২৬ কোটি ৫০ লাখ ৪২ হাজার ৪৮০ জন বাংলায় কথা বলে। সেই কারণে বাংলাকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ মাতৃভাষা হিসেবে মনে করছেন কোন কোন ভাষাবিজ্ঞানী।
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যাধিক স্বাধীনতা ভাষার স্বকীয়তার প্রতি হুমকি। অন্য ভাষার সাথে নিত্যতার মিথস্ক্রিয়া বাংলা ভাষার জন্য শুভকর নয়। বিশ্বায়নের এই বাস্তবতায় অন্য ভাষা শেখা কিংবা ব্যবহার দোষের নয় বরং তা খুবই দরকার। কিন্তু অপ্রয়োজনে বাংলা ভাষার সাথে অন্য ভাষার শব্দের যথেচ্ছা ব্যবহার কাম্য হতে পারেনা । রক্তের দামে কেনা ভাষা স্বমহিমায় ভাস্কর থাক সম্মানের সাথে। জগতের সকল বাংলা ভাষাভাষীর পারস্পরিক সম্পর্ক আরো জোরদার থাকুক।
...........................
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ছবি - তাহমিনা শিল্পী
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment