Tuesday, 14 February 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৭

 



রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৭

হিমালয় যাত্রা


    "যখন যেমন মনে করি 

           তাই হতে পাই যদি

     আমি তবে এখনি হই

             ইচ্ছামতী নদী।"

     

      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের আগে থেকেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে যেতেন। তাই বালক রবির সাথে পিতার যোগাযোগ ঘটত খুব কম। সেকারণে বাল্যকালে ছেলের কাছে তিনি একপ্রকার অপরিচিতই ছিলেন। 

    

      রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন প্রায় বারো বছর তখন সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ এর পৈতে উপলক্ষে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় এলেন। ব্রাহ্ম সমাজের রীতি নীতি অবলম্বনে যতদূর সম্ভব আপৌত্তলিক রীতিতে উপনয়নের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হল। 

   

       ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটি তখন বেঙ্গল একাডেমি স্কুলের ছাত্র। নূতন ব্রাহ্মণ তো হলেন, কিন্তু নেড়া মাথায় ফিরিঙ্গি স্কুলে যাবেন কী করে? এই চিন্তায় কিশোর মন যখন বড়ই উদ্বিঘ্ন -- তেতালায় মহর্ষির ঘরে ডাক এলো আর অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটল ঠিক তখনই। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমালয়ে যাবেন, এবারে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান কিশোর রবি কে। রবি কি তাঁর সঙ্গে যাবে?


  "কোথায় বেঙ্গল একাডেমি আর কোথায় হিমালয়!" 

  ইচ্ছে করল চিৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে বলে -

   চাই - ই - ই"।  


     হিমালয় যাত্রা উপলক্ষে সেই প্রথম রবির জন্য আলাদা করে পোশাক তৈরী করা হল। কী রঙের এবং কী রকম কাপড়ের পোশাক তৈরী করা হবে সেটাও মহর্ষির আদেশ অনুসারেই হল। পোশাকের সঙ্গে সংযোজিত হল জরির কাজ করা গোল মখমলের টুপি। 


     মহর্ষি তাঁর চিরাচরিত রীতি অনুসারে যাত্রার শুরুতে বাড়ির দালানে সবাইকে নিয়ে উপাসনা করলেন। রবি গুরুজনদের প্রণাম করে জুরি গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছাল। রেলগাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ রেলগাড়িতে চড়ার জন্য " বিশেষ দক্ষতার" প্রয়োজন বলে যে উপদেশ দিয়ে কিশোরের  মনে ভয়ের সঞ্চার করেছিল সেই ভয়টাই মন কে আচ্ছন্ন করে রাখল। কিন্তু তারপর -- 

 "গাড়িতে এত সহজেই উঠিলাম যে মনে সন্দেহ হইল, এখনও হয়ত গাড়ি ওঠার আসল অঙ্গটাই বাকি আছে।" 


      নেড়া মাথায় মখমলের টুপি পরতে মনে মনে আপত্তি ছিল। তাই টুপি টা হাতে নিয়েই বসেছিলেন কিশোর রবি। কিন্তু মহর্ষির কাছে পরিচ্ছন্নতার ত্রুটি হবার জো নেই যে! তাই বললেন - "মাথায় পরো।" অনিচ্ছা সত্ত্বেও টুপি টা পরতেই হল। 


      হিমালয় যাত্রাকালে ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটির মনে শুধু যে আনন্দের সঞ্চার হয়েছিল --তাই নয়! এতদিন দূরে দূরে থাকা অপরিচিত পিতা কে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্যলাভ এবং তাঁকে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মহর্ষির সমস্ত কল্পনা এবং কাজ খুব যথাযথ ছিল। মনের মধ্যে কোন জিনিস তিনি ঝাপসা রাখতে পারতেন না। জীবনস্মৃতিতে পিতৃদেব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাই লিখছেন -- "হিমালয় যাত্রায় তাঁহার কাছে যতদিন ছিলাম, একদিকে আমার প্রচুর স্বাধীনতা ছিল। যেখানে তিনি ছুটি দিতেন সেখানে তিনি কোন কারণে কোন বাধাই দিতেন না, যেখানে তিনি নিয়ম বাঁধিতেন সেখানে তিনি লেশমাত্র ছিদ্র রাখিতেন না।" 


      রেলগাড়ি ছুটে চলেছে... দুপাশে সবুজ গাছপালা, ছায়াময় গ্রাম, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ... মায়াময় মরীচিকার আবেশ ছড়িয়ে যেন উচ্ছল, চঞ্চল ঝর্ণার মত ছুটে চলেছে।  


       রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন  দুই বছর - বীরভূমের বোলপুর স্টেশন থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে মহর্ষি কুড়ি বিঘা জমি কিনে একটি একতলা বাড়ি নির্মাণ করিয়েছিলেন। বাড়ির নাম দিয়েছিলেন "শান্তিনিকেতন" । পরে এখানে তিনি আশ্রম স্থাপন ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ছাতিম গাছের তলায় বসে মহর্ষি অনুভব করেছিলেন -  "মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি।"  


     ছোট রবিকে নিয়ে হিমালয় যাত্রার পথে কয়েক দিনের জন্য বোলপুর থাকার সিদ্ধান্ত করলেন। সন্ধ্যার সময় বোলপুর স্টেশনে গাড়ি এসে পৌঁছাল। পালকিতে চড়ে শান্তিনিকেতন বাড়িতে এলেন। কিশোর রবির পিতার সাথে ভ্রমণে বেরিয়ে যেমন করে গভীর ভাবে পরিচয় ঘটেছিল পিতা- পুত্রের ঠিক তেমনই বোলপুর শান্তিনিকেতনের সঙ্গেও এই প্রথম পরিচয় ঘটল রবীন্দ্রনাথের। 


       এখানে চাকর বাকরদের শাসন ছিল না। তাই পল্লীপ্রান্তে নীল দিগন্তরেখা ছাড়া আর কোন খড়ির গণ্ডি ও ছিল না এখানে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ও ছেলে কে পল্লিপ্রান্তরে,  মাঠে- প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানোর কাজে কোন নিষেধাজ্ঞা দেন নি। তাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যে কঠোর বিধি নিষেধের বেড়াজাল সর্বদা ঘিরে রাখত, বোলপুরে এসে সেই বাঁধন, পূর্ণ স্বাধীনতায় পর্যবসিত হয়েছিল। 


       বর্ষার জলের ধারায় বোলপুরের লাল মাটি ক্ষয় হয়ে যে ঢিবিওয়ালা খাদ সৃষ্টি করে - সেগুলিকে খোয়াই বলে। সেখান থেকে জামার আঁচলে করে নানা রকমের পাথর সংগ্রহ করে মহর্ষির কাছে এনে হাজির করলে তিনি কৈশোরের এই অধ্যবসায় কে একদিনের জন্যেও তুচ্ছ বলে উপেক্ষা করেন নি, উৎসাহ প্রকাশ করে বলতেন - " ওই পাথর দিয়া আমার পাহাড়টা তুমি সাজাইয়া দাও।" 

                       …………………… 



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...