Saturday 31 December 2022

নিউইয়ার সেলিব্রেশন অথবা গমগম ফসফস // ই-কোরাস ৮৯

 



নিউইয়ার সেলিব্রেশন অথবা গমগম ফসফস 

শ্রীজিৎ জানা

বাইশ ফুরোলে তেইশ। সোজাসাপ্টা হিসেব। আবির রঙের রোগা লিকলিকে চেহারার ধারাপাত। তার জমিতে কালো অক্ষরে ছাপা সংখ্যার ক্রম। একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ। এসব ডিঙিয়ে দু'দশ দুই বাইশ। দু'দশ তিন তেইশ। বিকু স্যারকে জানো না! বিজয় কুমার সামন্ত। খাতায় সই করতেন --বি.কু। অঙ্কেরর ক্লাসে সংখ্যার জাগলারি খেলতেন। বাইশের আগে কত? পিছে কত? বাইশ-তেইশের মাঝে কত? বাইশ মানে জমজ দুই। যেন মানিকজোড়  দু'ভাই। এমন করে সংখ্যা নিয়ে লোফালুফি করতেন তাতে সবার পিলে চমকে চমকে উঠত। 

তবে কথা হচ্ছে তিন সাড়ে তিন দশক আগের। তখনো দেখা হলে কেউ কাউকে বলত না  'হ্যালো গাইস্'! কুশল জানতে পিঠে ধাঁই করে থাবড়া মেরে বলত না--হোয়াটস্ আপ ব্রো? খারাপ কিছু দেখলেই বিস্ফারিত চোখে বলতে শুনিনি --ও সিট্! মেয়ের বান্ধবী সেদিন বললে;

:আঙ্কেল তোমাকে হেব্বি কূল লাগছে!

বললুম ----তা টপাকুল, নারকেল কুল নাকপ মরাডাঙ্গা বনের বেতকুল?

মেয়ে তো আকাশ থেকে সোজা ধপাস। টপা আর বেতকুলের কুলকিনারা পেতে  কুলকুন্ডলীর ভেতর দিয়ে তার কুলকুল করে গরম স্রোত বয়ে যাওয়ার জোগাড়। কুল শব্দদ্বয় তার হেডের উপর দিয়ে বাউন্স করে সোজা গ্যালারির বাইরে। কুল চিনবে কি, মনে মনে রাগে তার কূলপাণা চক্কর! কুল বলতে মেয়ে তো নারকেল কুল বই চেনেনা। চিল বলতে চেনে 'চিল বিয়ার'! তিরঙ্গা বলতে চেনে গালের দেওয়াল টেনে চোয়াল ঘেঁষে ঠুসে দেওয়া তামাকজাত মশলা। "দোষ কারো নয় গো মা"। দেশের নায়ক-নায়িকারা লোভেরর পসরা সাজিয়ে বলছেন--- জুবা পে কেশরী। দানে দানে মে কেশর। অথবা সর্বগ্রাসী  বলিউড শেখাচ্ছে গান---পিয়া নেহি তো পার্টি ক্যায়সি?

এতসব কথার মাঝে তেইশের আগমন। কিন্তু বাইশ যাবে তেইশ আসবে। তাকে নিয়ে এত লাফানঝাঁপান কিসের বাপ? নটুদা বললে,

-----তুমি বুড়িয়ে গেছো বাপ্। সাইডে গ্যারেজ হয়ে যাও। আজ ফুল নাইট মস্তি চলবে। নিউ ইয়ারকে ওয়েলকাম করতে চোখে নো ঘুম।অনলি ধামাকা। সাথে ঢুকুঢুকু আর ঢকাঢকা। মানে গানে-পানে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন। পুরাতন দুখ্যু, যন্তণা ফেলিওর সবকে ঝাড়পুঁচ করে দেব। নতুন বছরের দেওয়ালে নতুন ড্যামপ্রুফ কালার লাগিয়ে দেব। নিউ ড্রিম, নিউ রেজুলেশন। 'করবো লড়বো জিতবো রে"। চোখ খুলে দেখো কাকা হোল ওয়ার্ল্ডে নাইটে লাইটে সেজে উঠবে। আর আতশবাজিতে ফুঁসফুঁসিয়ে উঠবে বাতাস। সামান্য কলকাতাকে দেখো কিংবা হাফপ্যান্টের শহরগুলোর আয়োজন দেখলে ভির্মি খাবে। ডিজে উইথ ডিজে গার্ল।  সময়ের সঙ্গে "কদম কদম বাড়ায়ে যা,"! সোসাইটি চাইছে সেলিব্রেশন! এন্টারটেনমেন্ট! মানে "মেক সাম নয়েজ "! এসব মানতে পারলে থাকো নইলে বাপি বাড়ি যা।

শান্তি পেতে গুরুদেবকে পাকড়াও করলুম,

--- গুর্দেব বাইশ গজের খেলা তো শেষ। মাঠের ভিতরে স্কোর বোর্ডে স্কোর গোল্ডেন ডাক। গ্যালারির বাইরে আত্মীয় পরিজন সবার কাছ থেকেই উদুম স্লেজিং। জীবনের বাইশ সালটা কাটলো এমবাপের মতো ট্রাজিক হিরো হয়ে। চীনের করোনা, সরকারের দক্ষিণা আর নিরাকারের করুণায় মোটের উপর দাঁতে দাঁত চেপে টপকে গিয়েছে সালটা। সামনের তেইশ কেমন কাটবে সবিস্তারে বর্ণনা করুন।

গুরুদেব উবাচ--- গতস্য শোচনা নাস্তি। গানটা শুনিস নি 'যা গেছে তা যাক'। পঞ্জিকার মতে তেইশও বেগ দেবে বিস্তর। তবে মনে জোর রাখ আর গুরুপদে মতি। তাহলেই সদগতি।

----- না, মানে, শনি রাহু কেতুবাবুরা কি স্বস্থানে অবস্থান করবেন? নাকি মিউজিকাল চেয়ার খেলে বেড়াবেন? তাহলে প্রতিকার বলে দিন গুর্দেব। দশ আঙ্গুল ভরে গেছে পাথরে। এবার পুরো আস্ত একটা পাহাড় মাদুলি করে গলায় ধারণ করব।

-----ধুর্ ব্যাটা বুড়বক্  গ্রহরা তো ঘুরবেই। নইলে খেলা হবে কি করে? আগে তারা টেস্ট ম্যাচ আর ওয়ান ডে খেলতো। এখন টি-টোয়েন্টি আর টি টেন খেলছে। মানে ধর তক্তা মার পেরেক। এই দেখলে ভিখারি, এই সে রাজা। এই দেখলি জ্যান্ত কৈ মাছের মত ধড়ফড় করে লাফাচ্ছে, এই তাকে দেখবি ক্লিনবোল্ড। সবই গ্রহের কেরামতি। ভাবিস না। মহা মৃত্যুঞ্জয় কবচ দেবো,। দক্ষিণা একটু মোটা লাগবে। মোটা মানে কেষ্ট বিষ্টুর মত মোটা।

মরা কইভোলা মাছের মত মুখ করে চেয়ে রইলুম গুরুদেবের শ্রীবদন পানে।

দিনকাল তারর আপন ছন্দেই পাল্টাচ্ছে স্বরূপ। হ্যাপি নিউইয়ার নাকি শুভ নববর্ষ! বাংলাপক্ষ ইংরেজিপক্ষ দুজনেই নারদ -নারদ! 'হ্যাপি' আর 'নিউ' শব্দ দুটো আজকাল বড্ড ভাবায়! হ্যাপি কে? অথবা কারা? হ্যাপি থাকার মন্ত্র কি? নিউ আসলে কত দিন নিউ? শুভ-অশুভের ফারাক বুঝতে চাইছে কি  নতুন প্রজন্ম? নিউইয়ার আর নববর্ষ আসলে যে দুটো সংস্কৃতিকে তুলে ধরে তার ফারাক বুঝতে চেয়েছে কি আজকের যৌবন?  ওদেশ হ্যাপি থাকতে চায়। এদেশ নতুনবর্ষে শুভ কামনা করে। সুখ ক্ষনিক। শুভের ফল সুদূরপ্রসারী। যদিও-

 "ঘুচে যাক গ্লানি 

মুছে যাক জরা

শুদ্ধ স্নানে শুচি হোক ধরা"

-র মতো প্রার্থনা নিউ ইয়ারের সেলিব্রেশনের রাতে  আজকের তারুণ্যের কাছে বড্ড বোরিং সং মনে হবে। আজকে উদযাপন মানেই ফুল মস্তি। ফুল নাইট পার্টি। উদম নৃত্য সাথে পাটিয়ালা পেগ। 'জিও জিন্দেগি জি ভরকে'! এমন আনন্দ কতক্ষণের! এমন উদযাপন কতটা শান্তি দ্যায় মনকে। নাকি ভেতর ঘরের দৈন্যতাকে ঢাকার জবরদস্তী আয়োজন। গ্লাসে গ্লাস ঠুকে যে আনন্দ বিনিময় সেই আনন্দের উষ্ণতায় জড়িয়ে রাখছি কি ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যাওয়া পাশের মানুষটাকে!নটুদা বল্লে --হয়তো হতাশার মতো শোনাবে। তবু এত যে আড়ম্বর আসলে সবই ফক্কা। সারারাতের হ্যাং ওভার কাটতে না কাটতেই খবর পাবি ধর্ষণের,রাশিয়ার বোম ফেলার,নেতাদের বাটপারি। সবই দেখানেপনা। মার্কেটিং স্ট্যাটিজি।আমার কাছে নিউইয়ার মানে বেলুন,রঙিন ফিতে,টুনি বাল্ব আর আতসবাজি। কিন্তু নববর্ষ মানে মাটির প্রদীপ,মঙ্গলশঙ্খ,ধূপধূনো,আরতি, মন্ত্রোচ্চারণ। 

"সমারোহে এসো হে পরমতর

সুন্দর এসো হে"। 

মেলেনা রে দুটোতে কিছুতেই। জোর করে বকচ্ছপ সাজাছি।

----কিন্তু কালচারের আদানপ্রদান হলে দোষ কোথায়? রবি ঠাকুর তো বলেছেন--দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে।

----কি নিয়েছিস?রাস্তায় দাঁড়িয়র চুমু খাওয়টা যেমন নিবি তেমনি রাস্তায় ফকফক করে পিক না ফেলার সুঅভ্যাসটাও নে। খামোখা ধার করতে যাস না।ঋণ করা বড় দোষ।

মনের কোনে মেঘ জমে। মন হেঁটে যায় ডাউন মেমোরি লেনে। সেই সবে গাঁ-গঞ্জে নিউইযার গ্রিটিংস বিক্রির সবে চল এসেছে। এক টাকা দামের গ্রিটিংস কিনে তাতে ছড়া লিখেছিলুম--- 

পাকা জাম মিষ্টি

গোল লঙ্কা ঝাল 

তোমার আমার বন্ধুত্ব 

থাকবে চিরকাল। 

তেমন বন্ধুত্বের তার কেটে গেছে কবেই।অনেকের সাথে আজ আর যোগাযোগ নেই।  ফেসবুক যদিও ফিরিয়ে দিয়েছে অনেককে। এই নিউইয়ারে তাদের সাথে শুকনো শুভেচ্ছা চালাচালি হবে জোরকদমে।  তারপর---আজ দুজনার পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে।  ফেসবুকে ফ্রেন্ড হয় না। ফ্যান হয়। বন্ধুত্ব আর কোন গুণমুগ্ধের তফাৎ বিস্তর। নতুন বছরের সামনে দাঁড়িয়ে তবু স্বপ্ন দেখা। স্বপ্ন দেখতে চাই বলেই হয়তো ভুবন ভরে এত আয়োজন। কথায় বলে-- শেষ ভালো যার সব ভালো তার। আবার কেউ বলে---সকালেই নাকি দিনের পরিচয়। আসুক একটা রোদ ঝলমলে নতুন সকাল। মনমরা বেকারের চোখে ফুটে উঠুক কাজ পাওয়ার আনন্দ রোদ্দুর! রাজপথের ধরনাতলার হাতে পৌঁছে যাক বাদামী খামের হাস্নুহানা ফুল। চা -দোকানের বাচ্চা মেয়েটা একটা গোটা পাউরুটি আর এক গ্লাস দুধ -চা পাক। প্লাটফর্মের ছেলেটাকে কেউ তো দিক একটা গরম সোয়েটার। গাুয়ের দলুই পাড়ার মাধবীদিকে বিয়ে করে নিয়ে যাক কেউ। সবার জন্য একটা শক্তপোক্ত ছাত তৈরি হোক। প্রতিদিন একসাথে কফিতে চুমুক দিক পুতিন--জেলেনেস্কি। সীমান্তগুলি বারুদের চিৎকার থেমে যাক। পার্লামেন্ট যেন হট্টমালার আখড়া না হয়। এসেম্বলি যেন বিরোধীদের একটু জায়গা দেয়। নেতারা একটু সৎ হতে শিখুক। অভিনেতা আর অভিনেত্রীরা শুধু অভিনয়ই করুক। স্কুলে পড়া হোক। হাসপাতালে চিকিৎসা। আদালতে বিচার। সরকারি দপ্তরে সময়মতো কাজ হোক। সবাই কথা বলুক মুখ খুলে,সাহসে। যে যার মতাদর্শে সৎ থাকুক। ঘোড়া কেনাবেচা বন্ধ হোক। জেল- গারদে অপরাধীরা থাকুক। পাঠ্যবই- এ লেখা হোক আলোকিত মানুষদের কথা। আলোর কথা। খবর পড়া মেয়েটি হাসিমুখে ছড়িয়ে দিক খুশির খবর। নিউ ইয়ারের রাতে পার্ক স্ট্রিটে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াক ঘরের মেয়েরা।

সর্বোপরি নতুন বছরের, ঝাল বেশি দিলে যেমন ধমকাই ফুচকাওয়ালাকে তেমনি যেন পাড়ার নেতাকে  জাল জোচ্চুরি করলে ধমকে বলতে পারি- শুঁটিয়ে লাল করে দেব। নোংরামি বের করে দেব। তা নাহলে বর্ষবরণের এত্ত আড়ম্বর বটুদার কথায়--গমগম ফসফস।

                         ..........................


গ্রাম সংখ্যার প্রকাশিত হয়েছে। আপনি সংগ্রহ করতে পারেন।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - নিজস্ব

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...