Saturday 17 December 2022

কবিতা সামন্ত এর কবিতা // ই-কোরাস ৮৭

 



কবিতা সামন্ত এর কবিতা

১.

স্মৃতি শুধু থেকে যায় সময়ের অন্তরালে

              

জানো,একটা সময় ছিলো শুধুই ভালো লাগার। সকাল থেকে রাত্রি যেন সময় তৃষ্ণার্তের মতো লাগতো। কতো কথা কতো গল্প সব যেন বলেও বলা আর শেষ হতো না।

একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস আর একই উত্তর তবুও বারবার শোনা আর বলা।


আদর মাখানো ভাদরের মন কেমনের সময় বসন্তের রঙে রঙিন হয়ে লেগে থাকতো কাঁচা বাঁশ আর ভ্রমরের গল্পে।

বিছানার চাদরে আতরের গন্ধ ম ম করতো।

ভোরের নরম রোদ জানালার হালকা পর্দার ওপার থেকে আরও নরম হয়ে ভেদ করতো।


ঠোঁট আর বুকের মাঝে অনেকটা সময় আটকে থাকতো দুষ্টুমি ভরা ভালোবাসায়।

শাড়ীর আঁচলে আদর বাঁধা থাকতো বারবার টান পড়তো বিছানায় থাক দুষ্টুমি হাতের মুঠোয়।


তারপর একটা একটা করে দিন পার হয়ে মাস বৎসর চলে যেতে লাগলো ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে। কথায় বার্তায় সময় উঠে এলো দায়িত্বের পরিধি চক্র নিয়ে।

সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে সরে যায়।রোদ জ্বলা দুপুর হেসে বলে মধ‍্যাহ্ন সময়।


এখন আর ভালো লাগার সময় খোঁজার মতো সময় হয়ে ওঠেনা। মেঘলা আকাশের মতো মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ক্লান্তির হাত ধরে।

জানালার ওপাশে অরণ্যের ভেতর থেকে অন্ধকার এসে জানালা ছুঁয়ে যায়। ছোট ছোট চারা গাছেরাও বৃক্ষে পরিণত হয়েছে নিজের মাথায় রোদ ধরতে ব‍্যস্ত দেওয়াল বেয়ের রোদও আসতে পারেনা ইচ্ছে হলেও।


যে ব‍্যালকনিটাতে বসে দখিণা বাতাসে চুল খুলে হাওয়া লাগাতাম গান শুনতে শুনতে সে ব‍্যালকনিতে শ‍্যাওলা জমেছে।ওখানে আর বসা যায়না সেভাবে।টবে রাখা ফুলের গাছ গুলো কবেই হাসি হারিয়ে নিজেদের মরদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁয়।


রাতের আকাশের তারাদের দিকে কতদিন সেভাবে তাকানো হয় না।বলা যায় ইচ্ছে করেনা।মনে হয় কোন বর্ষাদিনের কাঁদন মেঘের বন্ধ চোখের পাতার নীচে  ওরাও চাপা পড়েছে।

ঠিক খোঁজ নেওয়া হয়নি ওরা আজও সেই চোখ পিটিয়ে মিটিমিটি চায় নাকি!


রূপালী রাতে চাঁদের মোম গালিচা জোছনার রূপ যৌবন পূবের পুকুরের জলে এসে ভালোবাসার খেলায় মেতে ওঠে নাকি তাকানো হয়নি।

দেখার সময় বড্ড ক্লান্তির ঘুম জড়িয়ে ধরে চোখের পাতায় চুমু দিয়ে যায়।ওদের আদর আবদারে আমি গলে গিয়ে চোখ বন্ধ করে দিই বিছানার কোন এক পাশে।


ভোরের সূর্য পর্দার গায়ে লুকোচুরি খেলার আগেই চলে যাই সমুদ্র ডুব দিতে তাই নরম রোদের দুষ্টুমি আমার আর ধরা হয়না।

যে যার মতো করে থাক।আমি নাহয় আর ভালো লাগা খুঁজবো না।

                          …………………. 



২.

যাপন

      

কনের জল সইতে যাওয়া হলুদের রঙ লেগে থাকে হেমন্তের গায়ে। একটা অধ‍্যায় শেষ করে তবেই নতুন অধ‍্যায়ের শুভ সূচনার সূত্রপাত।

কারা যেন হৈ হৈ করে আদরে যতনে নবান্নের নবাআব নন্দিনীকে ঘরে নিয়ে আসে।


এরাও একদিন চোখের কোণে অনেক স্বপ্ন বুনে ছিল। এখন তার সত্যি হওয়ার আনন্দে উৎফুল্ল সবাই।

এখনো বসন্তের রঙ লাগতে অনেক বাকি।


মাঝখানে শুধু বিরহের হাহাকার যন্ত্রনা ঠিক যেন মেয়ে বিদায়ের আগে বাপের বাড়ির মায়া পিছুটান থেকে নিজেকে আলাদা না করতে পারার যন্ত্রণা।


এক জীবনে দু নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। এটাই প্রকৃতির নিয়মনীতি। প্রিয়ার ঘরের সমস্ত সুখ কুড়িয়ে নিতে হলে পিতার ঘরের মায়া ত‍্যাগ করাটাই নারী জীবনের বিশাল বড় অধ‍্যায়ের জন্ম হয়।


হলুদ রঙের ঝরা পাতা গুলো যেন পিতার ঘরে কাটানো সেই সব দিনের সমস্ত আলপনা আবছায়া হয়ে মুছে যেতে চায়।কিছুদিন মেমরি থেকে সবটা ডিলিট হয়ে খালি এ‍্যলবামের মতো পড়ে থাকে এক কোণায়।আবার এবাড়ি ওবাড়ি সব জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা কতো রঙিন ছবি।


নতুন করে আলপনা আঁকতে হয় নতুন খুশির স্রোতের বুকে।

ততদিনে পাতার মর্মর কান্নার শব্দ কমে আসে আর উঁকি দেয় শাখায় শাখার কচি নরম বাদামি লাল সবুজের কতো ছোট ছোট পাতারা।


একটু বসন্তের হালকা দখিণা হাওয়া দিয়েছে কি দেয়নি অম্নি ফুলে ফুলে রঙিন হতে শুরু করে প্রকৃতির বুক। ঠিক বোঝা না বোঝা নতুন বৌয়ের সাজে মেয়েটির মতো।কতো আর পিছুটান ধরে কান্না করবে! এবার তো আপন বধূর ভালোবাসার পরশে নিজেকে বদলাতেই হবে। হাজার হোক তার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে পরিপাটি করে সাজিয়ে তুলতেই হবে।


সবটাই যে ভুলে গিয়ে নতুনভাবে নতুনের সঙ্গে ঘর বাঁধা।বিরহ না থাকলে পাওয়ার আনন্দটাই যে বৃথা।

ক্ষেতে ক্ষেতে ফসলের সবুজ মায়া আর গাছে গাছে ফুলের।ফাগুয়া রাঙিয়ে দিয়ে যায় গোটা প্রকৃতির বুক।

পাখিরদের কলতান উঠোনে খেলা করে কৃষ্ণ‍চূড়ার রাঙা পাপড়ি।

মধুমাসের যাপন কথা শুরু হয় ফাগের রঙিন পাখনায়।

                       ………………….. 


৩.

পূর্বপুরুষের উঠোন

                         

আমাদের এখন পাখির মতো পাখনা গজিয়েছে। উড়তে উড়তে কোথায় যে উড়ে যাচ্ছি কিছুই জানিনা। মরচে পড়া ঘরের তালা আর শ‍্যাওলা জমা উঠোন ব‍্যবহার করিনা তবুও কখনও কখনও সামনের ব‍্যক্তিকে নাক উঁচিয়ে বলি এই তুমি কি জানো? আমি কোন বংশের বংধর?


আমার সাত পুরুষের পূর্ব পুরুষরা এই করেছেন সেই করেছে। লজ্জায় কুঁচকে থাকা ছাতিটা লোকের কাছে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির থেকেও বেশি হয়ে যায়।


কখনও ঠাকুরদার তৈরি সেই শ‍্যাওলা জমা ঘাটের জলে পুঁটি মাছেদের সঙ্গে বসে গল্প করা হয়নি।জলে ডুব  সাঁতার দিয়ে কতোটা শ্বাস আছে আমাদের ফুসফুসে তাও জানা হয়না।কেমন করে রান্না ঘরের চালে বসে শালিক জোড়া তাদের ভালোবাসার খুনসুটি ঝগড়া করে তাও দেখা হয়না।উঠোনে শরতের গন্ধ মাতাল করা শিউলী গাছটার দিকে ঝুড়ি নিয়ে গিয়ে কখনও ফুল ভরে পুরানো ঠাকুর ঘরের দরজা খুলে রেখে আসা হয় না।


নিয়ম করে কুলদেবার আরাধনায় ধ‍্যানে বসাও হয় না।

মা কাকিমাদের রান্না ঘরে গল্প জমে ওঠেনা।হাওয়া বদলের হাসি ঠাট্টা কখনও কখনও আবার রাগে চুড়ির ঝনাৎ কিংবা কড়া খুন্তির বেশিই শব্দ করে কথা বলা অথবা শীল নড়ার ঝগড়ার শব্দ আর আসেনা।সেভাবে পাত পেড়ে একসাথে বসে খাওয়াও হয়না।বলতে গেলে শরীরের মধ‍্যাংশ মানে পেটটা বাইরে বেড়িয়ে না আসে সেই ভয়ে রসে বসে বাঙালী কথাটাই ভুলে গেছি।


দেখনদারির নবাবীআনাতে পেটের কোন কোণে কতোটা খালি সেটাও লুকিয়ে রাখার ভনিতা করতে শিখেছি।


শিখেছি তো হরবোলা পাখির মতো অন‍্যের ভাষা।পোষ মানা পাখিদের মতো আদব কায়দা।আর অনেকটা  সংকীর্ণ হৃদয় যেখানে পূর্বপুরুষের বানানো নিয়মনীতি তাদের চিতার আগুনেই সহাঃ করে দিতে দুবার ভাবিনি।


তবুও বলি আমি অমুক বংশের আমি তমুক বংশের। ঘুরে ফিরে সেই পূর্বপুরুষের উঠোনেরই খুঁটি ধরে বেঁচে থাকি। সত‍্যি বলতে যতই তর্কাবিতর্কের দলিল দিই কিন্তু আদৌ নিজেদের পরিচয় তৈরী করে উঠতে পারিনি আজও আমরা।

                         ………………… 

গ্রাম সংখ্যার প্রকাশিত হয়েছে। আপনি সংগ্রহ করতে পারেন।  


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - কবিতা সামন্ত

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614








No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...