Sunday 27 November 2022

মহাশ্বেতা দাস এর গল্প// ই-কোরাস ৮৪


আর এক নাম নিষ্ঠা

মহাশ্বেতা দাস



"তিতলি ঘুম থেকে উঠে পড়। স্কুলে যেতে হবে।" বছর ছয়েকের তিতলি কে ঘুম থেকে তুলে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী করে নিজে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী হতে থাকে সোমনাথ। রোজ অফিস যাওয়ার পথে তিতলি কে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে সোমনাথ অফিস যাওয়ার জন্য স্টেশনের দিকে পা বাড়ায়। "টিফিন বক্স গুলো টেবিলে রাখা থাকলো...." ও ঘর থেকে তিতলির মা স্নিগ্ধা বলতে থাকে। 


দক্ষিণ কলকাতার তিন কামরার ফ্ল্যাট বাড়িতে তিনজনের সংসার। ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে তিতলি বড্ড বাবা ন্যাওটা। আর হবে নাই বা কেন! সোমনাথ তো অফিসের কাজ টুকু ছাড়া মেয়ের বাইরে আর কিছু ভাবতেই পারে না। সেই ছোট্ট বেলা থেকে তিতলির যাবতীয় ঝক্কি ঝামেলা একাই সামলায় সে। এমনকি তিন বছরের তিতলি যেদিন জ্বরে বেহুঁশ - সারারাত জেগে থেকে তিতলির মাথায় জলপট্টি দেওয়া, ন্যাপি বদলানো সব সোমনাথই করে। মা স্নিগ্ধার ভূমিকা এখানে নেহাতই নগন্য। স্নিগ্ধা বয়সের তুলনায় একটু বেশী মাত্রায় আত্মসমাহিতা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা তো দূর..  প্রয়োজনটাকেও ছোট করে নিয়েছে নিজের মতো করে। নিজের চারপাশে সর্বক্ষণ এমন এক অদৃশ্য দেওয়াল তুলে রেখেছে যে সহজে কেউ সেটা উপেক্ষা করে ওর কাছে পৌঁছাতে পারে না।

আজ সোমনাথ তিতলিকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গেটের সামনে দেখলো খবরের কাগজ টা পড়ে আছে। কাগজ টা তুলে নিয়ে স্নিগ্ধার হাতে দিতে গিয়েও একটা হেড লাইনে চোখ পড়তেই থমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে কাগজটা অফিসের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। তিতলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে স্টেশনে এসে ট্রেনের কামরায় জানালার ধারে বসে চোখ আটকে গেল সেই হেড লাইনে। মনটা তোলপাড় করছে-যেন হিমালয় পর্বত শৃঙ্গ টুকরো টুকরো হয়ে আছড়ে পড়ছে ওর বুকের ভিতরে।


বহু বছর আগের কথা। স্কটিশ চার্চ কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ে সোমনাথ, স্বরূপ, অভিরূপ, রোহিত, শ্রীজাতা আর স্নিগ্ধা। ক্যান্টিনে, গাছতলায়, করিডোরে এমন কি ছুটির দিনের বিকেল গুলোতেও ভিক্টোরিয়া বা বর্টানিক্যাল গার্ডেন... ওদের একসাথেই দেখা যেত। ওদের নির্ভেজাল বন্ধুত্ব অন্যদের ঈর্ষান্বিতও করত মাঝে মাঝে। ক্রমে ওরা গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার দিকে পা বাড়ালো। শ্রীজাতার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে বিদেশে চাকুরিরত এক সুপাত্রের সাথে। ছেলেরাও যে যার মতো করে কর্মসংস্থানের খোঁজে। এসবের মধ্যে কবে যেন রোহিত আর স্নিগ্ধার মধ্যে একটু একটু করে গড়ে ওঠে এক অন্যরকম সম্পর্ক যেটা নিছক বন্ধুত্বের মধ্যে আর আটকে নেই। একদিন ঠিক হল সামনের পূজার ছুটিতে ওরা ছয়জনে মিলে বেড়াতে যাবে সান্দাকফু। আলোচনার প্রথম পর্বে পাহাড় না সমুদ্র এই নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও পরে সিদ্ধান্ত হয় পাহাড়। সদলবলে বেরিয়ে পড়তে দেরী করে না কেউ।


পাঁচ দিন ধরে ওরা ঘুরে বেড়িয়েছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বিশ্বভরা প্রাণের মাঝে নূতন করে যেন আবিষ্কার করলো নিজেদের অস্তিত্ব। ওদের বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে রইলো গিরিশৃঙ্গ থেকে পাইন গাছের সারি, ঝর্ণা, আকাশ। সেদিন বিকেলে ওরা তিস্তা নদীর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল দূরের উদ্দাম ঝরনা, পাহাড়ি গাছ আর খরস্রোতা নদীর চঞ্চল রূপ। সূর্য তখন প্রায় অস্তাচলগামী। আবির রঙা লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছিল আকাশে। আচমকা একটা আওয়াজ.."আ - আ - আ...!" চুরমার করে দিল সব রকমের স্তব্ধতা। 


রোহিত পা হড়কে নিমেষের মধ্যে পুতুলের মতো ছিটকে পড়ে গেল খরস্রোতা তিস্তা নদীর জলে। তারপর আরও তিনদিন ধরে ওরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মৃত অথবা জীবিত কোন অবস্থাতেই রোহিতকে খুঁজে পেল না। একপ্রকার আত্মগ্লানি আর অপরাধ বোধ নিয়েই ওরা ফিরে এল কলকাতায়।


সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হতে শুরু করেছে। ঘর অন্ধকার করে নিজের রুমে নিজেকে আবদ্ধ করে বসে আছে স্নিগ্ধা। ছবির বইয়ের পাতার মতোই মনের মধ্যে উলোট পালট খাচ্ছে রোহিতের সাথে কাটানো একের পর এক দিনগুলি।

আর নিজের শরীরে অনুভূত হচ্ছে রোহিতের সাথে কাটানো কোন এক আবেগঘন মুহূর্তের ফল, নতুন প্রাণের স্পন্দন।

কী করবে স্নিগ্ধা!! কেমন করে মুখ দেখাবে সমাজে! মা-বাবাও কি মেনে নেবে তার এই অবস্থা!

অনেক ভেবে নিজেকে শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্তই নিয়ে নিল স্নিগ্ধা। আচমকা ঘরে ঢুকে স্নিগ্ধার হাত থেকে বিষের বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্নিগ্ধার গালে এক চড় মারল সোমনাথ।

মহাবিশ্বের সংসার নামক কক্ষপথে সোমনাথ আর স্নিগ্ধার আবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু কেবলই তিতলি। এভাবেই চলছিল বেশ। আজ খবরের কাগজটা খুলে যেখানে সোমনাথের চোখ আটকে গেল..."রোহিত ফিরে এসেছে।"

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখল স্নিগ্ধা একই রকম অবিচল- কিছু বুঝতে পারলো না। কিন্তু রাতে খাবার টেবিলে বসে বুঝতে বাকি রইলো না যে স্নিগ্ধা জেনে গেছে রোহিতের ফিরে আসার খবর। অন্যান্য দিন রাতে খাবার পরে স্নিগ্ধা উত্তরের রুমে আর দক্ষিণ দিকের রুমে তিতলিকে নিয়ে ঘুমাতে যায় সোমনাথ। মাঝে ব্যবধান ডাইনিং হল। আজ তিতলি ঘুমিয়ে গেলে সোমনাথ নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না। সোজা চলে এল স্নিগ্ধার রুমে। স্নিগ্ধা জানত তাই দরজা খুলেই রেখেছিল। খবরটা স্নিগ্ধার কাছে আড়াল করতেই কাগজটা অফিসের ব্যাগে নিয়ে চলে এসেছে সোমনাথ। আজ অফিসেও সারাদিন কাজে সেভাবে মন দিতে পারলনা সোমনাথ। অনেকদিনের সাজানো সাম্রাজ্য কেউ কেড়ে নিতে এলে যেমন টা হয়!!

"ভালোই হয়েছে তুমি এসেছ। আগামীকাল রোহিতকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছি।" 


 সোমনাথ এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না।

"তুমি যা যা শর্ত দিয়েছিলে বিয়ের সময়, আমি এই ছয় বছরে তার একটাও অমান্য করিনি। তিতলি ছাড়া আমাদের মাঝে দ্বিতীয় কেউ আসা তো দূরের কথা একটি রাতও এই ডাইনিং হলের দূরত্ব পেরিয়ে তোমার কাছে আসার স্পর্ধা দেখাই নি। পিতৃস্নেহের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি তিতলির জন্যে। আজ তিতলি যেমন আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না.... আমিও তিতলিকে ছেড়ে বাঁচবো কি করে!" 


"যাও ঘরে যাও। অনেক রাত হয়েছে তিতলি ঘুম থেকে উঠে পড়বে।"-শান্ত অথচ বলিষ্ঠ ভাবে স্নিগ্ধা এই কয়টি কথা বলার পরে সোমনাথ আর কিছু বলতে পারে না, চলে আসে তিতলির কাছে। পরেরদিন শনিবার-সবারই হাফ ছুটি। তিতলি স্কুল থেকে চলে এসেছে কিন্তু সোমনাথ তখনও অফিস থেকে ফিরতে পারে নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে-কলিং বেল বেজে উঠল। পরিচারিকা দরজা খুলে রোহিতকে ড্রইং রুমে এনে বসালো। স্নিগ্ধা এল কিছুক্ষণ পরে... রোহিতের চেহারায় অনেক বিকৃতি ঘটেছে। একটা পা খোঁড়া হয়ে গেছে তাই ক্রাচ নিয়ে হাঁটাচলা করতে হয়। কপাল ও থুতনির কাছে কয়েকটি স্পষ্ট কাটা দাগ বলে দেয়  রোহিতের জীবনে বড় সড় দুর্ঘটনার কথা। 

"আমার মেয়ে কোথায়! আমি দেখব তাকে।"

রোহিত তিতলির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে -"মামনি বলতো আমি তোমার কে হই?" 

তিতলি হাতের পুতুল টা নিয়ে খেলতে খেলতেই উত্তর দেয় - "তুমি! ... আঙ্কেল। আচ্ছা তোমার পাশে ওটা কী?" "শান্ত হও। তিতলি বাবা (সোমনাথ) কে ছাড়া কিছু বোঝে না। তাই এমন কিছু করো না যাতে....." 

স্নিগ্ধার নির্দেশে পরিচারিকা তিতলি কে এই ঘরে নিয়ে আসে।"ওটা কে ক্রাচ বলে।" সোমনাথ ঘরে প্রবেশ করে।

"বাবা আমি কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছি। চলো চলো আজ তো পার্কে বেড়াতে যাওয়ার দিন।" 

দৌড়ে এসে তিতলি সোমনাথের হাত ধরে প্রতি শনিবারের মতোই টানতে থাকে। তিতলির জেদাজেদিতে সোমনাথ ওকে নিয়ে পার্কের দিকে পা বাড়ায়। "জানো আমার এই অবস্থার জন্যে দায়ী কে?"

"জানি। আমি সব জানি।"

"সব জেনেও ঐ খুনি টার সাথে তুমি...!" 

স্নিগ্ধা রোহিতকে থামিয়ে দিয়ে.... 

"আমি জানি সেদিন সোমনাথ-ই তোমাকে ঠেলে খাদে ফেলে দিয়েছিল। ও যে আমাকে ভালোবাসে একথা বলার সুযোগ পায় নি। তাই হয়তো ওর মতো করে এই পথ বেছে নিয়েছিল। যদিও এটা কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, তবু বলছি আমি ওর নিষ্ঠার কাছে হার মেনেছি। তিতলি ওর ঔরসজাত সন্তান না হয়েও হৃদয়জাত সন্তান। হৃদয় দিয়ে তিলে তিলে তিতলির বাবা হয়ে উঠেছে। সোমনাথ আমাকে ভালোবেসেছে। কিন্তু কোন কামলোলুপতা নিয়ে নয়। সোমনাথের কাছে ভালোবাসার আর এক নাম নিষ্ঠা। আমি ওর নিষ্ঠা কে শ্রদ্ধা করি।" 


"এরপর তো আর কিছু বলাই চলে না। চলি.... ভালো থেকো। এ জীবনে না হয় তিতলির আঙ্কেল হয়েই রইলাম।" 

বাড়ির বাইরে পা বাড়ায় রোহিত।

              ৷৷।………………………।।।




সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - নিজস্ব

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614











No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...